সন্তানদের অনেককে তো দেখি নিজেদের ভুলত্রুটি অপরাধের ইয়ত্তা নেই, তবু তারা চায় বউ-ঝিরা তাদের কাছে নত হয়ে থাকুক। এই অন্যায়ের ফলে যে দিন আসছে, মেয়েরা আর পৃথিবীর মতো সইবে না— এই উক্তি যখন হচ্ছে ভারত তখন পরাধীন। স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন চলছে। মেয়েরাও এগিয়ে আসছে সেই সংগ্রামে অংশ নিতে। সালটা ১৯১৭। যুগান্তর বিপ্লবী দলের তিন স্বাধীনতা সংগ্রামী অমর চট্টোপাধ্যায়, কুন্তল চক্রবর্তী ও ভূপেন্দ্রকুমার দত্তর সন্ধান চলছে। তাঁরা পলাতক। কলকাতা পুলিশ গোপন সূত্রে জেনে গেল, তিলজলা রেলওয়ে কেবিনের কর্মী দেবেন ঘোষ ও তাঁর স্ত্রী সিন্ধুবালা দেবীর আশ্রয়ে রেলওয়ে কোয়ার্টার্সে লুকিয়ে রয়েছেন এই তিন বিপ্লবী। পুলিশ যখন অভিযানে গেল ততক্ষণে তিনজনই পালিয়েছেন।
পুলিস দেবেন ঘোষকে গ্রেফতার করল। দোষী তাঁর স্ত্রীও। কিন্তু তিনি কলকাতায় নেই। চলে গিয়েছেন বাঁকুড়ার ইন্দাসে। গ্রামের নাম যূথবিহার। খবর পাঠানো হল বাঁকুড়া পুলিশে, এই মহিলাকে গ্রেফতার করতে হবে। পুলিশ সুপার ভোলানাথ চট্টোপাধ্যায় বিরাট ফোর্স নিয়ে অভিযানে গেলেন এক নারীকে গ্রেফতার করতে। সমস্যা হল, একজন নয়। দু’জন সিন্ধুবালা আছেন পাশাপাশি গ্রামে। একজন দেবেনবাবুর স্ত্রী এবং অন্যজন আবার তাঁরই বোন। কাকে গ্রেফতার করা হবে? কেউ মুখ খুলছে না কে কোনজন! অতএব দু’জনকেই গ্রেফতার করা হল। একজনকে সাবাজপুর থেকে। অন্যজনকে যূথবিহার থেকে। শুধু গ্রেফতার নয়। সঙ্গে জিপ থাকা সত্ত্বেও দুই নারীকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে পুলিশ স্টেশন পর্যন্ত আনা হয়। তারপর বাঁকুড়া জেলে বন্দি। গোটা ঘটনাটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। কারণ, সিন্ধুবালা দেবী ছিলেন গর্ভবতী। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার জন্যই তিনি এসেছিলেন বাপের বাড়ি (ভিন্ন তথ্য অনুযায়ী স্ত্রী নয়, বোন ছিলেন অন্তঃসত্ত্বা)। এরকম অবস্থায় সেই দুই নারীকে এভাবে হাঁটিয়ে নিয়ে আসায় বিপুল প্রতিবাদ হল।
এই সংবাদ যখন লোকমুখে প্রচারিত হয়ে জয়রামবাটিতেও পৌঁছয়, মা ঘটনাটি শুনে নিমেষের মধ্যে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়েন। সংবাদবাহককে তিনি বলেন, ‘‘বলো কী? এটা কি কোম্পানির আদেশ? না পুলিশ সাহেবের কেরামতি? নিরপরাধ স্ত্রী লোকের উপর এত অত্যাচার মহারানি ভিক্টোরিয়ার সময় তো কই শুনিনি?’’ সারদা মায়ের ক্রোধের সংবরণ হচ্ছে না। তাঁর নিজের শরীর তেমন সুস্থ নেই সেই সময়। তা সত্ত্বেও তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছেন এই দমন পীড়ন। আরও বললেন, ‘‘এই যদি কোম্পানির আদেশ হয়, তো, আর বেশি দিন নয়। এমন কোনও বেটাছেলে কি সেখানে ছিল না, যে দু’চড় দিয়ে মেয়ে দু’টিকে ছাড়িয়ে আনতে পারে?’’ কিছু পরে যখন আবার সংবাদ এল যে, মহিলারা মুক্তি পেয়েছেন, তখন তিনি স্বস্তি পেলেন। শান্ত হলেন। বললেন, ‘‘এই খবর যদি না পেতুম, তবে আজ আর ঘুমুতে পারতুম না।’’
কে এই মা যাঁর অপরিচিত দুই নারীকে নিয়ে এত চিন্তা? তিনি আপাতদৃষ্টিতে কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী নন। অথচ মহিলাদের প্রতি পুলিশের এই নির্যাতন শুনে রাগান্বিত? একবারও বললেন না তো অন্য মানুষদের মতো কী দরকার ছিল এমন ঝুঁকি নেওয়ার?
এই মা ঠাকুরণ কে? তিনি রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামাসুন্দরীদেবীর কন্যা সারদাদেবী। জন্ম ২২ ডিসেম্বর। তিনি ছ’বছর বয়স থেকে রামকৃষ্ণ জায়া, বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠিত বেলুড় মঠের সংঘ প্রধানা, বিশ্ব যাঁকে চিনেছে ‘মা’ হিসেবে, যিনি ‘সতেরও মা, অসতেরও মা’ রূপে।
আরও পড়ুন-এখনই নির্দল কাউন্সিলরদের দলে নিতে চান না তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো
সারদা মায়ের ছোটবেলা কাটে জয়রামবাটি ও কামারপুকুরে। সে সময় স্ত্রীশিক্ষার কথা গ্রাম সমাজ কেন, শহরেও ভাবা হত না। মেয়েরা পড়লে বিধবা হবে, দুর্ভোগ নেমে আসবে সংসারে—এই বোধ সমাজের প্রতি স্তরে প্রবাহমান। তার মধ্যেও গ্রামাঞ্চলে গুটিকয়েক নারী গোপনে পড়া জারি রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। সারদা মা তেমনই একজন। তিনি নিজেই বলছেন, “কামারপুকুরে লক্ষ্মী আর আমি ‘বর্ণপরিচয়’ একটু একটু পড়তুম। ভাগনে (হৃদয়) বই কেড়ে নিলে; বললে ‘মেয়ে-মানুষের লেখাপড়া শিখতে নেই; শেষে কি নাটক-নভেল পড়বে।’ লক্ষ্মী তার বই ছাড়লে না, ঝিয়ারী মানুষ কিনা, জোর করে রাখলে। আমি আবার গোপনে আর একখানি এক আনা দিয়ে কিনে আনালুম। লক্ষ্মী গিয়ে পাঠশালায় পড়ে আসত, সে ঘরে এসে আবার আমায় পড়াত।”
এই বিদ্যোৎসাহ তাঁর পরেও ছিল। তিনি বলছেন— “ভাল করে শেখা হয় দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর তখন চিকিৎসার জন্য শ্যামপুকুরে। একাটি একাটি আছি। ভব মুখুজ্যেদের একটি মেয়ে আসত নাইতে। সে মধ্যে মধ্যে অনেকক্ষণ আমার কাছে থাকত। সে রোজ নাইবার সময় পাঠ দিত ও নিত। আমি তাকে শাক পাতা, বাগান হতে যা আমার এখানে দিত, তাই খুব করে দিতুম।” অর্থাৎ মা গুরুদক্ষিণা দিতে ভুলছেন না তাঁর শিক্ষয়ত্রীকে।
নিজে এত কষ্ট করে পড়েছেন বলেই নারীশিক্ষার ও নারীর সমান অধিকারের বিষয়ে এত দৃঢ় মত ছিল তাঁর। না চাইতেন মেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াক। গৌরী মা বা নিবেদিতার স্কুল নিয়ে তাঁর আগ্রহের শেষ ছিল না। স্কুল হলে মেয়েরা পড়াশোনা শিখবে, শিখবে হাতের কাজও, যা দিয়ে পরবর্তীকালে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে মেয়েরা। কারণ তিনি বিশ্বাস করছেন স্বাবলম্বিতা ছাড়া মেয়েদের স্বাধীনতা কখনও আসবে না। এক স্ত্রীভক্ত মেয়ের বিয়ে দিতে না পারায় দুঃখ প্রকাশ করলে তাই মা বলছেন, “বে দিতে না পার, এত ভাবনা করে কী হবে? নিবেদিতার স্কুলে রেখে দিও। লেখাপড়া শিখবে, বেশ থাকবে।” এই প্রসঙ্গেই অনিবার্য হিসেবে বাল্যবিবাহর কথা আসে। পরম বিস্ময়ে লক্ষ করি মা ছিলেন এর তীব্র সমালোচক। নিজের যেমন জ্ঞানস্পৃহা ছিল, তেমনি ছিলেন অল্প বয়সে বিয়ের বিরুদ্ধে। নিবেদিতার স্কুলে দুটি মাদ্রাজি বয়স্ক কুমারী মেয়েকে দেখে একই সঙ্গে মা খুশি ও দুঃখিত হয়ে বলেছিলেন, “আহা, তারা কেমন সব কাজকর্ম শিখছে! আর আমাদের! এখানে পোড়া দেশের লোকে কি আটবছরের হতে না হতেই বলে, ‘পরগোত্র করে দাও,পরগোত্র করে দাও!’ আহা! রাধুর যদি বিয়ে না হত তা হলে কি এত দুঃখ-দুর্দশা হত?”
নারীর দুঃখ-দুর্দশা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। তিনি সব সময় তাই নারীশিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। নারীর ভাগ্য বিপর্যয়ের জন্য শুধু ভাগ্যদেবতা বা ভগবানের নামে দোষ দিলে হবে না। নিজেকেই খণ্ডাতে হবে সেই বিধান। এ তাঁর গলায় বারবার উঠে এসেছে।
তিনি যে যুগের থেকেও এগিয়ে আধুনিক নারী ছিলেন তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি বহুবার। প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা তাঁর কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নিবেদিতা বলেছিলেন— “আমার কাছে তাঁর অধ্যাত্মমহিমার মতোই অপূর্ব ঠেকেছিল তাঁর সম্ভ্রান্ত সৌজন্যের সৌন্দর্য, তাঁর উদার মুক্ত মনের মহিমা।” এই মুক্ত মনটাই তাঁকে আধুনিক করে তুলেছিল, যা আজও আমাদের চিন্তা করতে বাধ্য করে সত্যি স্বাধীনতা মানে কী! অর্থনৈতিক, এবং শিক্ষার অধিকার পেলেই কি সে অর্থে স্বাধীনতা আসে? নাকি যথার্থ শিক্ষা ও স্বাধীনতার খোঁজে আজও আমরা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে! বলতে বাধ্য হচ্ছি, মহিলারা শিক্ষা রাজনীতি ও প্রশাসনের নানা ক্ষেত্রে বিশেষ স্থান নিলেও, এই জাগ্রত নারীজাতি সমগ্র মানব জাতির পরবর্তী বিবর্তনে বিশিষ্ট ভূমিকা নেবে এবং মা সারদা হয়ে উঠছেন সেই আলোকবর্তিকা।
না, তাঁকে মিছিল, মিটিং, আন্দোলন করে নারী জাতির শক্তি প্রকাশের দাবি জানাতে দেখিনি, কিন্তু গৃহের কোণে থেকেও কীভাবে তিনি শক্তিরূপিণী মহামায়া হয়ে উঠলেন তা আজও বিস্মিত করে। আর এখানেই তিনি, যখন দেশে আঠারো থেকে একুশে মেয়েদের বিয়ের কথা আইন করে বলার কথা ভাবা হচ্ছে, তখন সমান প্রাসঙ্গিক। বিয়ে নয়, মেয়েদের শিক্ষা ও নিজের পায়ের স্বাধীনতাই একমাত্র দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
শেষ করার আগে একটি বিষয়ের উল্লেখ করছি। স্বামী বিবেকানন্দ একবার এক চিঠিতে তাঁর গুরুভাইকে লিখেছিলেন, ‘মা-ঠাকুরণ কী বস্তু বুঝতে পারনি, এখনও কেহই পার না, ক্রমে পারবে। ভায়া, শক্তি বিনা জগতের উদ্ধার হবে না।… মা-ঠাকুরণ ভারতে পুনরায় সেই মহাশক্তি জাগাতে এসেছেন, তাঁকে অবলম্বন করে আবার সব গার্গী মৈত্রেয়ী জগতে জন্মাবে।”
তাঁর এই ভাবনা যে কতটা সঠিক ছিল আজ শুধু বাঙালি নয়, ভারতীয় নয়, দেশের সীমানা ছেড়ে মা এখন বিশ্বজনীন, পৃথিবীর যে প্রান্তেই দেখি না কেন তিনি সমস্ত পৃথিবীর মা হয়ে উঠেছেন। আর এখানেই তাঁকে নতুন করে জানার প্রয়োজন।