জটাজূট সমাযুক্তাং অর্ধেন্দু কৃতশেখরাম্।
লোচনত্রয় সংযুক্তাং পূর্ণেন্দু সদৃশাননাম্।।
অতসীপুষ্প বর্ণাভাং সুপ্রতিষ্ঠাং সুলোচনাম্।
নবযৌবন সম্পন্নাং সর্বাভরণ ভূষিতাম্।।
শ্রীশ্রী চণ্ডীতে মায়ের চামুণ্ডারূপের পূজামন্ত্র। রোজ এই মন্ত্রটি পাঠ করতেন যিনি তাঁর নাম প্রফুল্ল চাকী। অরবিন্দের ভাই বারীন ঘোষ তাঁকে রংপুর থেকে কলকাতায় এনেছিলেন। উদ্দেশ্য, পূর্ববঙ্গের ছোটলাট বামফিল্ড ফুলারকে হত্যা। সে উদ্দেশ্য সফল হয়নি। তবে তার পর থেকেই প্রফুল্লর বাস মানিকতলার বোমার আড্ডায়। সেখানেই বিষ্ণুভাস্কর লেলেকেও নিয়ে এসেছিলেন বারীন। লেলে মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণ। অরবিন্দের যোগ শিক্ষক। বারীনও তাঁর শরণাপন্ন হয়েছিলেন ব্রহ্মচর্য মন্ত্রে দীক্ষা নেওয়ার জন্য। লেলে দেননি। সংসারীকে তিনি ওই মন্ত্রদীক্ষা দেন না। কলকাতায় আসার পর লেলের ঠিকানা স্কট লেন। অরবিন্দ সেখানেই থাকেন। ওই একই বাড়িতে।
মানিকতলা বোমার আড্ডায় আসা ইস্তক লেলের নজর ওই বছর কুড়ির যুবা প্রফুল্লর ওপর। তিনি মনে করতেন, “ভারত একদিন স্বাধীন হবেই; তা অনিবার্য। কাল প্রাতে উদয়াচলের কোলে সোনার থালা সূর্য উঠবে, এ যেমন অনিবার্য ও অবশ্যম্ভাবী, ভারতের ভাবী স্বাধীনতাও তাই।” তবে, দেশকে, মানুষকে মুক্ত করতে হলে রক্তারক্তি কাণ্ড বাধানোর দারকার নেই। ‘ভারত বিনা রক্তপাতেই মুক্ত হবে।’ তাই, তাই-ই, তিনি অরবিন্দ-বারীনের কাছে প্রফুল্ল চাকীকে চাইলেন। তাঁর বক্তব্য, “এমন সুলক্ষণ ছেলেকে নষ্ট করে লাভ কী? একে আমার সঙ্গে দাও, ওকে পরম যোগী করে দেব। ওর মধ্যে কয়েকটা বিভূতির চিহ্ন রয়েছে।”
প্রফুল্লকে নিয়ে চারুচন্দ্র দত্তের সঙ্গে তর্কাতর্কি বেধে বেধে যায় লেলের। চারুচন্দ্র যে-সে লোক নন। রীতিমতো আইসিএস। ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ আমলা। মুম্বইয়ে প্রথমে ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, পরে জজ হন। অথচ ওঠাবসা অরবিন্দ ঘোষ, সুবোধ মল্লিকদের সঙ্গে। মুম্বইয়ে থাকার সময়েই গভীর সখ্য গড়ে উঠেছিল তিলক আর গণেশ দেউস্করের সঙ্গেও। এহেন চারুচন্দ্র লেলের অহিংস পথে স্বাধীনতা লাভের ভবিষ্যদ্বাণী মানতে রাজি ছিলেন না। মনিকতলার বোমার আড্ডার কোনও সদস্যই লেলের মতে আস্থা রাখেনি। সম্ভাব্য শিষ্যদের হারিয়ে বিষ্ণুভাস্কর লেলে বঙ্গদেশ ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন প্রফুল্লকে। চারুচন্দ্র তো বটেই, অরবিন্দ-বারীনরাও প্রফুল্লকে ছাড়তে রাজি হননি। ফলে তাঁকে ছাড়াই বাংলা ছেড়ে হরিদ্বারের পথে পা বাড়ান লেলে।
এসব ১৯০৮ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসের ঘটনা। আর সে বছরই, মে মাসে মজফফরপুরে কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে ব্যর্থ হওয়ার পর, মরতে হল প্রফুল্ল চাকীকে। নিজের গুলিতে কিংবা দারোগা নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অব্যর্থ নিশানায়।
এবং প্রফুল্ল কোনও ব্যতিক্রম নন।
বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠে’ বর্ণিত দেশমাতৃকার মূর্তি। তাঁর দ্বিসপ্তকোটি ভুজে ভিক্ষাপাত্র নয়, খর করবাল।
অদ্বৈতবাদী স্বামী বিবেকানন্দের শক্তিরূপিণী কালীর অনবদ্য বন্দনা। মায়ের স্নেহ-আলিঙ্গনজ্ঞানে মৃত্যুকে বরণ করার আহ্বান। ‘সাহসে যে দুঃখ দৈন্য চায়, মৃত্যুকে যে বাঁধে বাহুপাশে/ কালনৃত্য করে উপভোগ/ মাতৃরূপা তারই কাছে আসে’— এরকম সরাসরি বক্তব্য উপস্থাপন ‘কালী দ্য মাদার’ কবিতায়।
ওই একই নামে নিবেদিতার প্রবন্ধ। সেখানেও সরাসরি শক্তিপূজায়, মাতৃমন্ত্রে আস্থা সংস্থাপন। “ভীরুর ক্লান্ত হতাশার দীর্ঘশ্বাস নয়, আত্মরক্ষার জন্য দয়াভিক্ষাও নয়, ভাগ্যের পায়ে নিরুপায়ে আত্মসমর্পণ কখনোই নয়। আনত হয়ে শোনো— বহুশতাব্দীর দুঃখ-বেদনা পার-হয়ে-আসা ভারতভূমি বিশ্বমাতার চিরন্তনী মাতার কাছে বলছেন, তুমি যদি বিনাশ কর আমায়, তবু তোমাতেই রাখব আমার অটল বিশ্বাস।”
এবং অগ্নিযজ্ঞের অগ্নিহোত্রী ঋত্বিক অরবিন্দের ‘ভবানী মন্দির’। ‘কর্মযোগীন’-এর পাতায় প্রকাশিত সেই আগুন ঝরানো বক্তব্য। ‘আমরা যে শক্তি প্রয়োগ করি তা মাতা ভবানীর, যিনি রক্ত-মাংসের বাহুতেও ধরেন বজ্র এবং ঝঞ্ঝার অমিত বিক্রম। দেবকুল নির্মিত তাঁর কৃপাণ তোমাদেরই জন্য।” Bhavani’s swords for you the gods prepare.
এসবের নিট ফল একটাই। শত্রু নিধনের জন্য মাতৃশক্তির আশীর্বাদ আবশ্যক, এই অনুভবে বাংলার যৌবনে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের অনিবার্য সঞ্চার। জগন্মাতা কালিকা ও দেশমাতার সহজ সমীকরণে বাংলার যুবশক্তি বুঝে গেল, শক্তিময়ী মা যদি একবার জেগে ওঠেন, তবে বিদেশি ব্রিটিশ শক্তি এবং দেশি নরমপন্থীর দল, দুটোই একেবারে বিলুপ্ত হবে।
আরও পড়ুন- আবহাওয়ার বদল, কাল থেকেই শুরু শীতের আমেজ!
আর এসবেরই অনিবার্য ফল পরিণামে বঙ্গভূমিতে যা যা ঘটেছিল সেসবের প্রত্যক্ষ দর্শনে বিস্ফারিত নেত্র হেমচন্দ্র দাস কানুনগো। পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির টাকায় ইউরোপে গিয়েছিলেন। শ্যামাজি কৃষ্ণবর্মার ডাকে সাড়া দিয়ে ‘ইন্ডিয়া হাউসে’ বিপ্লববাদ প্রচার করেছেন। মাদাম কামার মাধ্যমে ফরাসি সোশ্যালিস্ট দলের গুপ্ত সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ। প্যারিস থেকে বোমা তৈরির বিদ্যা শিখে দেশে ফিরেছেন ১৯০৭-এ। মেদিনীপুরে ফিরে দেখেন, “গুপ্ত সমিতির পূর্বের আড্ডা তুলে দিয়ে সত্যেনের (সত্যেন্দ্রনাথ বসু, হেমচন্দ্রের অনুপস্থিতিতে মেদিনীপুরের গুপ্ত সংগঠনের নেতা; সুরাটে কংগ্রেসের অধিবেশনে নরমপন্থীদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখিয়ে অধিবেশন পণ্ড করানোর ব্যাপারে তিলককে সাহায্য করেন; বিপ্লবাত্মক ইস্তাহার বিলি করার দায়ে ক্ষুদিরাম গ্রেফতার হলে তাঁকে মিথ্যা অছিলায় মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছেন, এই অভিযোগে সত্যেন্দ্রর সরকারি চাকরিটি গিয়েছিল।) বাড়ির পাশে এক ঘরে ‘আনন্দমঠ’ নাম দিয়ে তাতে একটি হাতখানেক লম্বা কালীমূর্তি স্থাপন করা হয়েছে।” এর কারণ জিজ্ঞেস করায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু উত্তর দিয়েছিলেন, “সকলেই এইরকম একটা কিছু চায়। হঠাৎ কী জানি কেন দেশটা বেশির কম কালীভক্ত হয়ে উঠেছে।” আর ক্ষুদিরাম বসু, যিনি আর কিছুদিন পরেই মজফফরপুর বোমার মামলায় ধরা পড়ে ফাঁসির মঞ্চে জীবনের জয়গান গাইবেন, সেই অগ্নিশিশু মজা করে উত্তর দিয়েছিল, “আর যাই হোক কালীর কৃপায় বেশ পাঁঠা খেতে মেলে; আর পাঁঠার লোভে ভক্ত জোটে।”
হেমচন্দ্র লক্ষ করেছিলেন, তাঁদের মুরারীপুকুর আর ভবানীপুরের গোপন আড্ডাস্থলে কালীর ছবি ঝোলানো ছিল। ‘অন্য আড্ডাতে এবং অনেক লোকের বাড়িতে এইরকম ছবিতে ফুল চন্দন দিয়ে নিত্য পূজা করা হত।’
এসবই তাঁর কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। কারণ, স্বদেশি আন্দোলনের আগে ছবিটা ছিল অন্যরকম। তখন পৈতেধারী ব্রাহ্মণ যুবকও পৈতেটাকে ‘অকারণ জঞ্জাল’ ভেবে খুলে রেখে দিত। দেবদেবীর মূর্তি বা ছবির সামনে ‘মস্তক অবনত করতে’ দ্বিধা বোধ করত। হিন্দু বলে পরিচয় দিতে লজ্জা বোধ করাটাই ছিল রেওয়াজ।
কিন্তু কালী ঝড়ে সব এলোমেলো। কালকে গ্রাস করেন বলে ওই দেবীশক্তির নাম কালী। সেই মহাকালীই প্রাক-স্বদেশি যুগের তাবৎ শক্তি বিচ্ছিন্নতা গ্রাস করে বাংলাকে নব শক্তি মন্ত্রে জাগিয়ে তুললেন। দাবানলের মতো শাক্ত জোয়ার দেখা দিল বাঙালির হৃদিমূলে।
আজকের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও সেই কালী রূপের ধারক ও বাহক। সেই শক্তি মন্ত্রের উত্তরাধিকার। সেকথা অস্বীকার করবে কে!