যা বলেন, যে প্রতিশ্রুতি দেন তা একশো শতাংশ রাখেন। কথায় নয়, কাজে বিশ্বাসী তিনি। সন্দেশখালিকে কথা দিয়েছিলেন ২০২৪-এ আসবেন। ডিসেম্বরের শেষ লগ্নে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) আবির্ভাব আরও একবার প্রমাণ করল তাঁর কমিটমেন্ট ঠিক কতটা। লাতিন ত্র্যহস্পর্শ ভিনি, ভিডি, ভিসির মতো যথারীতি এলেন, দেখলেন এবং জয়ও করলেন।
মুখ্যমন্ত্রীর আগমনে বিদায়ী বছরে ঢল নামল আবালবৃদ্ধবনিতার। শঙ্খধ্বনি, উলুধ্বনি দিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে স্বাগত জানালেন সন্দেশখালির বাসিন্দারা। মনে হচ্ছিল যেন প্রাক বর্ষবরণের উৎসবে মেতেছে বিস্তীর্ণ দ্বীপবাসী। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নয়, ঘরের মেয়ের সান্নিধ্যে বিগত বছরের যাবতীয় গ্লানি ঝেড়ে ফেলাও বটে। মিথ্যে গিমিকের পচা ডোবা থেকে মমতাময়ী মুখ্যমন্ত্রীর ছোঁয়ায় নিমেষে উন্নয়নের সাগরে উত্তরণ।
সন্দেশখালির মিশন মাঠে দাঁড়িয়ে একঘণ্টার বক্তব্য স্থানীয় মানুষের হৃদয় জুড়িয়ে দিল। শুধু বক্তব্যে সীমিত থাকলেন না তিনি। একগুচ্ছ প্রকল্পের সুখবর দিলেন সন্দেশখালিকে। সন্দেশখালির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঢেলে সাজানো থেকে শুরু করে লঞ্চ, স্পিডবোটের সংখ্যা বাড়ানো এবং জেটিঘাটের উন্নয়নকে পাখির চোখ করে দ্বীপবাসীর যোগাযোগের মাধ্যমকে ত্বরান্বিত করার কাজে জোর দিচ্ছে রাজ্য।
সন্দেশখালি নিয়ে লোকসভা ভোটের আগে বাম-বিজেপির যোগসাজশকেও কটাক্ষ করেন মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিজেপি অন্যায়ের অর্থে মানুষের মধ্যে প্ররোচনা সৃষ্টি করে। আর একদা খুন-জখমের মাস্টার সিপিএম এখন বড় বড় কথা বলে। যদিও সন্দেশখালির মানুষের আবেগ তাঁর কাছে অনেক বড় বলে তিনি এসব ভুলে গিয়েছেন বলেও জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মোটের ওপর তিনি স্পষ্ট করেছেন, তিনি সবার মুখ্যমন্ত্রী, সবার দিদি। যাঁরা তাঁকে সমর্থন করেন তাঁদের পাশাপাশি যাঁরা তাঁকে ভুল বুঝেছিলেন, বিভ্রান্ত হয়েছিলেন তাঁদের প্রতিও তিনি সমান দায়িত্বশীল এবং সহানুভূতিশীল।
আরও পড়ুন: ভোপাল গ্যাস-ট্র্যাজেডি চার দশক পরে সম্পূর্ণ সরানো হল বিষাক্ত বর্জ্য
রাজনীতির জায়গা থেকে নয়, সন্দেশখালির আত্মার আত্মীয় রূপেই তিনি বিরাজমান থাকবেন বলেও উল্লেখ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী (Mamata Banerjee)।
পরিযায়ী নেতা-নেত্রীদের মতো ভাষণসর্বস্ব নন কোনওদিনই। ফলেন পরিচয়ে বিশ্বাসী মুখ্যমন্ত্রী। সেজন্যই তো তিন-তিনবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গড়ার পরেও রাজ্যের প্রতিটি জেলায় প্রতিনিয়ত ছুটে যান। মনিটরিং করেন অভিভাবকের মতো। ভয়ঙ্কর সাইক্লোন, প্রবল নিম্নচাপ, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবিলাতেও তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন।
বছরের বিশেষ কিছু সময়ে পরিযায়ী নেতাদের আবির্ভাব ঘটে। ঠিক যেমন পরিযায়ী পাখপাখালিরা দূরদেশ থেকে পাড়ি জমায় ভিন দেশে। সেইরকম হাবভাব নিয়ে মরশুমি এই কেন্দ্রীয় নেতা-মন্ত্রীরা প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দেন। ভোট মিটলে অবশ্য পাততাড়ি গোটাতেও সময় নেন না। যথারীতি ব্যর্থ মনোরথে।
কারণ, বাংলার মানুষ যে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাঁরা সাফ বোঝেন, সারা বছর তাঁদের পাশে কে থাকেন। দুয়ারে সরকারের সুফল বাঙালি ঘরে তোলে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী থেকে একের পর এক উন্নয়নযজ্ঞে সুজলা-সুফলা বাংলা সমৃদ্ধ হয়। অতিথিপরায়ণ বাংলা তথা বাঙালি এই পরিযায়ী বহিরাগত নেতাদের আপ্যায়নে ত্রুটি করেন না। কিন্তু ভোটবাক্সে লবডঙ্কা দিতে ভোলেন না।
লোকসভা ভোটের আগে সন্দেশখালিতে যে মিথ্যাচারের প্রোপাগান্ডাকে সামনে এনেছিল বাম-রাময়ের অলিখিত জোট সেই অপপ্রচারকে এমনিতেই বাপি বাড়ি যা শটের মতো বাইরে ফেলেছে রাজ্যের সাধারণ মানুষ।
বিজেপির গতবারের ১৮টি আসন নেমে এসেছে ১২-তে। নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব আর টাকা ছড়ানোর ঘৃণ্য রাজনীতি না থাকলে এই সংখ্যা যে এক অঙ্কে নেমে আসত তা বলাইবাহুল্য। কংগ্রেস, সিপিএম বরাবরের মতো গোল্লা পেয়েছে।
সন্দেশখালি যে লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত সেই বসিরহাট কেন্দ্র থেকেও বিজেপির বোড়ে রেখা পাত্র গো-হারান হেরেছেন। সন্দেশখালির ধাপ্পা যে রাজ্যবাসী বুঝে গিয়েছে তাও জলের মতো পরিষ্কার। এই গোটা অধ্যায়ে মুখ্যমন্ত্রী (Mamata Banerjee) বেশ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি জানেন কোন বল খেলতে হয় আর কোন বল ছেড়ে দিতে হয়। এক্ষেত্রে সংযমের পথে হেঁটে দেখে নিচ্ছিলেন মিথ্যাচারের পারদ কতটা উর্দ্ধমুখী হতে পারে।
সন্দেশখালির কুৎসা তখন চরমে। প্রধানমন্ত্রী ফোন করলেন প্রোপাগান্ডার কলেবর রেখা পাত্রকে। এমন ভান করলেন, যেন দেশে আর কোনও সমস্যা নেই। যত কাণ্ড (পড়ুন নাটক) সন্দেশখালিতে। যে প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিন্দুমাত্র সময় হয় না হাথরস, উন্নাও বা জ্বলন্ত মণিপুরে যেতে। দাঙ্গাবিদীর্ণ মণিপুরে যেখানে প্রতিনিয়ত নারীদের চূড়ান্ত অবমাননা করা হচ্ছে, নগ্ন করে রাস্তায় হাঁটানো হচ্ছে, একের পর এক সাধারণ মানুষ খুন হচ্ছেন তাঁদের নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই ভারতীয় নিরো নরেন্দ্র মোদির। তখন যে তিনি চারশো পার নামক ‘মুঙ্গেরিলাল কী হাসিন সপনে’ মশগুল। তার মধ্যে আগ বাড়িয়ে দেশ-বিদেশের মিডিয়াকে বাকতাড়ি মেরেছেন, বাংলা থেকে নাকি বিজেপি এ-যাবৎ কালের সর্বাধিক আসন পেতে চলেছে। বলাবাহুল্য, পুরোটাই সন্দেশখালি মেলোড্রামাকে সামনে রেখে। যদিও পরে কালীরামের ঢোল-এর অবস্থা হল বিজেপি পরিচালিত এই ঢক্কানিনাদের। বিজেপির স্থানীয় নেতারাই ফাঁস করলেন, কীভাবে পদ্ম ব্রিগেডের মদতে টাকার খেলা হয়েছে সন্দেশখালি তথা গোটা রাজ্যকে বদনাম করতে। ষড়যন্ত্রকারীদের মুখোশ খসে পড়তেও সময় লাগল না।
ফলস্বরূপ, ভোটের ফলে বেআব্রু হয়ে যথারীতি মুখে চুন-কালি মাখলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতার বকলমে কার্যত সার্কাস পার্টি গড়ে তোলা ব্যান্ড মাস্টার শুভেন্দু অধিকারী অ্যান্ড কোং।
আর চারশোর কুশীলবেরা সরকার গড়ার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে বেশ খানিকটা পিছিয়ে পড়েও নীতীশ কুমার আর চন্দ্রবাবু নাইড়ুর সাপ-লুডোর মই চেপে কোনওমতে ক্ষমতাসীন হতে পেরেছেন। সবটাই কতকগুলো ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র ঘাড়ে চেপে। আজ যা দৃশ্যমান, কাল তা ভ্যানিশ হতে কালবিলম্ব করবে না।