‘‘আমি ঈশ্বরের দূত। ঈশ্বর আমাকে পাঠিয়েছেন। যতক্ষণ না আমার কাজ শেষ হচ্ছে, ঈশ্বর আমাকে ফিরিয়ে নেবেন না।”
‘‘বিজেপি ৩৭০টা আসন পাবে আর ‘এনডিএ’ ৪০০ আসন পাবে! আর গোটা দেশে বিজেপিকে সবচেয়ে বেশি আসন দেবে বাংলা।”
‘‘ইন্ডি জোট (বিরোধী জোট ইন্ডিয়াকে এমন শব্দবন্ধেই ব্যঙ্গ করত বিজেপি নেতারা) আসলে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ-বিরোধীদের জোট।”
উপরের প্রতিটাই বাক্যই নরেন্দ্র মোদি উবাচ। অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রতিটি সভায়, লোকসভায় এমনকী তাঁর পোষিত কিছু সংবাদমাধ্যমে নিয়ম করে এই কথাগুলো বলতেন নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু শাসক ভাবে এক, আর জনগণ সেই হিসেব পালটে দেয়। তৃতীয়বার দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যখন শপথ নিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি, তখন তাঁকে মন জুগিয়ে চলতে হচ্ছে শরিক দলের নেতাদের। নিজের দল ৩৭০ তো দূরের কথা, একক সংখ্যাগরিষ্ঠতাও পায়নি। ঔদ্ধত্যের জবাব হাতেনাতে পেয়েছেন নরেন্দ্র মোদি৷ তিনি জানেন, তৃতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে নিলেও এবারের সরকার পরিচালনাটা আগের দু-দফার মতো মসৃণ নয়। এও বাহ্য। না গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে না প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এর আগে কখনও নরেন্দ্র মোদিকে তাঁর শরিকদের ওপর নির্ভর করতে হয়নি। প্রশাসক নরেন্দ্র মোদি বরাবর থেকেছেন তাঁর নিজের মন মর্জির মালিক। তিনি যখন যা চেয়েছেন, সেটাই করেছেন৷ কারণ তাঁর কাছে ‘সংখ্যা’ ছিল। যে সংখ্যার জোরে তিনি একের পর এক অনৈতিক কার্যক্রম করে গেছেন। আজ নরেন্দ্র মোদি সংবিধানে মাথা ঠুকলেও এই সংবিধানকেই গত দশ বছরে বারবার চ্যালেঞ্জ করেছেন৷ এইবার ৩৭০-এর লক্ষ্যমাত্রা ছুঁলে নিশ্চিতভাবে বদলে দিতেন এই সংবিধানকেই। তাই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ, কীভাবে তিনি শরিকদের নানারকম বায়নাক্কা সহ্য করে একটি পাঁচ বছরের সরকার চালাবেন। আদৌ পাঁচ বছর সরকার চালাতে পারবেন তো? কারণ, তাঁর দুই প্রধান শরিকদের যা অতীত রেকর্ড তাতে নরেন্দ্র মোদিও যে এই দুজনকে প্রবল বিশ্বাস করেন এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।
নরেন্দ্র মোদি সরকার সেনাবাহিনীতে ‘অগ্নিবীরে’র মতো নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করে ছিলেন। এই অগ্নিবীর নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিবাদ এসেছিল বিহার থেকেই। আগামীদিনে এই অগ্নিবীর প্রকল্প চালু রাখলে বিহারের রাজনীতিতে যে তাঁর সরাসরি প্রভাব পড়বে, তা স্বয়ং নীতিশ কুমারও জানেন৷ আগামী বছরেই বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে, স্বাভাবিক ভাবেই নীতীশ কুমার চাইবেন অগ্নিবীর-এর মতো প্রকল্প বাতিল হোক। যদি না হয়, তবে আগামী বিধানসভা নির্বাচনে ইভিএমে এর প্রভাব পরবে৷ তেজস্বী যাদব-সহ বিহারের বিরোধী দলের নেতারা এই প্রকল্প বাতিল নিয়ে সরব হবেনই। নীতীশ কুমার চাপ বাড়াবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ওপরে।
ওদিকে, দক্ষিণ ভারত থেকে জোটসঙ্গী টিডিপি’কে নিয়ে চলতে হবে। টিডিপি নানা শর্ত (পড়ুন বায়না) আরোপ করবে অন্ধ্রপ্রদেশের জন্য। কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিলে বাকি দক্ষিণ ভারতে যে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতে হবে বিজেপিকে! এমনিতেই এত প্রচারের পরেও তামিলনাড়ু চূড়ান্ত হতাশ করেছে নরেন্দ্র মোদিকে। ৩৯ আসনের তামিলনাড়ুতে খাতাই খুলতে পারেনি বিজেপি। বাকি দক্ষিণ ভারতেও শোচনীয় অবস্থা। একমাত্র কর্নাটকেই যেটুকু আশা ভরসা। কিন্তু, সেখানেও জেডিএসের মতো দল বিজেপির কাছে নানা রকম বায়না করছে! সেসব সামাল দেওয়া কম ঝক্কির না নরেন্দ্র মোদির পক্ষে। এর মধ্যে টিডিপি’র কথা মতো অন্ধ্র’কে ‘স্পেশাল আর্থিক প্যাকেজ’ দিলে বাকি দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে যে বিজেপির পার্টি অফিস খোলারও লোক থাকবে না! দিনের শেষে নিজেদের দাবিদাওয়া পূরণ করে, টিডিপিও যে সরে আসবে না, তারই বা গ্যারান্টি কোথায়?
আরও পড়ুন-মহিলাদের ভোট ঢেলে তৃণমূলে, এবার তাই মার্জিন দ্বিগুণের বেশি
আর এইখানেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ! মনে রাখতে হবে, গত দশ বছরের প্রধানমন্ত্রিত্বে তিনি একমাত্র বিতর্কিত কৃষিবিলগুলো স্থগিত রাখা ছাড়া তাঁর সরকারের নেওয়া কোনও গণবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটেননি নরেন্দ্র মোদি! প্রতিবাদ হয়েছে৷ প্রতিরোধ হয়েছে। সাধারণ মানুষ রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেছেন কিন্তু কোনও কিছুতেই নরেন্দ্র মোদি তাঁর অবস্থান বদল করেননি৷ উল্টে প্রতিবাদী জনতার ওপরেই বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছে বিজেপি! গায়ের জোরে, সংখ্যাগরিষ্ঠের সংখ্যাধিক্যের জোরে বিরোধীদের কার্যত অচ্ছুত করে একের পর এক জনবিরোধী বিল সংসদে এনেছেন আর আইনে পরিণত করিয়েছেন! সেটা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) হোক বা কাশ্মীরে ৩৭০ বিলোপ হোক কিংবা ভারতীয় ন্যায়সংহিতা প্রণয়ন!
এই অগ্নিবীর নিয়েই বিজেপি তাদের অবস্থান থেকে এক ইঞ্চি সরেনি। উলটে অগ্নিবীর কেন জরুরি তা নিয়ে নানারকম ব্যাখ্যা দিয়েছেন সমাজমাধ্যমে! কিন্তু এবার?
রাজনীতির সমীকরণ যে খুব জটিল৷ আর জোট রাজনীতি আরওই। নরেন্দ্র মোদির পূর্বসূরি মনমোহন সিং বা অটলবিহারী বাজপেয়ীরা যেভাবে জোট রাজনীতির শর্ত মেনে সরকার চালিয়েছিলেন, সেই পথে এবার হাঁটতে বাধ্য হবেন নরেন্দ্র মোদি। যিনি ঔদ্ধত্যের চূড়ান্তে নিজেকে নিয়ে গেছিলেন। তিনি নিজের এক এবং অদ্বিতীয় এক ইমেজ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। যেখানে ভারতের বহুদলীয় রাজনীতিকে ধ্বংস করে ‘এক দেশ-এক দল-এক নেতা’র এক ‘ন্যারেটিভে’ তিনি দেশকে চালাতে চেয়েছিলেন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হল, গত নভেম্বর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন টেলিভিশন-ইন্টারনেট-পোর্টালে নিজেদের বিজ্ঞাপন দিতে শুরু করে। এবং সেই বিজ্ঞাপনে সরকারের নানা গুণকীর্তন শুরু হয়৷ সেই সময় বিজ্ঞাপনের খরচা সরকারই ব্যয় করে! মানে ভারতবর্ষের করদাতাদের টাকায় নিজেদের বিজ্ঞাপন করে নেয়। কিন্তু মজার বিষয় হল, এই গোটা প্রচারে কোথাও বলা হয়নি যে, কেন্দ্রীয় সরকার বা বিজেপি সরকার। বলা হয়েছে ‘মোদি সরকার’। ‘মোদি কি গ্যারান্টি’! অর্থাৎ মোদিই ব্র্যান্ড! সেই ব্র্যান্ডেরই প্রচার। বিজেপির এবারের প্রচারের ট্যাগ লাইনই ছিল মোদি কি গ্যারান্টি। এই যে প্রচারসর্বস্বতা। ইংরেজিতে খুব কাছাকাছি যে শব্দ দিয়ে এর ব্যাখ্যা চলে তা হল ‘নার্সিজম’। এই ব্র্যান্ড মোদিতেই একটা মোক্ষম আঘাত দিয়েছেন এদেশের মানুষ। এমনকী তাঁর নির্বাচনী ক্ষেত্র বারাণসীর মানুষও। নইলে যাঁর মুখ দেখিয়ে গোটা দেশে প্রচার হচ্ছে, তিনি সকাল সকাল প্রাথমিক ট্রেন্ডে পিছিয়ে যান! দিনের শেষে জিতলেও আগের বারের চেয়ে প্রায় তিন লক্ষ সাতাশ হাজার ভোট কমে গেল! আমি এবং আমিত্বের প্রচার করা নরেন্দ্র মোদিকে এখন আমি থেকে আমরায় উন্নীত হতে হচ্ছে৷ যেটা তাঁর নিজের কাছে যথেষ্ট লজ্জার! তাঁর জন্য এটাকে উন্নতি না বলে, অবনতিই বলা যায়। কিন্তু সুস্থ গণতন্ত্রের পক্ষে মঙ্গলজনক। তাঁর বক্তব্যে উচ্চারিত হচ্ছে এনডিএ-র কথা। যদিও গত একবছরে ক’বার তিনি এনডিএ নিয়ে কথা বলেছেন, তাঁর অতি-বড় ভক্তও বলতে পারবেন না!
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তৃতীয়বার শপথ নিলেও, আগামী দিনগুলো যে তাঁর জন্য খুব মসৃণ হবে না তা তিনি নিজেও জানেন। গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের অনেকগুলোই ভাগ করতে হচ্ছে শরিকদের সঙ্গে, প্রথম দু’দফায় যা প্রায় অভাবনীয় ছিল৷ সব মিলিয়ে অহংকারের প্রাচীরে একটা বড় ফাটল লেগেছে৷ সেই ফাটলকে জোড়া লাগানো এত সহজ নয়। বরং দিন কে দিন সেই ফাটল যে আরও প্রকটতর হবে সেকথা এখনই বলা যায়। নিজেকে ঈশ্বরের দূত বলে প্রচার করা নরেন্দ্র মোদি যত তাড়াতাড়ি বুঝবেন, যে গণতন্ত্রে জনতাই সবচেয়ে বড় ঈশ্বর, ততই ভাল।