ফুলের মালা

১৯৫০-এর দশকের শুরু থেকে ১৯৭০-এর দশকের শেষভাগ পর্যন্ত হিন্দি এবং বাংলা চলচ্চিত্রে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন তিনি। ‘ধুল কা ফুল’ ছবি দিয়েই হয়েছিলেন প্রথমসারির অভিনেত্রী। যাঁর সহজাত সৌন্দর্য এবং অভিনয় প্রতিভায় মুগ্ধ হয়েছিল আপামর দর্শক। তিনি ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্বর্ণযুগের নায়িকা মালা সিনহা। নভেম্বরে পড়লেন ৮৮-তে। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

আশৈশবে
ছোট থেকেই নাচ-গান-অভিনয়ে পারদর্শী ছিলেন। শুনতে একটু অন্যরকম লাগলেও শৈশবে তাঁর আদরের ডাকনাম ছিল আলদা বা আলডা। স্কুলে ভর্তি হবার পর সহপাঠীরা সেই নাম জানার পর থেকে তাঁকে ব্যঙ্গ, কটূক্তি ‘ডালডা’ বলে ঠাট্টা-তামাশা করত। আলডা থেকেই নাম হয়ে যায় ‘ডালডা’। কিন্তু সেই ব্যঙ্গ কটূক্তিতে কান দেননি কখনও। নেপালের মেয়ে আলদার সবটা জুড়ে কিন্তু ছিল এই শহর কলকাতা। তাঁর বাবা আলবার্ট সিনহা ছিলেন নেপালের বাসিন্দা। কিন্তু তাঁর জন্মের আগেই কলকাতায় চলে আসেন। তিনি ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির স্বর্ণযুগের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মালা সিনহা (Mala Sinha)।

বেবি নাজমা থেকে ষোড়শী
১৯৪৬ সালে ‘জয় বৈষ্ণ দেবী’ সিনেমায় শিশুশিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন মালা। এই সময় থেকে বেবি নাজমা নামে বেশ পরিচিতি পান তিনি। শিশুশিল্পী হিসেবে তখন আরও বেশ কিছু পৌরাণিক ছবিতে কাজ করেন। যেমন শ্রীকৃষ্ণলীলা’, ‘যোগবিয়োগ’, ‘ঢুলি’ ইত্যাদি ছবিতে বেবি নাজমা নামেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন।
একবার স্কুলের একটি নাটকে আলদার অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়ে যান পরিচালক অর্ধেন্দু বসু। তিনি তখন আলদার বাবা আলবার্ট সিনহার কাছ যান। ওই মেয়েকে দিয়ে নিজের ছবিতে অভিনয় করানোর জন্য বাবার অনুমতি নিয়ে তাঁকে ১৯৫২ সালে ‘রোশেনারা’ ছবির নায়িকা হিসেবে নির্বাচন করলেন। এ বার বেবি নাজমা থেকে তিনি হলেন মালা।

মুম্বই পাড়ি
ষোড়শী মালার অভিনয়ের এই যাত্রাপথ কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।
‘আয়নায় নিজেকে দেখেছ কখনও? এই চেহারা নিয়ে নায়িকা হতে চাও?’ একবার এক প্রযোজক তাঁকে বলেছিলেন এমন কথা। যে অপমান জীবনভর মনে রেখেছিলেন তিনি। দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে তাঁকে ভুল প্রমাণ করেই তবে ছেড়েছিলেন।
এরপরে বেশকিছু বাংলা ছবিতে অভিনয় করেন মালা। যদিও বাংলা ছবিতে বেশিদিন অভিনয় করেননি মালা। কেরিয়ারের শুরুর দিকেই একবার শ্যুটিংয়ের সূত্রে মুম্বই পাড়ি দেন মালা। অধুনা মুম্বই সেকালের বম্বেতে। ওখানে থাকার সময় গীতা বালির তাঁকে খুব পছন্দ হয় আর সেই সূত্র ধরেই কেদার শর্মার সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। কেদার শর্মা মালাকে তাঁর ছবি ‘রঙ্গিন রাত’-এর জন্য নির্বাচন করেন। সালটা তখন ১৯৫৪। এরপর মালা সুযোগ পেলেন সেই সময়ের নামী অভিনেতা প্রদীপকুমারের বিপরীতে কাজ করার। মালা সিনহা এবং প্রদীপকুমারের প্রথম হিন্দি ছবি ছিল ‘বাদশা’। এরপরে ‘হ্যামলেট’ ছবিটিও করলেন যদিও দুটো ছবিই ব্যর্থ হয়।

অভিনয়ের টার্নিং পয়েন্ট
এরপর ১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় গুরু দত্তের ছবি ‘প্যায়াসা’। এই ছবিটাই ছিল অভিনেত্রী হিসেবে মালার (Mala Sinha) জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। বলিউডি ইন্ডাস্ট্রিতে মাইলফলক তৈরি করে ‘প্যায়াসা’। মধুবালার কথা ভেবে তৈরি হয়েছিল এই ছবিতে মালার চরিত্রটি। কিন্তু মধুবালা অভিনয় করেননি। তখন এই চরিত্রে অভিনয়ের সুয়োগ পান মালা যে সুযোগ তিনি হাতছাড়া করেননি। অভিনয়ে জানপ্রাণ লাগিয়েছিলেন।
একবছরের মধ্যে সেই সময়কার নামী-দামি অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করে নিজের অভিনয় প্রতিভার পরিচয় দিলেন মালা। রাজকাপুরের বিপরীতে ‘পারবারিশ’, ‘ফির সুবহ হোগি’, দেব আনন্দের বিপরীতে ‘লাভ ম্যারেজ’, শাম্মি কাপুরের বিপরীতে ‘উজালা’ ছবি করে পেলেন জনপ্রিয়তা।
রমেশ সায়গলের পরিচালনায় তৈরি ‘ফির সুবহ হোগি’ ছবিটা তৈরি হয়েছিল দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’-এর অনুসরণে। এই ছবিতে অভিনয় করে ইন্ডাস্ট্রিতে মালা পরিচিত হন বহুমুখী নায়িকা হিসেবে।

আরও পড়ুন- শিশু দিবসের ভোরে পাহাড়ে চেনা ছন্দে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়

প্রথম সারিতে
১৯৫৯-এ বি আর চোপড়ার ‘ধুল কা ফুল’ ছবিটা করে প্রথমসারির নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেলেন। এরপর বি আর চোপড়ার ‘ধর্মপুত্র’, ‘গুমরাহ’ ছবিতে অভিনয় করেন। পাঁচ ও ছয়ের দশকে বলিউডে একের পর এক সুপারহিট ছবি উপহার দিয়েছেন মালা (Mala Sinha)।
সমালোচকদের মতে তাঁর অভিনীত সেরা ছবিগুলির মধ্যে ‘বহুরানি’, ‘গুমরাহ’, ‘গেহরা দাগ’, ‘আপনে হুয়ে প্যায়ারে’, ‘জাহান আরা’ অন্যতম। কেরিয়ারের প্রথম থেকেই ছকভাঙা ভূমিকায় অভিনয় করতে ভালবাসতেন মালা। ‘ধুল কা ফুল’, ‘অনপড়’, ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’, ‘আঁখে, ‘বাহারেঁ ফির ভি আয়েঙ্গি’, ‘মেরে হুজুর’-এর মতো নারীকেন্দ্রিক ছবিতে মালা সিনহার অভিনয় আজও মনে রেখেছেন পুরনো ছবির দর্শক।
বাংলা ছবির মালা
মুম্বই যাওয়ার পরে কলকাতাকে ভুলে যাননি মালা। ‘লুকোচুরি’, ‘সাথীহারা’, ‘খেলাঘর’, ‘শহরের ইতিকথা’র মতো ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। উত্তমকুমারের সঙ্গে সাতটি ছবি করেছেন মালা সিনহা। যার সবগুলো মনে রাখার মতো। তাঁর অভিনীত প্রতিটি বাংলা ছবি উজ্জ্বল হয়ে আছে অসাধারণ অভিনয়ে। ১৯৭৭ সালে মুক্তি পায় তাঁর শেষ বাংলা ছবি ‘কবিতা’। রঞ্জিত মল্লিক-কমল হাসান-মালা সিনহা অভিনীত এই ছবি বক্সঅফিসে সুপারহিট হয়।

তাঁর দুই প্রজন্মের নায়কেরা
প্রবীণ এবং নবীন, দুই প্রজন্মের নায়কদের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করেছিলেন মালা সিনহা। একাধারে রাজ কাপুর, দেব আনন্দ, কিশোরকুমার, প্রদীপকুমার, গুরু দত্তের মতো অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করেছেন দক্ষতার সঙ্গে আবার অন্যদিকে শাম্মি কাপুর, রাজেন্দ্রকুমার, রাজকুমারের মতো সমসাময়িক নায়কদের সঙ্গেও চুটিয়ে কাজ করেছেন মালা।
আবার মনোজকুমার, ধর্মেন্দ্র, রাজেশ খান্না, সুনীল দত্ত, সঞ্জয় খান, জিতেন্দ্র, অমিতাভ বচ্চন প্রমুখ নবাগত নায়কদের সঙ্গেও ভাল ভাল ছবি করেছেন মালা।

গায়িকা মালা
ছোট থেকেই নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন আকাশবাণীতে। অল ইন্ডিয়া রেডিওর তালিকাভুক্ত গায়িকা ছিলেন মালা।
তাঁর গানের গলাটি ছিল ভারী সুন্দর। কিন্তু কোনওদিন প্লেব্যাকে করার সুযোগ পাননি। নিজের ছবিতেও মাত্র একবারই গান করেছেন। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ললকার’ ছবিতে মালার লিপে তাঁর নিজের গান আছে।

ব্যক্তিজীবন
মালা সিনহার একমাত্র নেপালি ছবি ‘মৈতিঘর’ মু্ক্তি পায় ১৯৬৬ সালে। এই ছবি করতে গিয়ে মালার আলাপ হয় নেপালি নায়ক চিদম্বরম প্রসাদ লোহানির সঙ্গে। সাতের দশক থেকে ধীরে ধীরে অভিনয় কমিয়ে দেন মালা। তাঁর শেষ ছবি ‘জিদ’ মুক্তি পায় ১৯৯৪ সালে। সারাজীবনের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৮ সালে তিনি পেয়েছিলেন লাইফ টাইম আচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড৷ মালা সিনহার একমাত্র মেয়ে প্রতিভা সিনহাও অভিনয় করেছেন কিছু ছবিতে। কিন্তু আপাতত ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থেকে অনেক দূরে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত পশুপ্রেমী প্রতিভা।

Latest article