ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতের এবোটাবাদে জন্ম হয়েছিল তাঁর। তখন তিনি মনোজ কুমার বা ভারত কুমার কোনওটাই নন। পরিবারের বড় ছেলে হরিকিষণ গিরি গোস্বামী। তাঁর একটি বোনও ছিল। দেশভাগের সময়, টালমাটাল পরিস্থিতিতে গোটা পরিবার আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। ওই সময় তার আর একটা ভাই হল, নাম কুকু। ছোট্ট ভাইটা আর মা, দু’জনেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওদিকে চলছে দাঙ্গা। সেই অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হন মা। তখন সাইরেন বাজলেই হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সবাই লুকিয়ে পড়তেন। এমনই একদিন মা চিৎকার করে চিকিৎসক এবং নার্সদের ডাকছিলেন। কিন্তু তাঁরা শুনতে পেলেন না। চিকিৎসার অবহেলায় ছোট্ট একরত্তি ভাই সেদিন মারা যায়। ওই দিন চটে গিয়ে হরি হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্সদের লাঠিপেটা করতে গেছিলেন। বাবা এসে পরিস্থিতি সামাল দেন। পরেরদিন সেই দু’মাসের ছোট্ট ভাইকে যখন যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁর মনে হয়েছিল তিনি নিজেই যেন ডুবে যাচ্ছেন সেই জলে। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অভিনেতা মনোজকুমার (Manoj Kumar) বহুবার এই কথা বলেছেন। দেশভাগের পর দিল্লি চলে আসেন। নিদারুণ সেই অভিজ্ঞতা আজীবন অন্তরে বয়ে বেড়িয়েছেন। যা তাঁর মনে গভীর ছাপ ফেলেছিল। তাই দেশের প্রতিও ছিল তীব্র আবেগ। তাঁর ছবিতেও সেই প্রতিফলনই আমরা দেখি।
দিল্লির হিন্দু কলেজ থেকে স্নাতক পড়ার সময় অভিনয়ের প্রতি আগ্রহ। দিলীপকুমারের খুব বড় ভক্ত ছিলেন তাই তাঁর অভিনীত ‘শবনম’ ছবিতে দিলীপকুমারের চরিত্রের নাম অনুযায়ী নিজের নাম রাখেন মনোজ কুমার। এরপর ১৯৫৭ সালে বলিউডে হাতেখড়ি। তখন অল্পস্বল্প অভিনয় করতেন। ১৯৬১-তে ‘কাঞ্চ কী গুড়িয়া’ ছবিতে প্রথম মুখ্য চরিত্রে। প্রথম সাফল্য এল পরিচালক বিজয় ভট্টের ছবি ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’ ছবির জন্য। এরপর ‘শাদি’, ‘ডক্টর বিদ্যা’ এবং ‘গৃহস্থি’ তিনটে ছবিই বক্স অফিস সুপারহিট হয়। আর পিছনে ফিরে তাকাননি।
কিছু সেরা ছবি
হরিয়ালি অউর রাস্তা
১৯৬২ সালে মনোজের ব্রেক থ্রু ছবি ‘হরিয়ালি অউর রাস্তা’। প্রেম, আবেগ, আত্মত্যাগ, কর্তব্যের গল্প। পরিচালক বিজয় ভট্টের এই ছবিতে মনোজের (Manoj Kumar) দুই নায়িকা ছিলেন মালা সিনহা ও শশিকলা।
উপকার
মনোজ কুমারের (Manoj Kumar) অন্যতম সেরা ছবি ‘উপকার’। এই ছবির পরেই তাঁর নাম হয় ভারত কুমার। ভারতীয় মূল্যবোধ এবং দেশপ্রেমকে পুঁজি করে চলা এক নিঃস্বার্থ ভারতীয় কৃষক-সৈনিকের গল্প। ছবির পরিচালক ছিলেন স্বয়ং মনোজ কুমার। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী নিজে অনুরোধ করেছিলেন অভিনেতা, পরিচালক মনোজ কুমারকে এমন একটা ছবি করতে যার থিম হবে ‘জয় জওয়ান, জয় কিসান’।
রোটি কাপড়া অউর মকান
এক সৎ মানুষের জীবন সংগ্রামের গল্প ‘রোটি, কাপড়া অউর মকান’। বেকারত্ব, দুর্নীতি, অমর্যাদার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গল্প নিয়ে ১৯৭৪ সালে তৈরি হয়েছিল ছবিটি। ছবির পরিচালক, প্রযোজকও ছিলেন মনোজ কুমার এবং মুখ্য ভূমিকাতেও ছিলেন তিনি। এই ছবিতেও তাঁর নাম ছিল ভারত। ভাই বিজয়ের ভূমিকায় ছিলেন অমিতাভ বচ্চন।
পুরব অর পশ্চিম (১৯৭০)
মনোজ কুমার প্রযোজিত ও পরিচালিত এবং অভিনীত ক্লাসিক একটি চলচ্চিত্রের অন্যতম হল ‘পুরব অর পশ্চিম’। ছবিতে মনোজ কুমার, সায়রা বানু, অশোক কুমার, প্রাণ এবং প্রেম চোপড়ার মতো তাবড় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয় করেছেন। সুপার ডুপার হিট এই সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন কল্যাণজি-আনন্দজি।
শোর
১৯৭২ সালে তৈরি এই ছবির গল্প এক পিতা-পুত্রকে নিয়ে। যে পিতা তার বোবা ছেলেকে আবার কথা বলতে সাহায্য করার দৃঢ় সংকল্প নিয়েছিল। এক দারুণ মর্মস্পর্শী গল্প। মনোজ কুমারের অভিনীত মনে রাখার, মতো ছবিগুলোর মধ্যে অন্যতম ‘শোর’। ছবিটি রচনা, পরিচালনা এবং প্রযোজনাও করেছেন মনোজ কুমার।
গুমনাম
১৯৬৫ সালে মনোজ কুমার অভিনীত বলিউডের অন্যতম পুরস্কারপ্রাপ্ত থ্রিলার ছবি হল ‘গুমনাম’। ছবিটা তৈরি হয়েছিল অগাথা ক্রিস্টির ‘দেন দেয়ার ওয়্যার’-এর অনুসরণে। ফিল্মফেয়ার সম্মান পেয়েছিল ছবিটি। তিনটি বিভাগে ছিল মনোনয়ন। একের পর এক হতে থাকা খুনের রহস্য নিয়ে তৈরি এই ছবি।
আরও পড়ুন- ‘ডেকে আলোচনা করবেন, এমন সংবিধানে নেই’, বিল আটকে রাখা নিয়ে মন্ত্রীর নিশানায় রাজ্যপাল
ক্রান্তি
১৯৮১ সালের সুপারহিট ছবি ‘ক্রান্তি’। ছবির প্রযোজনা, পরিচালনা, সম্পাদনা এবং এডিটিং করেছিলেন স্বয়ং মনোজ কুমার। কাহিনি এবং চিত্রনাট্যও মনোজ কুমারের। ছবিতে মনোজ ছাড়াও ছিলেন শশী কাপুর, শত্রুঘ্ন সিনহা, হেমা মালিনী, পরভিন ববি প্রমুখ। ছবিটা সেই সময় টপ টেন হিন্দি ছবির তালিকায় ছিল। প্রেক্ষাপট ১৯ শতকের ব্রিটিশ ভারত। এখানেও তাঁর নাম ছিল ভারত।
শহিদ
সর্দার ভগৎ সিং-এর বায়োগ্রাফি এই ছবিটির মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন মনোজ কুমার। গোটা ভারতবর্ষকে অণুপ্রাণিত করেছিল এই ছবি। ভগৎ সিং-কে নিয়ে তৈরি ‘শহিদ’ ছিল সে-যুগের অন্যতম দেশাত্মবোধক ছবি, যার গানগুলো মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল।
এগুলো ছাড়া তাঁর ব্লকবাস্টার ছবির তালিকায় রয়েছে ‘পাত্থর কে সনম’, ‘নীলকমল’, ‘ও কৌন থি’ ‘হিমালয় কী গোদ মে’, ‘দো বদন’-সহ আরও অনেক ছবি।
সম্মাননা এক ঝলকে
১৯৬৮ সালে ‘উপকার’ ছবির জন্য দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং প্রথম ফিল্মফেয়ার সেরা পরিচালকের সম্মান। এছাড়া তিনি আরও ৮টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে শ্রেষ্ঠ পরিচালক, শ্রেষ্ঠ কাহিনি, সংলাপ ও শ্রেষ্ঠ সম্পাদনা।
১৯৯২ সালে ভারত সরকার পদ্মশ্রী সম্মান।
১৯৯৯ : ফিল্মফেয়ার লাইফটাইম আচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড
২০১৬-তে ভারতীয় চলচ্চিত্রে আজীবন অবদানের জন্য দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। এছাড়া পেয়েছেন আরও অসংখ্য, সম্মান এবং পুরস্কার