প্রেম-বিরতি

Must read

সুরশ্রী ঘোষ সাহা
সারাদিন রূপের উষ্ণতা ছড়িয়ে আঁচল গুটিয়ে সূর্য একটু একটু করে বিকেলের দিকে এগোচ্ছে। কম করে দুশো বছরের পুরনো একটা বটগাছের নিচের বাঁধানো সিমেন্টের ধাপিতে বসে রয়েছে মৃণাল। মাঝেমধ্যে তার কোলে ও আশপাশে এসে পড়ছে পাকা বটফল। মাটিতে পড়লে থেঁতলে যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ, ঠিক যেমন করে কোনও কারণ ছাড়াই থেঁতলে যায় মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক।
পেপার এন্ড সল্ট ঝাঁকড়া চুলগুলো বারবার কপালের উপর এসে পড়ছে মৃণালের। থেকে থেকেই সে হাত দিয়ে সরাচ্ছে। বহু ব্যবহৃত রুমালটা দিয়ে মুখ মুছছে বারবার। অন্যমনস্ক ভাবে পায়ের নিচে ঝরে থাকা কোনও বটফলকে আরও খানিক পিষে দিচ্ছে জুতো দিয়ে। মরে যাওয়া জোঁকের পেটের মতো মাটিতে রক্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে খানিক। বুড়ো বটগাছের ঝুরিগুলো আরও আরও ঝুঁকে নতুন করে মাটি ছোঁবার চেষ্টা করে চলেছে…
বামহাতে ধরে থাকা ছোট্ট কালো মুঠোফোনটায় সময় দেখে মৃণাল। কিছুকাল হল এই বস্তুটির আগমন ঘটেছে পৃথিবীতে। তাই হাতঘড়ি পরার অভ্যাসটা ছেড়ে গিয়েছে। তার উপর সময়টাই ভাল চলছিল না মৃণালের। কাঁটা কি কখনও সময়কে ভাল পথে বেঁধে রাখতে পারে? সে তো শুধু নিজের তালেই ঘোরে। আশপাশে মাঠগুলোয় বাচ্চারা খেলতে ঢুকছে লাল-নীল ইউনিফর্ম পরে। তাদের মায়েরা জটলা করে বসে গল্প করছে। একটা-দুটো করে বয়স্ক লোক হেলতে-দুলতে আসছে গঙ্গার ধারে বিকেলের হাওয়া খেতে। কিন্তু মৃণাল যার অপেক্ষায় সেখানে বসে আছে শুধু সেই মানুষটিরই দেখা নেই। আবারও রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মোছে সে। ঘামের সঙ্গে রাগের গুঁড়ো এসে লাগে রুমালে। খানিক বিরক্তিও। মগজের ভিতরে সুচের মতো ফুটছে সময় অপচয়ের হিসাব। রক্ত না ঝরালেও ব্যথা-ব্যথা অনুভূত হয়। কিন্তু তাকে প্রাণপণ মনগলা বরফ দিয়ে ধুয়ে ফেলতে চায় সে। চকচকে বাসনের মতো নতুন করে তুলতে চায়। রাগ তো আগ। জ্বলন ধরালে কোনও কিছুই টিকিয়ে রাখে না। যেমন রাখেনি এককালে।
অন্যদিকে, একদলা ক্লান্তি কপালের ঘামের নকশায় এঁকে সুজাতা এগিয়ে আসে মৃণালের দিকে। ওরও হাতে রুমাল। তবে পরিষ্কার। ফুঁ দিয়ে ধাপির শুকনো পাতা উড়িয়ে কমলা-সবুজ রঙের আঁচলটা কোলের কাছে ধরে ধীরে-সুস্থে বসে সুজাতা।
—অনেকক্ষণ এসেছ?
—হ্যাঁ সময়মতোই এসেছি।
কথায় বিরক্তির ঝাঁজ মেখে যায় মৃণালের।
—আজ গরমটা খুব বেশি। এমন গরম পড়বে জানলে আজ কখনওই এখানে আসতে রাজি হতাম না।
সুজাতা ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে এগিয়ে ধরে মৃণালের দিকে।
—থাক, লাগবে না। তুমি খাও। মৃণাল পা দিয়ে একটা সদ্য পড়া বটফল পিষে ধরে। বেশ নতুন একটা খেলায় মত্ত যেন সে।
—তোমার একটুতেই রাগ-করা স্বভাবটা এখনও যায়নি দেখছি!
—অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়লাম। ভাবলাম একটু বেশিক্ষণ সময় এখানে কাটাতে পারব। অথচ তুমি কত দেরি করে এলে বলো তো?
—কী করব! মায়ের শরীরটা আজ ভালও নেই। নেহাতই তোমাকে বলে ফেলেছি আসব। তাই দৌড়তে দৌড়তে আসা।
—কতকাল পরে বেরুলে এভাবে?
—কী জানি! হিসাব রাখি না আর।
—ভাল আছ তো?
—কেমন দেখছ?
—দেখে কি সবকিছু বোঝা যায়?
—বুঝতে চেয়েছ কোনওদিন?
—আজ কিন্তু ঝগড়া করতে নয়, ঝগড়া মেটাতে এসেছি।
—হঠাৎ এত পরিবর্তন হল তোমার? কীভাবে?
—কেন তুমি ঝগড়া মেটাতে চাও না?
—মিটিয়ে কী হবে? আবার দু’দিন পর তো…
হঠাৎ মৃণাল কথার মাঝেই সুজাতার হাতটা চেপে ধরে— তুমি আমার ছিলে, আমার আছো, আর আমারই থাকবে— সুজাতা। এটাই আমার শুরুর ও শেষের কথা। তুমি আজও শুধু আমাকেই ভালবাসো তো, সুজাতা? কী গো, বাসো তো? বাসো বলেই আজ এভাবে এখানে ডাকতে এসেছ তো? কী গো, বলো? উত্তর দাও…
মাটিতে রক্তের মতো ছড়িয়ে থাকা লালচে-বেগুনি দাগগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সুজাতা। বিড়বিড় করে বলে, একবার দাগ তৈরি হয়ে গেলে আর কি মোছা যায়? অতই কি সহজ মুছে ফেলা? তুমিও কি পারলে? তখন তো কত কথা বলেছিলে। আমাকে ছাড়া দিব্যি বাঁচতে পারবে। কই, পারছ বলে তো দেখছি না। ঠিক আমাকে খুঁজে বার করে ফেললে!
—পারছি না তো। পারছি না বলেই তো ছুটে এসেছি।
—কিন্তু এভাবে এখানে আর কতক্ষণ বসবে?
কথাটা বলে এদিক-ওদিক চোখ ঘুরিয়ে দেখে সুজাতা।
—অনন্তকাল। অনন্তকাল ধরে বসে থাকব। তুমিও চাও না?
—তাহলে তো আমাদেরও ঝুরি নামবে।
—হ্যাঁ, নামবে তো। তারপর সেই ঝুরি মাটিতে প্রবেশ করবে আবার।
—বাচ্চা তো নও। অথচ, আচরণগুলো তোমার বাচ্চাদের থেকে আলাদা কিছু নয়। আমি বলে তাই সহ্য করেছি।
—সহ্য করলে কই? একবার রাগ করে খারাপ কথা বলায় চলে গেলে আমাকে ছেড়ে!
—একবার নয়। অনেকবার। তোমার স্মৃতিশক্তি কি সত্যি খারাপ হয়ে গেছে? নাকি ভান করছ?
—মানুষ যাকে ভালবাসে তাকেই তো খারাপ কথা বলে! যেমন মাকে। মাকেই তো খারাপ কথা বলা যায় সবচেয়ে বেশি। কারণ সে মা-ই তো। তোমাকেও তেমনটাই আপন ভেবেছিলাম। ভালবাসার অধিকারে ধরে নিয়েছিলাম তুমি আমায় বুঝবে! অথচ তুমি বুঝলে না। চলে গেলে।
—ও আমি যেতে চাইলাম! তুমি চলে যেতে বলোনি! তাহলে আটকালে না কেন?
—খুব রাগ চড়ে গেছিল মাথায়।
—বললাম না, তোমার রাগ আজও কমেনি। এতদিন পর দেখেও বুঝেছি। এতগুলো মৃত বটফল দেখেও বুঝছি।
মৃণালের মুঠো থেকে নিজের হাতটা মুক্ত করতে চায় সুজাতা— ছাড়ো। কেউ দেখে ফেলবে।
—দেখুক।
দু’জনেই চুপ হয়ে থাকে ওরা। যেন বটবৃক্ষের নিচে ধ্যানে মগ্ন যুগল। আড়ালে একটু একটু করে উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়ছে দু’জনের হৃদয়ের কোটরে। একসময় কতদিন একসঙ্গে এক ছাদের তলায় স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে থেকেছে ওরা। ডাল-ভাত-চচ্চড়ির মতো মিলেমিশে গেছে নিত্যদিনের ওঠাবসা। ভালবেসে কাছাকাছি এসেছে। আবার কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাঁটি করে দূরে ঠেলে দিয়েছে একে-অপরকে। তারপর দুম করে একদিন দু’জনেই সরে গিয়েছে দু’জনার থেকে।
—কি গো বললে না, আজও ভালবাসো তো আমায়?
—বাসি। যদি আবার সম্পর্কটা জোড়া লাগে সেই আশাতেই অসুস্থ মাকে ছেড়ে এলাম এখানে একবার ডাকতেই। ছেলেটা যে তুমি খারাপ নয়। ছিলে না কোনওদিনও। নেশাভাঙ করো না। বাড়ির বাইরে আড্ডা, অন্য মেয়েদের প্রতি ঝোঁক— কিছুই ছিল না তোমার। শুধু চণ্ডালের মতো রাগই তোমাকে শেষ করে দিল।
—একা থেকে কী দেখলে?
—আমাদের মতো মানুষের পক্ষে একা থাকাটা খুব কষ্টের। প্রতিদিন হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছি। মায়ের পেনশনের টাকাটাও বন্ধ হয়ে গেলে কীভাবে চলবে সেই দুশ্চিন্তায় ভুগেছি। এই বয়সে পৌঁছে আবার নতুন করে প্রেম, বিয়ে, কী চাকরি— কিছুই যে হওয়ার নয়। সবচেয়ে বড় কথা, তোমাকে যে বড্ড ভালবাসি। দূরে সরে এসে সেটা টের পেয়েছি সবথেকে বেশি।
—তাহলে রাগ যে তোমারও কিছু কম নয়, সুজাতা, নিজেও সেটা বোঝো তো? সম্পর্কের তার ছিঁড়ে যাওয়ার দোষ শুধু যে আমার একার নয়, মানো নিশ্চয়ই? মানুষ পাশে থাকলে তার মূল্য টের পাওয়া যায় না। তুমি দূরে যেতেই আমিও নিজের ভুলগুলো বুঝতে পেরেছি। আমার জীবনে তোমার গুরুত্ব অনুভব করেছি। কিন্তু ততদিনে তুমি মাকে নিয়ে বহুদূরে চলে গেছ। যোগাযোগ করার সব পথও বন্ধ করে দিয়েছিলে। কী ভয়ানক কষ্ট পেয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না। আমি ভাবিনি আবার কখনও তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারব। আজ যে আমার কত বড় আনন্দের দিন…
—হয়তো আমাদের মধ্যে এটারই দরকার ছিল। সবকিছুর মাঝেই আসলে বিরতির প্রয়োজন আছে। আমাদের সম্পর্কের মধ্যেকার দীর্ঘ বিরতিও নিশ্চয়ই… এই নাও ধরো, বলে ব্যাগ থেকে একরাশ না-পাঠানো চিঠি তুলে ধরল সুজাতা মৃণালের দিকে।
—পাঠাওনি কেন এগুলো? এত ভালবাসো! তাও এমনটা করতে পারলে?
পকেট থেকে একটা ছোট নতুন মুঠোফোন বের করে মৃণালও ভরে দিল সুজাতার মুঠোয়।
—এটা ধরো। এবার থেকে আমাদের রোজ কথা হবে। মাকে গিয়ে আজই খুশির খবরটা দিও, তুমি তোমার নিজের সংসারে আবার ফিরে আসবে।
—ভেবে দেখেছ? দুনিয়ার বহু বহু সংসারের মতো আমাদের সংসারটাও ভাঙতে বসেছিল! দাগ প্রায় লেগে গেছিল বলতে গেলে…
একটা বটফল মৃণালের সাদা জামার বুকের উপর পড়ে ধীরে ধীরে গড়িয়ে যায় মাটির দিকে।
মৃণাল তাকায়। আঙুল বোলায় দাগটায়। এক অদ্ভুত স্বরে বলে, কুছ দাগ আচ্ছে হোতে হ্যায়।

আরও পড়ুন-ভূগর্ভের গভীর থেকে অতীতের ডাক বাসুকি ইন্ডিকাসের কাহিনি

Latest article