বিপ্লব বেচে অর্থ উপার্জনের ফিকির বনাম ত্যাগব্রতী এক নেত্রীর নজির

একদিকে দ্রোহজীবীদের লাভ আর লোভের আগুনের গনগনে আঁচ, অন্যদিকে তখন ত্যাগের প্রদীপের শিখা অনির্বাণ। আলোচনায় চিরঞ্জিৎ সাহা

Must read

আদি বাংলার প্রচলিত প্রবাদ প্রমাণিত হল আবারও। সত্যিই ‘অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ’। এই বাংলায় লাশ পড়লে চিল-শকুনের আগেই যারা খোঁজ পেয়ে ছুটে যায়, তাদের নামই বাম-বিজেপি। দল আসলে একটাই। কখনও ব-এর নিচে ফুটকি দিয়ে রাম, কখনও আবার ফুটকি তুলে বাম। এ-যেন গিরগিটির মানবীয় সংস্করণ। পাল্টিবাজির পাশাখেলায় ইচ্ছামতো রংবদলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (mamata banerjee) উন্নয়নের অশ্বমেধের পথে কাঁটার ন্যক্কারজনক পলিটিক্স। মানুষের সর্বনাশ করে নিজেদের পৌষমাসের আখের গোছানোর খেলায় সাক্ষাৎ যেন মৃতজীবী। আমজনতার মৃত্যুর আবেগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক পেশাগত পালে যতটা হাওয়া টানা যে আর কি…!

আরজি কর হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রীর ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর সময়ের স্রোতে কেটে গেছে এক বছর। মানবিকতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সহমর্মিতার দৃষ্টিকোণ থেকে রাজ্য প্রশাসন ঘটনার অব্যবহিত পরেই নিহত নির্যাতিত পরিবারের হাতে আর্থিক সাহায্য তুলে দিতে চেয়েছিলেন যাতে জনকল্যাণমূলক কোনও পদক্ষেপ করতে পারে তাঁর পরিবার। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (mamata banerjee) ২০২৪-এর ২৮ অগাস্ট তৃণমূল ছাত্র পরিষদের প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চ থেকে ঘোষণা করেছিলেন, বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে ধর্ষণ করে খুনের ঘটনা রুখতে আনা হবে কড়া আইন। সেইমতো আরজি কর-কাণ্ডের ২৫ দিনের মাথায় সেপ্টেম্বরের তিন তারিখেই বিশেষ অধিবেশন বসে বিধানসভায়। ঐতিহাসিক সেই অধিবেশনেই পাশ হয় ‘অপরাজিতা বিল ২০২৪’। বিলটিতে ধর্ষণ এবং অ্যাসিড হামলার মতো গুরুতর অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড এবং কঠোর শাস্তি বিধানের প্রস্তাব করা হলে তারপর তা অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয় রাজভবনে। বিলটি রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতি ভবনে পাঠিয়েও ছিলেন। সম্প্রতি রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর দফতর সেই বিল রাজভবনে ফেরত পাঠিয়েছে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলে।

দুর্ভাগ্যজনক, এই ঘটনার ন্যায়বিচারের দাবিতে এবং সঠিকভাবে আন্দোলন পরিচালনার উদ্দেশ্যে অনিকেত মাহাতো, কিঞ্জল নন্দ, দেবাশিস হালদার প্রমুখ চিকিৎসকগণ তৎক্ষণাৎ গঠন করেন জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট। চলতে থাকে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের অকুণ্ঠ আহ্বান। আন্তরিক সাড়া দেন বিভিন্ন ক্ষেত্রের বহু মানুষ। অনেক টালবাহানার পর গত এপ্রিলে ডাক্তারবাবুগণ প্রকাশ করতে বাধ্য হন অভয়া তহবিলের অডিট। এ যেন— ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল। আন্দোলনের নামে মোট ক্রাউড ফান্ডিং উঠেছিল প্রায় ৩ কোটি ১৮ লক্ষ টাকার। প্রদত্ত হিসেব অনুযায়ী খরচ হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৪৯ লক্ষ ৩২ হাজার ৬৭৯ টাকা। অর্থাৎ মানুষের দানের অর্ধেক টাকাও খরচ করা হয়নি এখনও। ব্যয়খাতে যে অর্থের কথা বলা হয়েছে, সেই দেড় কোটি টাকারও কোনও সর্বজনগ্রাহ্য বিল পর্যন্ত নেই।

আরও পড়ুন-বালিতে কৈলাসের উদ্যোগে রক্তদান মেলা, রক্ত দিলেন প্রায় ১১০১জন

৫১,৩০০! ‘ক্রাই অফ আওয়ার মূর্তি এক্সপেন্স’-এর পাশে ফলকে দৃশ্যমান টাকার অঙ্ক। অথচ, মূর্তির কারিগরের দাবি, তিনি মূর্তির জন্য এক পয়সাও নেননি। ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টর ফ্রন্টের দাখিল করা অডিট রিপোর্টে যেন গাছে চড়েছে গল্পের গরু! ডক্টরস ফ্রন্টের তরফে অনিকেত মাহাতো জানিয়েছেন, মূর্তি বসাতে, শেড-লাইট লাগাতে, অনুষ্ঠান করতে এই ৫১ হাজার খরচ হয়েছে। এই ব্যাখ্যায় বিভ্রান্তি কমেনি, বরং বেড়েছে। কারণ, অডিট রিপোর্টে কালচারাল প্রোগ্রামের জন্য আলাদা টাকার কথা উল্লেখ রয়েছে।
সম্প্রতি অভয়াকে নিয়ে ডাকা নাগরিক কনভেনশনে শিল্পী অসিত সাঁই জানান, ‘আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ঘটনা আমায় অনুভূতিপ্রবণ করে তুলেছিল। বাধ্য করেছিল ওই মূর্তি বানাতে। নিজের কাছেই ফাইবারের মূর্তিটি রেখে দিয়েছিলাম। দেখলাম জুনিয়র ডাক্তাররা আন্দোলন করছে। ওদের ওই মূর্তিটা বিনামূল্যে দিয়ে দিই।’ মিথ্যে ফাঁস হওয়ার পর থেকে অনেকেই এর তুলনা করছেন কোভিডকালীন পিএম কেয়ার ফান্ডের সাথে। অর্থসহায়তাকারী সকলের মনেই প্রশ্ন— ‘আদৌ বাকি টাকা আছে? নাকি সেটাও সাফ হয়ে গিয়েছে!’ আন্দোলনকালীন খরচের বহর দেখে চক্ষুচড়কগাছ হয়েছিল অনেকেরই। টাকা অভয়ার বাবা-মার হাতে তুলে দেওয়া হয়নি কিংবা মামলা-মোকদ্দমা সংক্রান্ত কাজেও লাগানো হয়নি জানার পর থেকে সংশয় ঘনীভূত হয়েছে আরও। প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, যথাযথ বিল প্রদর্শন ছাড়াই হিসাব দেওয়া দেড় কোটি টাকার বাইরেও উদ্বৃত্ত প্রায় দু কোটি টাকা এক বছরেও খরচ করা হল না কেন! তাহলে কি শুধুমাত্র পেশাগত ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি আর পকেট ভারী করার তাগিদেই পাড়ার গুন্ডারা যেভাবে অনুষ্ঠানের নামে তোলাবাজি করে টাকা কামায়, আন্দোলনের অজুহাতে এই জুনিয়র ডাক্তাররাও সেটাই করেছেন। আন্দোলনের গাজর ঝুলিয়ে সরকারি হাসপাতালে ডিউটি না করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস চালিয়ে গেছেন আর সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে প্রাণ হারিয়েছে গরিব রোগী। আগামীর কিডনি পাচার কিংবা জাল ওষুধ চক্রের ভবিষ্যৎ পাণ্ডা হয়তো এদের মধ্যেই গা ঢাকা দিয়ে আছেন। আশঙ্কা যে অমূলক নয়, তা ‘দ্রোহজীবী’ কিঞ্জল নন্দের পরবর্তী কার্যক্রমেই স্পষ্ট। ‘মৌত কা সওদাগর’ আমজনতাকে উৎসব থেকে দূরে থাকার আর্জি জানিয়ে গত নভেম্বরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় মরিয়া প্রচার চালিয়েছেন নিজের ছবি ‘পরবাসী’ কিংবা ‘ডিএনডি’র। তিলোত্তমার লাশের ওপর নিজের ক্যারিয়ার গড়তে প্রথমবারের জন্য মুখ দেখিয়েছেন সত্য স্টিলের বাণিজ্যিক বিজ্ঞাপনে। ডিগ্রি ভাঁড়িয়ে চিকিৎসার অভিযোগ উঠেছে আরেক ‘বিবেকবান’ ডাক্তারের বিরুদ্ধে। অভিযোগ, জুনিয়র চিকিৎসক আসফাকুল্লা নাইয়া নিজের নামের পাশে লেখা M.S (ENT) ডিগ্রি বসিয়ে নিজের ব্যবসায়িক প্রচার চালিয়েছেন হুগলির সিঙ্গুর এলাকায়।

এই যখন একদিকের চিত্র, লাভ আর লোভের আগুনের গনগনে আঁচ, অন্যদিকে তখন ত্যাগের প্রদীপের শিখা অনির্বাণ। অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্ম (এডিআর)-এর সদ্য প্রকাশিত রিপোর্টানুযায়ী, এই মুহূর্তে দেশের সবথেকে গরিব মুখ্যমন্ত্রী এই বাংলার ঘরের মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (mamata banerjee)। তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ ১৫.৩৮ লক্ষ টাকা। সাতবারের সাংসদ, তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী ও দুবারের রেলমন্ত্রী বাংলার মমতাময়ী মায়ের কাছে আসল সম্পদ হল তাঁর সময়কালে বাংলা তথা বাঙালির সার্বিক সমৃদ্ধি। তাই তো তাঁর লড়াই অনেক বেশি মরিয়া, নিঃস্বার্থ ও দ্বিধাহীন। আত্মন্নোতির সিঁড়ি হিসাবে আন্দোলনকে দেখেননি বলেই অর্থনৈতিক প্রতিপত্তির মানদণ্ডে ব্যর্থ হলেও মানুষের নিঃস্বার্থ ভালবাসার অকুণ্ঠ সম্পদে তিনি পরিপূর্ণ। তাই দ্রোহজীবী গেরুয়া ঝুঁটি, লাল শকুনদের শত-কুৎসার মাঝেও গোটা বাংলার মনবাগিচায় আশার ফুল হয়ে ফোটেন একজনই— এই বাংলার নিজের মেয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

Latest article