শ্রাবণ মাস হিন্দুদের কাছে একটি পবিত্র মাস। হিন্দু ধর্মে এই শ্রাবণ মাস ভগবান শিবকে উৎসর্গ করা হয়। শ্রাবণ মাসের সোমবারগুলো সবাই বেছে নেন দেবাদিদেব মহাদেবের মাথায় জল ঢালার জন্য। আর সেই কারণে শ্রাবণ মাসের সোমবারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয় আমাদের কাছে। তবে শ্রাবণ মাসের মঙ্গলবারগুলোও যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সেটা আমাদের অনেকেরই অজানা। শ্রাবণ মাসের মঙ্গলবারগুলো উৎসর্গ করা হয় মা পার্বতীকে। আর এই দিনে মহিলারা মঙ্গলা গৌরীর ব্রত পালন করেন। তবে মঙ্গলা গৌরীর (Magala Gauri) ব্রত পালনের আগে জেনে নেওয়া যাক কে এই দেবী মঙ্গলা গৌরী।
মা মঙ্গলা গৌরী
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে দক্ষযজ্ঞের সময় সতী পিতৃগৃহে অপমানিত হয়েছিলেন। এবং অপমানিত হয়ে দেবী সতী আত্মহুতি দেন। সতীর আত্মহুতির সংবাদ পেয়ে মহাদেব প্রচণ্ড খেপে যান। তখন তিনি সেই যজ্ঞস্থানে এসে সতীর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডবনৃত্য শুরু করেন। শিবের এই তাণ্ডবনৃত্যে যখন ত্রিভুবন ধ্বংস হওয়ার মুখে তখন বিষ্ণু তাঁর সুদর্শনচক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ডিত করে দেন। সতীর দেহ খণ্ডিত হওয়ার পরে মহাদেব তাঁর তাণ্ডবনৃত্য বন্ধ করেন এবং ব্রহ্মাণ্ড ধ্বংস হওয়া থেকে বিরত থাকেন। সুদর্শন চক্রের দ্বারা খণ্ডিত দেহাংশগুলো যেসব স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল সেগুলোই শক্তিপীঠ হিসাবে আখ্যা পায়। আর গয়াতে পড়েছিল সতীর স্তন। আর এই শক্তিপীঠটিতে মঙ্গলা গৌরী মন্দির গড়ে ওঠে। পদ্মপুরাণ, বায়ুপুরাণ, অগ্নিপুরাণ, দেবী ভাগবাত পুরাণ এবং মার্কণ্ডেয় পুরাণে এই মঙ্গলা গৌরীর মন্দিরটির উল্লেখ আছে। মঙ্গলা গৌরীকে (Mangala Gauri) কল্যাণের দেবী হিসাবে পুজো করা হয়। মনে করা হয় তাঁর পুজো করলে বিবাহিত জীবনে সুখ, সন্তান প্রাপ্তি এবং সংসারের শান্তি বজায় থাকবে। এই মঙ্গলা গৌরী মন্দিরটিতে প্রতি শ্রাবণ মাসের মঙ্গলবারে বিশেষ পুজোর আয়োজন করা হয়। আর এই পুজোই মঙ্গলা গৌরী ব্রত নামে পরিচিত।
মঙ্গলা গৌরী ব্রত পালন
প্রাচীন বিশ্বাস অনুসারে মঙ্গলা গৌরী (Mangala Gauri) ব্রত দেবী পার্বতীকে সন্তুষ্ট করার জন্য পালন করা হয়ে থাকে। দেবী পার্বতীকে বৈবাহিক সুখ এবং সৌভাগ্যের দেবী হিসেবে গণ্য করা হয়। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী মা গৌরী তথা পার্বতীকে নারী সৌভাগ্যের রক্ষক বলা হয়ে থাকে। দেবী পার্বতীর পুজো শুধুমাত্র বিবাহিত জীবনে সুখ বয়ে নিয়ে আসে তা নয়, এর সাথে সাথে পরিবারের সুখ-শান্তি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিও বহন করে আনে। এছাড়াও যাঁরা বৈবাহিক জীবনে ঝামেলার সম্মুখীন হন অথবা যাঁদের বিয়ে হতে দেরি হয় তাঁদের এই মঙ্গলা গৌরী ব্রত পালন করার জন্য উৎসাহিত করা হয়।
প্রথা অনুযায়ী এই দিনে বিবাহিত মেয়েরা যেমন উপবাস করে ব্রত পালন করে থাকে ঠিক তেমনি অবিবাহিত মেয়েরাও এই দিন উপবাস করে মঙ্গলা গৌরী ব্রত পালন করে থাকেন। বিবাহিত মহিলারা স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা, সুখী দাম্পত্য জীবন এবং অবিচ্ছন্ন সৌভাগ্যের জন্য উপবাস করে থাকে। অন্যদিকে, অবিবাহিত মেয়েরা একজন ভাল জীবনসঙ্গী পাবার জন্য মঙ্গলা গৌরী ব্রত পালন করে থাকে। কথিত আছে এই মঙ্গলা গৌরী ব্রত পালন করলে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক মধুর
হয়ে ওঠে।
ব্রতের আচার নিয়ম
শ্রাবণ মাসের মঙ্গলবারগুলোতে এই মঙ্গলা গৌরীর ব্রত পালন করা হয়ে থাকে। মঙ্গলা গৌরীর (Mangala Gauri) উপবাসটি খুব ভোরে শুরু হয় এবং সন্ধ্যায় চন্দ্রোদয় পর্যন্ত পালন করা হয়। ব্রত পালনকারী মহিলারা সকালে উঠে স্নান করে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে পুজোর স্থানে গঙ্গার জল ছিটিয়ে নেন। এরপর একটি কাঠের ছোট বেদির ওপর লাল বা হলুদ কাপড় দিয়ে ঢেকে নিয়ে তার ওপর দেবী গৌরীর একটি মূর্তি স্থাপন করে নেন। দেবী মঙ্গলা গৌরীর উদ্দেশ্যে এর পরে হলুদ, সিঁদুর, চাল, ফুল, নারকেল, মিষ্টি, ফল, গম, পান, সুপারি, ছোলা এবং সোলা শৃঙ্গার অর্থাৎ বিবাহিত মহিলাদের ১৬ ধরনের অলংকরণ সহকারে নৈবেদ্য উৎসর্গ করা হয়। এই ব্রতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হচ্ছে গমের আটা দিয়ে প্রদীপ তৈরি করতে হয় এবং সেই প্রদীপ মায়ের সামনে জ্বালাতে হয়। এরপরে নৈবেদ্য প্রদান এবং আচার-অনুষ্ঠানের পর ব্রত পালনরতা মহিলারা মঙ্গলা গৌরীর ব্রতকথা শোনেন, আবার কেউ কেউ মঙ্গলা গৌরীর ব্রতকথা পড়েও থাকেন। এই ব্রত পালনের সময় নববিবাহিত মহিলারা তাদের শাশুড়িদের পোশাক, মিষ্টি এবং সৌন্দর্যের জিনিসপত্র উপহার দিয়ে তাঁদের কাছে আশীর্বাদ কামনা করেন। সর্বশেষে আরতি এবং প্রসাদ বিতরণের মাধ্যমে মঙ্গলা গৌরীর ব্রত পালন সমাপ্ত হয়ে থাকে।
মা মঙ্গলা গৌরীর ব্রতকথা
প্রাচীনকালে ধর্মপাল নামে একজন বণিক ছিলেন। ধর্মপালের অর্থের কোনও অভাব ছিল না। এছাড়াও তিনি ভাল গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের একজন একনিষ্ঠ ভক্ত। এরপরে একদিন ধর্মপাল একজন খুব সুন্দরী মেধাবী নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁরা এমনিতে খুবই সুখী ছিলেন কিন্তু বিয়ের কয়েক বছর যাওয়ার পরেও যখন তাঁদের কোনও সন্তানাদি হল না তখন তাঁরা এই ব্যাপারটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। কারণ তাঁদের যদি কোনও সন্তানাদি না হয় তাহলে তাঁর এত বড় ব্যবসার পরবর্তীকালে কোনও উত্তরাধিকারী থাকবে না। এই নিয়ে যখন ধর্মপাল খুব উদ্বিগ্ন তখনই একদিন তাঁর স্ত্রী সন্তানের বিষয়ে কথা বলার জন্য একজন ভাল পণ্ডিতের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তাঁকে। স্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী ধর্মপাল শহরের সবথেকে বিখ্যাত পণ্ডিতের সঙ্গে দেখা করতে যান। সেই পণ্ডিত ধর্মপালকে পরামর্শ দেন যে তিনি এবং তাঁর স্ত্রী যেন শিব ও মা পার্বতীর পুজো করেন। এটা করলে তাঁরা মা পার্বতীর আশীর্বাদ-ধন্য হবেন এবং অচিরেই তাঁদের কোলে সন্তান আসবে। পণ্ডিতের কথামতো ধর্মপালের স্ত্রী সমস্ত রীতিনীতি মেনে মা পার্বতী এবং শিবের পুজো শুরু করেন। ধর্মপালের এহেন ভক্তি দেখে দেবী পার্বতী ভীষণ খুশি হন। এবং তিনি আবির্ভূত হয়ে ধর্মপালের স্ত্রীকে বলেন যে ধর্মপালের স্ত্রীর ভক্তিতে তিনি প্রসন্ন। আর তাই তাঁর কাছে ধর্মপালের স্ত্রী যা চাইবেন তিনি তাঁকে তাই দেবেন। তখন ধর্মপালের স্ত্রী দেবী পার্বতীর কাছে সন্তান চান। দেবী পার্বতী তাঁকে পুত্রলাভের আশীর্বাদ করেন। এক বছর পরে ধর্মপালের স্ত্রী একটি পুত্রসন্তানের জন্ম দেন। কিন্তু সেই পুত্র ছিল ক্ষণজন্মা। জ্যোতিষীদের কথা অনুযায়ী, মাত্র ষোলো বছর বয়সে সাপের কামড়ে সেই ছেলের মৃত্যু হবে।
যাই হোক পুত্রের নামকরণ সমাপ্ত হলে ধর্মপাল জ্যোতিষীকে তাঁর পুত্রের ক্ষণজন্মা হওয়ার কথা সবিস্তারে বলেন। তখন সেই জ্যোতিষী ধর্মপালকে পরামর্শ দেন যে এমন একটি মেয়ের সঙ্গে যেন তার পুত্রের বিয়ে দেওয়া হয় যে মেয়েটি মঙ্গলা গৌরীর ব্রত পালন করে। জ্যোতিষীর কথা অনুযায়ী ধর্মপাল তাঁর ছেলেকে মঙ্গলা গৌরীর (Mangala Gauri) ব্রত পালনকারী একটি মেয়ের সঙ্গে বিবাহ দেন। এরপর সেই মেয়ের পুণ্যের জন্য ধর্মপালের ছেলে মৃত্যুর কবল থেকে মুক্তিলাভ করে। এবং দীর্ঘায়ু প্রাপ্ত হয়। আর এইভাবেই মা মঙ্গলা গৌরীর ব্রত দিগ্বিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: পাগলা দাশুর আপন দেশে গেরুয়া মোদি বিজেপি সর্বনেশে
ব্রতের উপবাসের নিয়ম
মঙ্গলা গৌরী ব্রতের উপবাসের অনেক ধরনের নিয়ম আছে। বলা হয়ে থাকে, যাঁরা এই ব্রত পালন করেন সেই উপবাসকারী মহিলাদের ব্রত চলাকালীন সারাটা দিন শৃঙ্খলা এবং পবিত্রতা বজায় রাখতে হয়। এদিন মঙ্গলা গৌরীর পুজো করার পরে ফলাহার করা যায়। কিন্তু রান্নাকরা খাবার এদিন মুখে তোলা যায় না।
এই ব্রত পালনের আরও একটি নিয়ম আছে, যারা এই ব্রত শুরু করেন তাঁদের একনাগাড়ে পুরোপুরি নিয়ম মেনে পাঁচ বছর অথবা ষোলো বছর এই ব্রত পালন করতে হয়। এবং শেষ বছরে এই পুজোর উদযাপন করা হয়। তবে মনে করা হয় বা বিশ্বাস করা হয় যে যথাযথ ভক্তি এবং আচার অনুষ্ঠানের সাথে এই মঙ্গলা গৌরী ব্রত যদি একবারও কেউ পালন করে, তাহলে তার জীবনে ও সংসারে শান্তি এবং সৌভাগ্য বিরাজ করে।
মঙ্গলা গৌরী ব্রতের সময়
শ্রাবণ মাসের মঙ্গলবারগুলোতে মঙ্গলা গৌরী ব্রত পালন করা হয়। এই ব্রত দেবী পার্বতীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গিত একটি ব্রত। মহিলারা ব্রতের দিন সকালে উঠে স্নান করে সুন্দরভাবে সেজেগুজে দেবী গৌরীর পুজো এবং উপবাস পালন করেন। সন্ধেবেলায় চাঁদ ওঠার পরে এই উপবাস তাঁরা ভাঙেন। সমস্ত মহিলার মধ্যে এই মঙ্গলা গৌরী ব্রতের গুরুত্ব অপরিসীম। পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী দেবী পার্বতী ভগবান শিবকে খুশি করতে এবং তাঁর আশীর্বাদ পেতে এই ব্রত পালন করেছিলেন। আর সেই কারণে মনে করা হয় যে যদি কোনও মহিলা ভক্তি সহকারে এই ব্রত পালন করেন তাহলে তাঁদের স্বামীর জীবনে মঙ্গল, সুখ এবং সমৃদ্ধি বাহিত হবে। এই মঙ্গলা গৌরী (Mangala Gauri) ব্রত উৎসবটি আবার মাতৃত্বের সাথেও যুক্ত। বিশ্বাস অনুযায়ী যাঁরা এই ব্রত পালন করেন তাঁরা মাতৃত্বের আশীর্বাদ পেতে পারেন।