প্রসাধনী বা কসমেটিক্স শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ kosmeticos থেকে, খ্রিস্টীয় সতেরো শতকে। গ্রিকরাই এই শিল্পকে দিয়েছে এক অন্য মাত্রা। গ্রিক সৌন্দর্যের ও প্রেমের দেবী ছিলেন আফ্রোদিতি (Aphrodite)। বলা হয়ে থাকে তাঁর আশীর্বাদেই গ্রিকরা রূপ ও সৌন্দর্যের আধার।
পরবর্তীকালে রোমানরা এক্ষেত্রে অনেক অবদান রাখেন। ধীরে ধীরে সভ্যতার ক্রমবিকাশ ঘটার ফলে মধ্যপ্রাচ্য চিন-জাপান ইউরোপ-আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার-সহ অন্যান্য দেশে প্রসাধন শিল্পের বিস্তার ঘটে।
প্রাচীন রোমে নানা ধরনের সুগন্ধী তৈরি করা হত। জলপাই ও আঙুরের রস থেকে তৈরি অন ফেসিওড ছিল পারফিউমের মূল উপাদান আর সেই পারফিউমকে রঙিন করতে মেশানো হত নানা রং। সাদা দাঁত রাখার জন্য রোমানরা হাড়ের ছাই দিয়ে টুথপেস্ট তৈরি করত।
রোমের কিংবদন্তি অনুসারে— সম্রাট নিরোর স্ত্রী সৌন্দর্যচর্চায় (Make-up) এত বেশি পরিমাণে দুধ ব্যবহার করতেন যে তিনি যখনই ভ্রমণে যেতেন তখন গাধার একটি বাহিনী তাঁর সঙ্গে যেত। অর্থাৎ গাধার দুধে তিনি স্নান করতেন এবং তাঁর রূপচর্চা সারতেন। রাজ পরিবারের কথা বাদ দিলেও সমাজের নারীরাও ছিলেন খুব সৌন্দর্য সচেতন।
সুন্দর চুলের জন্য অদ্ভুত সব কাণ্ড করতেন। ব্রোঞ্জের রডকে হালকা গরম করে তা দিয়ে চুল কোঁকড়া করতেন। সঙ্গে অলিভ অয়েল ব্যবহার করতেন। সেসময় স্বর্ণকেশী এবং লাল চুলের খুব চাহিদা ছিল। এই রং তৈরি হত ছাই, জাফরান, শাকসবজি এবং প্রাণিজ পদার্থ থেকে।
চুলের পাশাপাশি চোখের সৌন্দর্যেও তাঁরা যত্নবান ছিলেন কাঠকয়লার ছাই দিয়ে ধূসর কাজল পাউডার চোখের উপরে দিতেন। যাতে চোখ বড় উজ্জ্বল দেখায়।
তৎকালীন মিশরের রানি রূপচর্চা (Make-up) ও সর্বজনবিদিতই শুধু নয়, বহু আলোচিত এবং আলোড়িত। গাধার দুধ আর গোলাপের পাপড়ি দিয়ে স্নান ছাড়াও মৌচাকের মোম, গোলাপের তেল, সামুদ্রিক লবণ, মধু, ডিম ও এক বিশেষ ভেষজ গাছের পাতার রস মিশিয়ে তৈরি হত তাঁর ফেস মাস্ক। ভিনিগারে ভেজানো টুপে সেরিয়াম নামে এক শিকড় যা থেকে তিনি দিতেন গালে লাল রং।
প্রাচীন মিশরে ত্বককে উজ্জ্বল করতে ল্যাভেন্ডার রোজমেরি গন্ধরাজ ফাহিম লিলি গোলাপ প্রভৃতি ফুলের নির্যাস ব্যবহারের প্রচলন ছিল।
সৃষ্টির আদি থেকেই সৌন্দর্যের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কীভাবে আরও সুন্দর হয়ে ওঠা যায়। সময় বদলেছে, বদলেছে দৃষ্টিভঙ্গি, সঙ্গে এসেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নানা আবিষ্কার প্রসাধন সামগ্রীর উপর। উনিশশো সালে অভূতপূর্ব জায়গা ন্যায় প্রসাধনের শিল্প। প্রকৃতি থেকে নেওয়া বিভিন্ন মূল্যবান উপাদানই ছিল সৌন্দর্যচর্চার চাবিকাঠি।
ভারতীয় উপমহাদেশের রূপচর্চার (Make-up) ইতিহাস সুপ্রাচীন। মুঘলরা প্রসাধন চর্চায় এনেছিল নব জোয়ার। মোগলসম্রাজ্ঞী নুরজাহানের ছিল অনেক গুণ। তিনি ছিলেন রূপবতী গুণবতী, সুরুচিসম্পন্না। সাজগোজ এবং প্রসাধন তাঁর খুব পছন্দের ছিল। নতুন নতুন সুগন্ধী তৈরি করাতে ছিল তাঁর নেশা। বিভিন্ন দুর্লভ ফুল থেকে নির্যাস নিয়ে তৈরি করতেন সেইসব সুগন্ধী। অতীতকালে থেকে নানা ধরনের রূপচর্চার ধরন বদলেছে।
প্রাচীন ভারতের কবির বর্ণনায় আমরা পাই যে, একসময় নারীরা কানে চাঁদের মতো তালপাতার গয়না পড়তেন। হাতে সোনার বাজু, গন্ধ তেল চুল ভিজিয়ে মাথায় চুল চুড়ো করে বাঁধা আর তাতে জড়ানো হত সুগন্ধী ফুলের মালা।
আবার গৌড়ের নারীরা মুখে ভিজে চন্দন, গলায় সুতোর হার, সিঁথি পর্যন্ত শিরোবসন আর অগুরু চন্দনের সুগন্ধী দিয়ে নিজেদের রূপচর্চা সারতেন।
দামোদর দেবের ‘চট্টগ্রাম লিপি’তে সেকালের নারীদের চোখে কাজল ও প্রসাধনে কর্পূর ব্যবহারের ইঙ্গিত আছে।
আবার খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে ত্বক পরিষ্কারের জন্য সাবানের জায়গায় পিস্ট (বাটা) অর্থাৎ আমলকীর ব্যবহার ছিল।
আরও পড়ুন- কেয়ার অব শীত
প্রাচীন আয়ুর্বেদ শাস্ত্রেও ‘পুষ্প আয়ুর্বেদ’ নামে একটি অধ্যায় আছে। সেখানে বলা আছে বিভিন্ন ভেষজ ফুল দিয়ে ত্বকের নানা সমস্যার সমাধানের কথা। ইতিহাসের পাতা বেয়ে এবার হেঁটে আসি সাবেককালের রূপচর্চার কথায়। অভিজাত পরিবারের কথা বলতেই হয়। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির মহিলারা রূপচর্চার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। সারদাসুন্দরী তাঁর প্রত্যেক সন্তানকে নিজের হাতে নানারকম কিছু মাখিয়ে ত্বকের যত্ন করতেন। ঠাকুরবাড়ির কন্যা শরৎকুমারী রূপটান মেখে জলে সাঁতার কেটে সময় কাটাতেন। মহিলারা সন্ধে হলে রকমারি খোঁপা আর তাতে ফুলের মালা দিয়ে সাজবেন, এমনটাই ছিল রীতি। রবি ঠাকুরের দিদি সৌদামিনী রকমারি খোঁপা বেঁধে দিতেন। কুন্তলীন তেল মাখার রেওয়াজ ছিল।
আবার ধুনোর ধোঁয়ায় চুল শুকনোর রীতি ছিল।
ঠাকুরবাড়ির নারীরা এতটাই সুন্দর দেখতে ছিলেন যে কৌতূহলী বাইরের লোকজনের জিজ্ঞাসা ছিল, তাঁরা এমন সুন্দর হতেন কীভাবে? জনশ্রুতি, ঠাকুরবাড়িতে শিশু জন্মানোর পর দুধ আর মদ দিয়ে তাকে স্নান করানো হত।
মেয়ে-বউরা রূপসজ্জায় এতটাই নিপুণ ছিলেন যে তাঁদের সৌন্দর্য ছিল অতুলনীয়। আলতা পরা, আতর মাখা ফুলের সাজ এসবে অভ্যস্ত ছিলেন তাঁরা।
১৯১০ সালে ইউরোপ ও আমেরিকায় ব্যাপক প্রসার ঘটে প্রসাধন সামগ্রীর। অভিজাত শ্রেণির ব্যবহারের জন্য। ১৯২০তে বলিউড ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সাড়া জায়গায় মেকআপের খুঁটিনাটি বিষয়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রূপচর্চা (Make-up) বা সাজ-সজ্জার নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমূল পরিবর্তন ঘটে।
গত শতকে পার্লারের রূপচর্চার প্রতিষ্ঠানের তেমন চল ছিল না। কিন্তু একালে শহরে তো বটেই, গ্রামে-গঞ্জে সবজায়গাতেই বিউটি পার্লারের রমরমা।
অল্প বয়স থেকে বেশি বয়স— সবার উপস্থিতি সেখানে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত সবারই পছন্দের জায়গা।
এককালে কেবল বিত্তবানেরাই পোশাকে-আশাকে, সাজে, সজ্জায় সুগন্ধী ব্যবহারে সৌন্দর্যের প্রকাশ করতেন। একালে চুল, ত্বক, মুখ, হাত-পা অর্থাৎ সমস্ত অঙ্গের জন্য আলাদা আলাদা বোতলবন্দি রূপচর্চা সামগ্রী কিনতে পাওয়া যায়। কখনও শুনেছি কি আমরা যে অ্যাসিডও রূপচর্চায় (Make-up) ব্যবহৃত হয়!
এই উত্তর আধুনিক সময়ে কিছু কিছু বিশেষ অ্যাসিড রূপচর্চায় বয়স ধরে রাখায় যুগান্তকারী অবদান রাখছে। তার মধ্যে রেটিনল অন্যতম। ত্বকের যত্নে এখন নিয়াসিনামাইড, হ্যাইলুরনিক— এই সমস্ত অ্যাসিড ত্বককে তরতাজা তো রাখবেই, পাশাপাশি বয়সের গণ্ডিও পেরোতে দেবে না। অভাবনীয় ব্যাপার!
একটা সময় কেশচর্চার সামগ্রী ছিল তেল। আজকের দিনে তেলের সেরকম চল নেই বরং সেই জায়গায় দখল করেছে সেরাম নামক বস্তু। চুল নরম রাখা, ডগা না-ফাটা এবং চুলের বৃদ্ধিতেও ভীষণভাবে সহায়ক। বিজ্ঞানের নিত্য-নতুন আবিষ্কার সাজগোজের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে।
এখন বিয়ের কনে আগেকার দিনের মতো পরিবারের বা পরিচিত যিনি ভাল আঁকেন এবং ঘরোয়া সাজানোতেও পারদর্শী, তাঁর কাছে সাজে না। ক্রমে বিউটিশিয়ান থেকে মেকআপ আর্টিস্ট সেই জায়গা নিয়েছেন।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে ত্বকের যত্নের পাশাপাশি ফেসিয়াল এখন সর্বজনবিদিত। ফ্রুট ফেসিয়াল, গোল্ড ফেসিয়াল, পার্ল ফেসিয়াল, প্লাটিনাম ফেসিয়াল অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ফলমূল, মুক্তো, সোনা-সহ বিভিন্ন ধাতু এখন রূপচর্চায় জায়গা করে নিয়েছে। ত্বককে তরতাজা রাখায় এসবের জুড়ি মেলা ভার। আরও একটি অত্যাধুনিক ফেসিয়ালের অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে। সেটা হল হাইড্রা ফেসিয়াল। সেখানে সর্বাধুনিক ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ পদ্ধতিতে চিরনবীন ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখা হচ্ছে।
তাহলে দেখা গেল, মানুষের সৌন্দর্য পিপাসা চিরন্তন। ভোরের আকার আকুল বাসনা মানুষের মনে চিরকাল ধরেই আছে। সুন্দরী পূজারী শুধু কাব্য-কবিতার কবিরাই নয়, বিশ্বমানব-মানবী, সবারই ইচ্ছা বা চেষ্টা তাঁকে নিজেকে সুন্দর করে গড়ে তোলার।
কালের সময় পেরিয়ে তার দুরন্ত ভোলবদল ঘটেছে মাত্র।