সত্যিটা জানুন, জেনে কথা বলুন

স্বাধীনতার আগে এবং পরবর্তী কয়েক দশকে অন্য রাজ্যের শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতেন পশ্চিমবঙ্গে। এ-রাজ্য থেকে তার তুলনায় সংখ্যায় কম কিছু দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক বাইরের রাজ্যে কাজে যেতেন। এখনও সেই ধারাই বহমান। লিখছেন অনির্বাণ সাহা

Must read

পরিযায়ী শ্রমিক (migrant worker) নিয়ে রাজ্যের বিরোধীদের বক্তব্যের শেষ নেই। তাঁরা ভাবেন, দেখাতে চান আর তাই বলতে ভালবাসেন, রাজ্যে একটি শ্রমিক-বিরোধী সরকার বর্তমানে শাসন কার্য পরিচালনা করছে। এই জগাই-মাধাই-গদাইদের মধ্যে ‘অফিসিয়ালি’ পুটকিহীন রামেরা আর একটু রং চড়িয়ে বলেন, ৩৪ বছরের বাম শাসনাধীন পশ্চিমবঙ্গে হাতে হাতে কাজ ছিল, তাই পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কম ছিল। কথাটি সর্বৈব মিথ্যা। তথ্য ও উপাত্ত স্পষ্টত সেই ইঙ্গিত করছে।
১. গত ১৪ বছরে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে রাজ্যে।
এবং ২. এই সংখ্যাটা ৪৫ শতাংশ বেড়েছিল বাম জমানার শেষপাদে।
বিস্তারিত তথ্যে নজর রাখলেই বিষয়টা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে। সংশয়ের অবকাশ একেবারেই থাকবে না।
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকের (migrant worker) সংখ্যার বিচারে দেশের মধ্যে শীর্ষে উত্তরপ্রদেশ। সে-রাজ্যের অন্তত ১.২৩ কোটি শ্রমিক ভিন‌রাজ্যে কর্মরত ছিলেন সেই সময়ে। বর্তমানে যোগী আদিত্যনাথের আমলে সেই সংখ্যাটা কত, তার কোনও সরকারি হিসাব প্রকাশ্যে বা পাবলিক ডোমেইনে নেই। সুতরাং সর্বশেষ যে তথ্য পাচ্ছি, সেই ২০১১ সালের জনগণনার তথ্য অনুযায়ী, পরিযায়ী শ্রমিকের তালিকায় উত্তরপ্রদেশের পরেই ছিল বিহার এবং তার পরেই রাজস্থান। পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল সাত নম্বরে।
সেই সময়ে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ২৪.০৫ লাখ। তাঁদের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যাই বেশি, ১৪.৫২ লাখ। পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ৯.৫৩ লাখ। কিন্তু গত ১৪ বছরে মা-মাটি-মানুষের সরকার গঠিত হওয়ার পর রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে! রাজ্যের ‘কর্মসাথী’ প্রকল্প অনুযায়ী, নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লক্ষ ৪০ হাজার।
যদিও বিরোধীদের মতে, নাম লেখানো নেই, এমন অংশ ধরলে বাইরে কর্মরতদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি।
সত্যি কথা। সেটা বাস্তব। রাজ্যের শ্রম দফতরও স্বীকার করছে, যে সংখ্যাটা বলা হচ্ছে, সেটি নথিভুক্ত। এমন পরিযায়ী শ্রমিকও রয়েছেন, যাঁদের নাম নথিভুক্ত নয়।
সেটা যেমন সত্যি, তেমনই এটাও তো মিথ্যে নয় যে, অতিমারি কালের পর রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে সরকারের খাতায় নাম নথিভুক্ত করার একটা প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। ফলে ফারাক খুব বেশি হওয়ার কথা নয়। সংখ্যাটা বড়জোর ২-৪ লাখ কমবেশি হবে।
আবার ২০১১ সালের জনগণনায় উঠে আসা তথ্য বলছে, বাম জমানার শেষের দিকে রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছিল। ২০০১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, রাজ্যে যত জন পরিযায়ী শ্রমিক ছিল, সেই সংখ্যাটা ৪৫ শতাংশ অর্থাৎ ৭.১৮ লক্ষেরও বেশি বৃদ্ধি পায় ২০১১-তে। সে তুলনায় রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কিছুটা হলেও কমেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে। রাজ্যের ‘কর্মসাথী’ প্রকল্প অনুযায়ী, নথিভুক্ত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লক্ষ ৪০ হাজার। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই হিসাব দিয়েছেন। অর্থাৎ, রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে অন্তত ১ লাখ ৬৫ হাজার।

আরও পড়ুন-অসমে হিমন্ত সরকারের তীব্র বাংলা বিদ্বেষ ডি-ভোটার তালিকায় রাখা হল বাঙালিদের

ভিন‌রাজ্যে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের (migrant worker) উপর হেনস্থার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতার সরকার। মূলত বিজেপি-শাসিত রাজ্যেই বাংলার শ্রমিকেরা আক্রান্ত হচ্ছেন। নথি-পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও তাঁদের অকারণে পাকড়াও করা হচ্ছে। আটকে রাখা হচ্ছে দিনের পর দিন। বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে অনেককে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভিন‌রাজ্যে ‘আক্রান্তের শিকার’ বহু পরিযায়ী শ্রমিক বাংলায় ফিরে এসেছেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের উদ্যোগে।
পরিযায়ী শ্রমিকদের রাজ্যে ফিরে আসার জন্য উৎসাহ দিতে ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্প ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এই প্রকল্প অনুযায়ী, রাজ্যে ফিরে এলে পরিযায়ী শ্রমিকেরা মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা পাবেন। বেশ কিছু দিন ধরেই পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছিল ‘কর্মসাথী’ প্রকল্পে। তার জন্য চালু আছে একটি পোর্টাল। প্রাথমিক ভাবে ঠিক হয়েছে, এই দুই পোর্টালের সেতুবন্ধন করে তথ্য মেলানো হবে। তাহলেই বোঝা যাবে, বিরোধীদের বক্তব্যের অসারতা।
‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্প ঘোষণার পর মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘যাঁরা ফিরবেন, তাঁরা ভ্রমণ সহায়তা-সহ এককালীন পাঁচ হাজার টাকা করে পাবেন। পুনর্বাসন ভাতা এটা। এর মানে এক বছর, নতুন কাজের ব্যবস্থা না-হওয়া পর্যন্ত আর্থিক সাহায্য দেওয়া হবে। বাংলায় যে ২২ লক্ষ ৪০ হাজার শ্রমিক বাইরে আছেন, তাঁরা সকলে ‘শ্রমশ্রী’র সুবিধা পাবেন। যাঁরা করেননি, তাঁরা নাম নথিভুক্ত করতে পারবেন।’ জানিয়ে ছিলেন, রাজ্যের ‘উৎকর্ষ বাংলা’ প্রকল্পের আওতায় শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকেরাও তার সুবিধা পাবেন।
অর্থাৎ, ফিরে আসা শ্রমিকদের কার কী দক্ষতা আছে, প্রথমে সেটা দেখা হবে। দক্ষতা থাকলে দরকারে প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। এ ছাড়া আমরা ‘জব কার্ড’ দেব। কর্মশ্রী প্রকল্পে ৭৮ লক্ষ জব কার্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। রাজ্যে সরকার পরিযায়ী শ্রমিকদের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যসাথী কার্ড দেবে। স্বাস্থ্যসাথী থাকবে। বাড়ি না-থাকলে কমিউনিটি সেন্টারে থাকার ব্যবস্থা হবে। স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করা হবে তাঁদের ছেলেমেয়েদের। কন্যাশ্রী, শিক্ষাশ্রীর সুবিধাও পাবেন তাঁরা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। শ্রমশ্রী পোর্টালে নাম তুললে তাঁদের একটা আই কার্ড দিয়ে দেওয়া হবে। সেই সূত্রেই রাজ্য সরকারের সুযোগসুবিধা পাবেন তাঁরা।
স্মর্তব্য, ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করে কেউ যদি বাড়তি রোজগারের আশায় ভিন্‌রাজ্যে চলে যান, সেক্ষেত্রে সরকারি অর্থ অপচয়েরও আশঙ্কা থাকছে। সরকারের তীক্ষ্ণ নজর তাই এই বিষয়টার ওপরেও থাকবে।
২১ অগাস্ট থেকে এই বিষয়ে কাজ শুরু করছে শ্রম দফতর। পোর্টাল চালু হলে পরিযায়ী শ্রমিকদের তাতে অন্তর্ভুক্তির কাজ শুরু হবে। কিন্তু তার আগে যেসব পরিযায়ী শ্রমিক ইতিমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে ফিরে এসেছেন, তাঁদের অফলাইনে এই প্রকল্পের অধীনে আনার কাজ শুরু করে দেওয়া হয়। শ্রম দফতর প্রতিনিধিরা জেলায় জেলায় শিবির করে প্রাথমিক ভাবে এই কাজ শুরু করছেন। মুর্শিদাবাদ, মালদহ এবং উত্তর দিনাজপুরে বহু পরিযায়ী শ্রমিক ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে এসেছেন। মূলত এই জেলাগুলিতেই শ্রম দফতরের প্রতিনিধিরা তাঁদের কাছে গিয়ে শ্রমশ্রী প্রকল্পে তাঁদের নাম নথিভুক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন।
পরিশেষে, স্বাধীনতার আগে এবং পরবর্তী কয়েক দশকে অন্য রাজ্যের শ্রমিকেরা কাজ করতে আসতেন পশ্চিমবঙ্গে। এ রাজ্য থেকে কিছু দক্ষ ও অভিজ্ঞ শ্রমিক বাইরের রাজ্যে কাজে যেতেন। যাঁরা এখান থেকে ভিন রাজ্যে যেতেন তাঁদের চেয়ে ভিন রাজ্য থেকে এখানে আগত পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি। এখনও সেই ধারাই বহমান। পরিস্থিতি উল্টে যায়নি। মিথ্যে প্রচার করে লাভ নেই।
আর একটা কথা। কোনও অজুহাতেই ভোটার তালিকায় পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম নিজ রাজ্যের বাসস্থান এলাকা থেকে বাদ দেওয়া চলবে না।

Latest article