মৃত কুম্ভের মেলায় বিজ্ঞাপনের মারণ বীজ বনাম গঙ্গাসাগর মেলায় আতিথেয়তার নম্র বিচ্ছুরণ

পার্থক্যটা কোথায় সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল কুম্ভমেলার মহা বিপর্যয় এবং বিপ্রতীপে গঙ্গাসাগর মেলার সুষ্ঠু আয়োজন। যোগীরাজ্যের দুরবস্থা আর পশ্চিমবঙ্গের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা। লিখছেন শমিত ঘোষ

Must read

প্রচারের আলো এখন এতটাই তীব্র, যা এখন সেই আলোর বৃত্তের বাইরের পূতিগন্ধময় অন্ধকার অংশটা ঢেকে দেয়। আমজনতাও সেই আলোর দিকেই ধাবমান হয়৷
গণমাধ্যমে লক্ষ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন আর খবরে প্রভাবিত হয়ে আমজনতা ছুটে যায় সেই আলোর দিকে। উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভের যে অব্যবস্থা, এবং তার জেরে এতগুলো মানুষের প্রাণহানি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, আজকের গণমাধ্যম যা কিছু দেখায়, যে বিজ্ঞাপনের চটক আমাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়, তার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক কয়েকশো যোজনের। এবং এহ বাহ্য যে, এই বিজ্ঞাপন এবং গণমাধ্যমকে চমৎকার ব্যবহার করছে বিজেপি! উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজের এই মহাকুম্ভ নিয়ে পুণ্যার্থীদের একেকটা তিক্ত এবং ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বয়ান যত সামনে আসছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে, বিজ্ঞাপনের মোড়কে যা কিছু আমাদের দেখানো হয়েছে তার মধ্যে কতখানি মিথ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। একশ্রেণির সর্বভারতীয় গণমাধ্যম যাকে ‘বিশ্বমানের ব্যবস্থা’ বলে গত একমাস ধরে বর্ণনা করছিল, তা ছিল সর্বৈব মিথ্যে। এবং এই মিথ্যের রংচঙে মোড়ককে বেআব্রু করে দিয়েছে পুণ্যার্থীদের নিথর মৃতদেহগুলি! অমৃতকুম্ভের (Kumbh Mela) সন্ধানে গিয়ে এই চরম পরিণতির দায় কি অমৃতকালের সরকার অস্বীকার করতে পারে? সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, যোগী আদিত্যনাথ নাকি এই গোটা ঘটনার পিছনে ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব খাঁড়া করছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এই বিপুল ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে কে বা কারা? বরং যোগী আদিত্যনাথের সরকার মঙ্গলবার মধ্যরাতে ওই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে যাওয়ার বহু ঘণ্টা বাদে অবধি তো ঘটনার সত্যতাই স্বীকার করেনি!
আসলে, এই মহাকুম্ভকে ব্যবহার করে বিজেপি তাদের চেনা রাজনীতির কৌশল অর্থাৎ হিন্দুত্বের রাজনীতিকে আরও চরমে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজ্ঞাপন, ভিভিআইপিদের নিয়ে এসে তাদের জন্য বিশেষ স্নানের ব্যবস্থা, সবটা মিলিয়ে যোগী আদিত্যনাথ নিজেকে হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ হিসেবে প্রমাণ করতে কোনও কসুর করেননি। বস্তুত, উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকার এবং যোগী আদিত্যনাথের কাছে এই মহাকুম্ভ যতটা ছিল নিজেদের বিজ্ঞাপন করা, তার সিকিভাগও তাঁরা পুণ্যার্থীদের জন্য সুরক্ষা, পরিকাঠামো বা ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করেননি, তা আজ গোটা দেশের সামনে প্রমাণিত! লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে ধাক্কা খাওয়ার পরপরই বিজেপির অভ্যন্তরেও ক্রমশ একঘরে হতে থাকেন, একদা বিজেপির ‘ব্লু আইড বয়’ আদিত্যনাথ। মহাকুম্ভ’র মতো ‘ইভেন্ট’কে সামনে রেখে নিজের চরম হিন্দুত্বের ইমেজকে আরও মসৃণ করার প্রচেষ্টা যোগী আদিত্যনাথের মধ্যেও ছিল। আছে। শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশেই মসজিদের জমিতে মন্দির রয়েছে এমন দাবি নিয়ে অসংখ্য মামলা চলছে উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন আদালতে। এসব মামলার পিছনে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর প্রশ্রয় কতখানি তার উত্তর লখনউ বা গোরক্ষপুরের অলিতে-গলিতে কান পাতলেই শোনা যায়। ভেঙে পড়া অর্থনীতি, বিপুল বেকারত্বে ধুঁকতে থাকা রাজ্য বা দেশের বৃহৎ অংশের মানুষকে একমাত্র তীব্র ধর্মীয় উন্মাদনা দিয়েই বুঁদ করে রাখা সম্ভব। তাঁর রাজনীতির প্রথমদিন থেকেই তিনি সেই রাস্তাতেই হেঁটেছেন। তাই, দেশের তামাম গণমাধ্যমের ক্যামেরার সামনে এবারের মহাকুম্ভে এগারোবার ডুব লাগিয়েছেন। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী-সহ দেশের তাবড় ভিভিআইপি-দের ডেকে আনছেন। দেশের সামনে নিজেকে ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ হিসেবে প্রমাণ করার এমন মোক্ষম সুযোগ গোরক্ষপুর মঠের প্রাক্তন পীঠাধীশ ছাড়তে চাননি! গোটা মহাকুম্ভ মেলার এলাকা জুড়ে দক্ষিণী সুপারস্টারদের মতো বড় বড় কাট আউট লাগানো হয়েছে যোগী আদিত্যনাথের! আড়ম্বর এখানে ভক্তিকে ছাপিয়ে গেছে! তাই কোটি কোটি মানুষের জীবনের সুরক্ষার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেছে প্রচার! হেলিকপ্টারে পুষ্পবৃষ্টি! ড্রোন শো!
অথচ, যখন গভীর রাতে পদপিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছেন, তখন কোনও এয়ার অ্যাম্বুল্যান্স নেই! চিকিৎসক নেই! প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান অনুযায়ী, আপৎকালীন নম্বরে ফোন করেও কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি! অমৃতের সন্ধানে যাওয়া কোটি কোটি পুণ্যার্থীর কাছে প্রয়াগরাজের মহাকুম্ভ হয়ে উঠেছিল এক ভয়ঙ্কর বিভীষিকা!

আরও পড়ুন- বাংলায় এবার ডেইলি প্যাসেঞ্জারি বাঘেদের! সামনে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য

মনে পড়ে যাচ্ছিল গতবছরের গঙ্গাসাগর মেলার এক ঘটনার কথা। সেবার বিহার এবং রাজস্থান থেকে আসা দুই পুণ্যার্থীকে ‘এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে’ করে নিয়ে আসা হয় কলকাতার হাসপাতালে। প্রাণে বাঁচেন দু’জনই! ভৌগোলিক কারণেই গঙ্গাসাগর মেলা আয়োজন যেকোনও প্রশাসনের কাছেই অনেক বেশি চ্যালেঞ্জিং। কারণ, আজ অবধি এই মেলায় পৌঁছনোর কোনও সরাসরি স্থলপথ নেই। সাড়ে তিন কিলোমিটার নদীপথ পেরিয়ে এই মেলার মূল ভূখণ্ডে পৌঁছতে হয়! কিন্তু, বিগত কয়েকবছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার যেভাবে সাগরদ্বীপে এই মেলার আয়োজন করছে, তা প্রশংসা কুড়িয়ে নিচ্ছে ভিন রাজ্য থেকে আসা পুণ্যার্থীদের। মহাকুম্ভ নিঃসন্দেহে পৃথিবীর অন্যতম বড় উৎসব। জাতীয় মেলার স্বীকৃতিও পেয়েছে এই মেলা। বাংলার গঙ্গা সাগর সেখানে ‘দুয়োরানি’ হয়েই রয়ে গেছে। না পেয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে জাতীয় মেলার স্বীকৃতি। না পেয়েছে আর্থিক সাহায্য! এমনি সর্বভারতীয় গণমাধ্যমে কোনও প্রচারও নেই। অথচ, সনাতনধর্মে গঙ্গাসাগর মেলার মাহাত্ম্যও কোনও অংশে কম নয়। তাই, বাংলার বাইরে থেকে বিপুল সংখ্যক পুণ্যার্থী প্রতিবছর আসেন গঙ্গাসাগরে। অনেকেই হয়তো জানেন না, কিন্তু, গঙ্গাসাগর মেলায় যাঁরা যান তাঁদের প্রত্যেকের জন্য রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ইন্স্যুরেন্স দেওয়া হয়। পুলিশ, ভলান্টিয়ার, তীর্থযাত্রী-সহ সাংবাদিকরাও এই সুবিধা পান। মেলায় কোনও সমস্যা হলে রয়েছে টোল ফ্রি নম্বরও। ব্যবহার করা হয় ২১টি জেটি। আড়াই হাজার বাস, ছ’টি বার্জ, ৩২টি ভেসেল, একশোটি লঞ্চের ব্যবস্থা করে রাজ্য সরকার। পাশাপাশি গোটা এলাকা জিপিএস ট্র্যাকিং, স্যাটেলাইট ট্র্যাকিং করা হয়। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় থাকে ২৪০০ সিভিল ডিফেন্স ও অন্য ভলান্টিয়াররা। একটি ৩০০ বেডের চিকিৎসা পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়, যেখানে থাকেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীরা। ক্রিটিক্যাল কেয়ারের রোগীদের জন্য থাকে গ্রিন করিডরের বন্দোবস্ত। রাজ্যের অন্তত ৬ জন ক্যাবিনেট মন্ত্রী মেলার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে শেষদিন অবধি নিজেরা সম্পূর্ণ ব্যবস্থা দেখভাল করেন। হয়তো সেই কারণেই, গঙ্গাসাগর নিয়ে চেনা প্রবাদ, ‘সব তীর্থ বারবার গঙ্গাসাগর একবার’ বদলে ‘গঙ্গাসাগর বারবার’ শোনা যায় এখন। কিন্তু, ১৯৫৪ থেকে প্রতিবার কুম্ভমেলায় (Kumbh Mela) পদপিষ্ট হয়ে ভক্তদের মৃত্যুর যে পরম্পরা, সেই পরম্পরায় যোগী আদিত্যনাথরা বদল আনতে পারলেন না! পুণ্যার্থীদের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ উত্তরপ্রদেশ প্রশাসন! মৃতদেহের স্তূপে, স্বজন হারানোর কান্না ছাপিয়ে যোগী আদিত্যনাথ নরেন্দ্র মোদিদের বিসদৃশ কাট আউট যেন আরও বে-আব্রু করে দিচ্ছে! অমৃতকালে অমরত্বের প্রত্যাশা নিয়ে এসে মৃত্যু উপহার পাওয়া নিথর ঠান্ডা লাশগুলো কিন্তু মুণ্ডিত মুস্তক কানে দুল আর গেরুয়া বসন পরিধান করা মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের প্রশাসনিক দক্ষতা নিয়ে অনেকগুলো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে গেল! খানিক চোখ খুলে দিয়ে গেল, চোখে ঝিলমিল লেগে যাওয়া এদেশের কোটি কোটি মানুষেরও!

Latest article