গেরুয়া রং তো শক্তি ও সাহসের প্রতীক। তাহলে গেরুয়াকরণ নিয়ে এত সমস্যা কীসের? এ প্রশ্নটা সাধারণ মানুষের কাছে আজ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আসলে সমস্যাটা উদ্দেশ্য ও ভাবাদর্শ নিয়ে! ২০১৭ সালের ২২ সেপ্টেম্বর, ভারতের বিদেশ মন্ত্রক ‘অখণ্ড মানবতাবাদ’ শিরোনামের একটি ই-বই প্রকাশ করে। উপলক্ষ ছিল জনসংঘের প্রতিষ্ঠাতা ও আরএসএস-এর ভাবপ্রধান দিনদয়াল উপাধ্যায়ের জন্মবার্ষিকী পালন। উক্ত গ্রন্থে হিন্দু ভাবনাকে ভারতের ভাবনা বলা হয়। মনে রাখা জরুরি এই অখণ্ড মানবতাবাদ বিজেপির রাজনৈতিক দলের ভাবাদর্শ। আবার উক্ত গ্রন্থ উদ্বোধনকালে তৎকালীন মন্ত্রী প্রয়াত সুষমা স্বরাজ ভারতের জন্য একমাত্র বিকল্প হিসেবে বিজেপির (Modi Government) কথা বলেন। এতেও তো সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না, সমস্যাটা হল ওই লেখনীর মাধ্যমে বিজেপির ভাবাদর্শকে ভারতের ভাবাদর্শ বলে প্রচার-প্রসার করা এবং বাকি রাজনৈতিক ভাবাদর্শ বা সাধারণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক চেতনা, ঐতিহ্য প্রভৃতিকে অস্বীকার করার কৌশল হিসাবে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহার করা হয়।
ভারত বিশ্বাস করে বহুসংস্কৃতিবাদ, সার্বজনীনতা ও অন্তর্ভুক্তিতে (inclusion)। সংবিধানেও তাই জাতির অখণ্ডতা-বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য, ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিটি বিদেশ সফরে বা বিদেশি প্রতিনিধি ভারতে এলে ভারতের তরফ থেকে বিদেশিদের গীতা উপহার দেওয়া হয়, তখন প্রশ্ন জাগে গেরুয়াকরণের উদ্দেশ্য ও ভাবাদর্শ নিয়ে! প্রধানমন্ত্রীর একমুখী ধর্মপ্রাণ ভাবকে সরকারি অর্থ নয়ছয় করে প্রচার-প্রসার করা এর আর এক পন্থা।
বলবান জাতীয়তা, অতিমানব চর্চা, গোষ্ঠীপতি ক্ষমতা (pastoral power) প্রভৃতি প্রচারের মাধ্যমে যে শক্তিশালী রক্ষকের তথা শাসকের হাতে দেশরক্ষার নামে মোদি সরকার ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করছে। যার অন্যতম লক্ষণ, পুলওয়ামা সন্ত্রাসের ঘটনায় মৃত ৪০ জন শহিদের বা বালাকোটে প্রতিঘাত করা জওয়ানদের নামে ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসে মহারাষ্ট্রের লাটুরে ভোট চাওয়া। কিন্তু জম্মু কাশ্মীরের বিজেপির নিযুক্ত প্রাক্তন রাজ্যপাল সত্যপাল সিং যখন বলেন যে, পুলওয়ামার ঘটনা সরকারের গাফিলতির ফল, তখন তিনি কেন্দ্রীয় এজেন্সির হয়রানির শিকার হন। অন্য দিকে বিরোধীরা সনাতনী ধর্ম নিশ্চিহ্ন করে চলেছে (২০ নভেম্বর, ২০২৩, রাজস্থানে ভোট প্রচার কালে মোদির উক্তি) আর তিনি বা বিজেপি একমাত্র রক্ষাকর্তা! এ এক ভয়ঙ্কর মেগালোমানিক প্রবণতা।
সরকারি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে নিজের দলকে একমাত্র বিকল্প করা আর বিরোধীদের প্রশ্নকে দেশ-বিরোধী বলে দাগিয়ে দেওয়ার যে প্রবণতা গেরুয়াকরণের (Modi Government) মাধ্যমে চলছে তা-ও দ্রষ্টব্য। আবার কোনও প্রতিবেশী দেশকে চিরায়ত শত্রু চিহ্নিত করে দেশ সুরক্ষার মাসিহা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করাও সেই গেরুয়াকরণের অংশ। কিন্তু মোদি নিজে হঠাৎ করে পাকিস্তান চলে গিয়ে বিরিয়ানি খেলে বা ভারতেও প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানালে ক্ষতি নেই! কিংবা ১৯৯৬ সালে তাদের দল ক্ষমতায় থাকাকালীন পাকিস্তানকে সব থেকে ভাল বন্ধুর (MFN) মর্যাদা দেওয়া, যা ২০১৯ অবধি বজায় ছিল; কিংবা লাহোর বাসযাত্রা শুরু হলে; ২০১৮ সালের পর ২০২২ সালে জয় শাহ ভারতীয় ক্রিকেট সংস্থার প্রধান হওয়ার পর এশিয়া কাপে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ হলে সেটা ভারতের ভালর জন্যই হয়।
আবার অরুণাচল প্রদেশের কিছু অংশে চিন সেনাছাউনি তৈরি করলে, বা তাদের সরকারি ম্যাপে অরুণাচল তাদের অংশ বলে দেখালে মোদি চুপ থাকেন। বরং সরকারি বিবৃতি দিয়ে বলা হয় এমন কোনও ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে বিষয়টির সত্যতা ও চিনের স্বীকারোক্তির পর মোদি সরকার ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়। কিন্তু সে-দেশের থেকেই বল্লভভাই প্যাটেলের মূর্তি বানানোর সরঞ্জাম আমদানি করেন। কিন্তু প্রচার করেন মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্পের! আসলে শক্তের ভক্ত! বস্তুত, এমন এক ভাবনা বা চেতনা তৈরি করা যাতে মনে হয় তারাই ভারতের ভাল চায়; বাকি সব দল বা বিজেপি-বিরোধী শক্তি দেশকে, দেশের ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেবে। এই বিযুক্তীকরণের (exclusion) যে পরিকল্পিত প্রয়াস বিজেপি গেরুয়াকরণের মাধ্যমে চালাচ্ছে তার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আবশ্যক।
কিন্তু প্রতিবাদ করলেও সমস্যা। দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গেরুয়াকরণ নিয়ে সরব হলে, বিজেপি ও গোদি মিডিয়া তৃণমূলকে মৌলবাদী (বিজেপি মুখপাত্র, শমীক ভট্টাচার্য, ১৯.১১.২৩) বা রোহিঙ্গা ভোটকাঙ্ক্ষী (বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, ১৯.১১.২৩) বলে দাগিয়ে দেয়। সেই বিজেপি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মহম্মদ শামি খারাপ বল করলে তাঁকে মুসলিম বলে উত্ত্যক্ত করে। আবার কোনও বড় মুসলিম অভিনেতা বিজেপির মুসলিম-বিদ্বেষ নিয়ে অভিযোগ করলে তাঁকে বলে পাকিস্তান চলে যেতে। আবার কখনও জাতপাত বিভাজন মারাত্মক আকার নিচ্ছে। যার উদাহরণ মিড-ডে মিলের খাওয়ার আলাদা থালা— উচুঁ জাতির জন্য এক ব্যবস্থা নিচু জাতির জন্য আলাদা।
বিজেপি ভারতের ইতিহাসকে নতুনভাবে লিখতে চাইছে, যা হবে গেরুয়াকরণ ও নমোকরণের ইতিহাস। সেই কারণেই কেন্দ্র স্কুলপাঠ্য বইয়ের সমাজ বিজ্ঞানের সিলেবাস থেকে গান্ধীর হত্যা, আরএসএসের নিষিদ্ধকরণ, ২০০২-এর গুজরাট দাঙ্গা প্রভৃতি অংশ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। আবার ‘Democracy and Diversity’, ‘Popular Struggles and Movements’, ‘Challenges to Democracy’ প্রভৃতি অংশ বাদ দেওয়ার প্রস্তাব নেয় এনসিইআরটি। এ ছাড়াও ডারউইনের তত্ত্ব-সহ বহু বৈজ্ঞানিক প্রসঙ্গ বাতিলের কথা হয়েছে। অন্যদিকে, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে আম্বেদকর, গান্ধী, ইকবাল-সহ সংবিধানের কিছু অংশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এবং দলিত লেখক বামা ও সুকির্থারানার পাঠ্য ইংরেজি সিলেবাস থেকে বাদ দেওয়া হয়। এমনভাবেই ভারতের নানান কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাস তাদের বিভাজিত যুক্তিতে পরিবর্তন করে। তাদের আদি গুরু হেগড়েওয়ার-সহ সাভারকারকে অন্তর্ভুক্ত করার তাগিদ দেখা যায়।
মোদির (Modi Government) ভারত আইনবিভাগ, শাসনবিভাগকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে গেরুয়াকরণের প্রক্রিয়াকে স্থায়ীরূপ দিতে চাইছে। তাই ৩৭০ ধারা বাতিল করে কাশ্মীরী পণ্ডিতদের উদ্ধারকর্তা বলে মোদিবন্দনা চালু হয়েছে। কিন্তু পণ্ডিতদের লক্ষণীয় উপকার হয়নি। আসলে নির্যাতনের মিথ্যা ইতিহাস তুলে ধরে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপের ফেরিওয়ালা গোয়েবেলসের মতোই বারবার মিথ্যা বলে ফাসিবাদকেই সামনে নিয়ে আসছে। যার আর এক উদাহরণ সিএএ। কখনও আবার বিশ্বাসের ভিত্তিতে বিচার দেওয়া বিচারক রাজ্যসভায় জায়গা পাচ্ছেন। ফলে বিচার বিভাগকেও প্রভাবিত করার প্রয়াস। কিন্তু সব নরেন বিবেক দিয়ে কথা বলে না। গেরুয়া মানেই রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের বা ভারতের পতাকার রং নয়। এই গেরুয়াকরণ বিভাজনের (হিন্দু-মুসলিম বা উঁচু-নিচু জাত), সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের। তাই আজ আমাদের স্বামী বিবেকানন্দ তথা প্রকৃত নরেনের The Future of India জানা খুব জরুরি। যেখানে INDIAই পথ দেখাবে।
আরও পড়ুন- ৪ জনকে জেলে ঢুকিয়েছে ওদের ৮ জনকে ঢোকাব