বড়দিন। যিশুর জন্মোৎসব। সারা পৃথিবী জুড়ে পালিত হয় এই উৎসব। জায়গা মেলেনি কোনও সরাইখানাতেও। তাই ২৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে বেথলেহেমের গোশালায় জন্ম হয়েছিল ঈশ্বরের পুত্রের। গরুর খাবার দেওয়ার কাঠের পাত্রের মধ্যে শোয়ানো হয়েছিল নবজাতককে। সেই ঘটনাকে স্মরণ করে প্রতিবছর এই দিনটিতে গির্জায় গির্জায় বেজে ওঠে ঘণ্টা। সূচনা হয় উত্সবের। যিশুর জন্মের সেই দৃশ্য সাজানো হয় নানাভাবে। সেখানে সদ্যোজাত সন্তানকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন মা মেরি। পাশে থাকেন বাবা যোসেফ।
এই পর্যন্ত এই জন্মের দৃশ্য যে কোনও মানবসন্তানের জন্মের মতোই স্বাভাবিক। কিন্তু যিশু তো ঈশ্বরের পুত্র। তাই তাঁর জন্মের ঘটনা কখনওই সাধারণ মানুষের মতো হতে পারে না। তাই একটা সময়ের পর আরও অনেক অলৌকিক গল্পের মতোই মেরির মাতৃত্বের সঙ্গেও অলৌকিকত্ব যুক্ত হল। ক্রিশ্চানদের একটা অংশ বলল, মা মেরি কুমারী ছিলেন। কুমারী অবস্থাতেই তিনি সন্তানের জন্ম দেন। কোনও পুরুষের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে মেরি গর্ভবতী হননি। তিনি ইমাকুলেট অর্থাৎ কলঙ্কহীন। আদিম পাপ তাঁকে স্পর্শ করেনি। এখানে মনে রাখতে হবে ক্রিশ্চান ধর্মে কিন্তু বলা হয়, আদম এবং ইভের মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক অর্থাৎ আদিম পাপের ফলেই মানুষের জন্ম হয়েছিল। কিন্তু মেরি যেহেতু ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম দিচ্ছেন, তাই এই পাপ থেকে তিনি মুক্ত।
এই বিষয়ে ক্রিশ্চান ধর্মালম্বীদের ভিতরেই দুটি ভাগ আছে। ক্যাথলিকরা এই কুমারী মেরির ধারণায় বিশ্বাসী। প্রোটেস্টান্টরা এটা মানেন না। কেন মানে না, কীভাবে এই ভাগ হল, সে-সবই পৃথক আলোচনার বিষয়। কিন্তু একটু চিন্তা করলেই বোঝা যায় এই কুমারী মাতৃত্বের ধারণা কিন্তু মোটেই ক্রিশ্চানদের একচ্ছত্র নয়। আমাদের মহাকাব্যে, পুরাণেও কুমারী মায়ের কথা আছে। এ-বিষয়ে প্রথম যে নামটি উল্লেখ করতে হয় তিনি হলেন কুন্তী। বিবাহের পূর্বে তাঁর পিতার বাড়িতে এসেছিলেন দুর্বাসা মুনি। কুন্তীর সেবায় সন্তুষ্ট হয়ে তিনি তাঁকে বর দেন, কুন্তী যে কোনও দেবতাকে আহ্বান করলে, তিনি আসবেন এবং তাঁর সঙ্গে সঙ্গমের ফলে কুন্তী সন্তানধারণ করবেন। শুধু তা-ই নয়, দুর্বাসা নাকি এ-ও বলেছিলেন, প্রতিবার সন্তান জন্মের পর কুন্তীর শরীর আবার কুমারী অবস্থায় ফিরে যাবে। আমরা সবাই জানি সূর্যের সঙ্গে শারীরিক মিলনের ফলে কুন্তীর গর্ভে জন্ম হয়েছিল কর্ণের। তখনও অবিবাহিতা কুন্তী লোকলজ্জার ভয়ে সেই সন্তানকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরেও কুন্তী ধর্ম, পবন এবং ইন্দ্রের সঙ্গে সঙ্গমের ফলে তিনটি সন্তানের জন্ম দেন। তবে ততদিনে পাণ্ডুর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়ে গেছে। তাই কলঙ্কের ভয়ে সন্তান পরিত্যাগের আর প্রশ্ন ছিল না। বস্তুত পাণ্ডুর ইচ্ছাতেই তিনি দেবতাদের আহ্বান করেছিলেন। তাঁর পুত্ররা পাণ্ডুর সন্তান হিসাবেই সমাজে পরিচিত হয়েছিলেন। তবে কুন্তী যেহেতু ঈশ্বর বা মহামানবের জন্ম দেননি, তাই সম্ভবত তাঁর কুমারীত্ব নিয়ে কোনও অলৌকিক গল্পও সেভাবে তৈরি হয়নি।
একটু ভেবে দেখলে একটা কথা কিন্তু স্পষ্টতই বোঝা যায়, এই দুটি ঘটনার, মেরির যিশুর জন্ম দেওয়া এবং কুন্তীর কর্ণের জন্মদান, দেশ-কাল-প্রেক্ষিত সবই সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু ভাবনার মধ্যে একটা অদ্ভুত মিল আছে। দুটি ক্ষেত্রেই কুমারীত্ব এবং মাতৃত্ব— এই দুটি ধারণাকে প্রায় পরস্পর বিরোধী বলে দেখানো হয়েছে। কীভাবে? সমাজের দৃষ্টিতে, কুমারীত্ব একটা খুব পবিত্র ব্যাপার। মাতৃত্ব তো নিঃসন্দেহে একটি মহান ধারণা কারণ তা না হলে সৃষ্টির পথই রুদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু অদ্ভুতভাবে কুমারী থেকে মাতৃত্বে যাওয়ার পথটাই হল পাপের। ক্রিশ্চান ধর্ম অনুসারে আদিম পাপ না করলে মা হওয়া যাবে না। আবার কুমারী অবস্থায় মা হলে সেটাও পাপের। মনে রাখতে হবে মেরি কুমারী মা ঠিকই, কিন্তু তিনি বিবাহিত। যোসেফ তাঁর স্বামী। কুমারী মেয়ের সন্তানধারণ পাপ, অন্যায়, এই ধারণাটা কিন্তু দেশ, কাল নির্বিশেষে সর্বত্রই একইরকম।
আরও পড়ুন-‘কাকা’ থেকে কেক
কিন্তু এই বিয়ে, কুমারীত্ব এবং মাতৃত্ব এই তিনটি ধারণাকে একই সরলরেখায় এনে ফেলা কি খুব জরুরি? আসলে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভবই হয়েছে সন্তানের পিতৃপরিচয় নির্দিষ্ট করার জন্য এবং উত্তরাধিকার নিয়ে যাতে কোনও বিভ্রান্তি না ঘটে সেই কারণে। যে কোনও পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাতেই তাই বিয়ে এবং মাতৃত্ব এই দুটি শব্দকে সর্বদা এক বন্ধনীতে রাখা হয়। মাতৃত্বের জন্য বিয়ে আবশ্যিক। বিয়ে না হলে সেই মাতৃত্ব অবাঞ্ছিত।
পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এই নিয়মটা চালু ছিল। বহু বহু বছর ধরে সমাজ এটা মেনেও চলেছিল। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য, সর্বত্রই এই নিয়মের কোনও পার্থক্য হয়নি। পরিবর্তনের সূচনা হল উনিশ শতকে। পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ যখন বিধ্বস্ত, তখন খুব স্বাভাবিক কারণেই সন্তানের পিতৃত্ব নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামানোর আর তেমন সুযোগ ছিল না। সমাজ নিজের প্রয়োজনে নিয়ম তৈরি করে আবার নিজের প্রয়োজনেই অনেকসময় চোখ বন্ধ করে রাখে। বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপে অনেকটা সেরকমই ঘটেছিল। কিন্তু একটা পরিবর্তনের যখন সূচনা হয় তখন তা তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চলে। চাইলেও সমাজ আর তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তাই বিশ্বযুদ্ধ, তার অভিঘাতে মেয়েদের কাজের জগতে আসা, নিজস্ব উপার্জন ইত্যাদির ফলশ্রুতিতে ক্রমশ যখন ইউরোপে নারীবাদী আন্দোলন মাথা তুলে দাঁড়াতে লাগল, তখন বিয়ে ও মাতৃত্বের এতকালের গাঁটছড়া ধীরে ধীরে আলগা হয়ে গেল। যা একেবারে ধ্রুবসত্য বলে মনে করা হত, প্রশ্ন উঠতে লাগল সমাজের সেইসব নিয়মকানুন নিয়ে। একদিকে যেমন গর্ভপাত আইনসিদ্ধ করার দাবি উঠল অন্যদিকে আমরা শুনলাম নতুন একটা শব্দ, সিঙ্গল মাদার। সন্তান পরিচিত হবে মায়ের পরিচয়ে। সন্তানকে পালন করার সব দায়িত্ব শুধুই মায়ের। বাবার সেখানে শুধু কোনও ভূমিকা নেই নয়, বাবার কোনও অস্তিত্বও অনেকসময় নেই।
নারী যে নিজের যোগ্যতায় সন্তান পালন করতে পারে এমন উদাহরণ আমরা সেই মহাকাব্যের যুগ থেকেই দেখতে পাই। রাম তাঁকে পরিত্যাগ করার পর সীতা একাই যমজ সন্তান লব-কুশের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। বভ্রুবাহনের জন্মের পরই মণিপুর রাজ্য ছেড়ে চলে এসেছিলেন অর্জুন। পুত্রসন্তানকে বড় করেছিলেন চিত্রাঙ্গদা একা। ঘটোৎকচের মা হিড়িম্বাকেও সে-যুগের সিঙ্গল মাদার বললে মোটেই অত্যুক্তি হয় না। তবে তাদের সকলেরই সন্তানের নির্দিষ্ট পিতৃপরিচয় ছিল।
বিশ শতকের শেষভাগ থেকে মেয়েরা ক্রমশ এই পিতৃপরিচয়ের বিষয়টা নিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করেছিল। একজন স্বাধীন নারী কেন তার সন্তানকে নিজের পরিচয়ে বড় করতে পারবে না, সেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। আমাদের দেশেও তার অভিঘাত পড়ে। অবিবাহিতা অভিনেত্রী নীনা গুপ্তার সন্তানধারণ নিয়ে একসময় রীতিমতো তোলপাড় হয়েছে। নীনা কিন্তু বহু সমালোচনা সত্ত্বেও নিজের জায়গায় অটল থেকেছেন। তাঁর কন্যা মাসাবা গুপ্তা আজ একজন রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত ফ্যাশন ডিজাইনার। বিশ্বসুন্দরী সুস্মিতা সেনও দুটি মেয়েকে দত্তক নিয়েছেন এবং একাই তাদের মানুষ করছেন। অর্থাৎ মা হওয়ার জন্য বিয়ে করা এবং স্বামী থাকাটা যে আবশ্যিক, এই কথাটাকেই তাঁরা মেনে নিচ্ছেন না। আইনগতভাবে সিঙ্গল মাদারের অধিকার স্বীকৃত হওয়ার পর বিষয়টা অনেকটা স্বাভাবিকও হয়েছে।
এ ছাড়া বিজ্ঞান এখন যে-জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, তাতে মাতৃত্ব কিংবা আরও নির্দিষ্ট করে বললে গর্ভবতী হওয়ার জন্যও শারীরিকভাবে কোনও পুরুষের উপস্থিতি আর মেয়েদের জন্য সেভাবে প্রয়োজনীয় নয়। ইচ্ছে করলে স্পার্ম ব্যাঙ্ক থেকে শুক্রাণু নিয়েও অনায়াসেই মা হওয়া সম্ভব। যেটা প্রয়োজন সেটা হল একলা সন্তান পালনের উপযুক্ত মানসিক দৃঢ়তা, অর্থনৈতিক জোর এবং উদার চিন্তাভাবনা। মেয়েরা এখন ক্রমশ তাদের চারপাশের বেড়া ভেঙে বেরোচ্ছে বলে আরও অনেক কিছুর মতোই নিজের শরীর থেকে সৃষ্ট সন্তানকে মাতৃপরিচয় দেওয়ার দাবিও তাদের ভিতর থেকে উঠে আসছে। একজন আধুনিক নারীর পক্ষে নিশ্চিত এই দাবি খুবই সঙ্গত।
আর বিয়ের সঙ্গে মাতৃত্বের যে সত্যিই সেভাবে কোনও সম্পর্ক নেই, সেরকম উদাহরণ তো আমাদের চোখের সামনেই আছে। ভগিনী নিবেদিতা তো বিবাহিতা ছিলেন না। তিনি তো অসংখ্য মানুষকে সন্তান-স্নেহে সেবা করেছেন। শ্রীমা ছিলেন রামকৃষ্ণ দেবের সাধনসঙ্গিনী। স্বামী সংসর্গে সন্তানের তাঁর প্রয়োজন হয়নি। আজও অসংখ্যমানুষ তাঁকে মাতৃজ্ঞানেই পুজো করে।