চোদ্দো হাজার বছরের তপস্যায় শিব সন্তুষ্ট হয়ে সাড়া দিলেন হিরণ্যতেজার প্রার্থনায়। দেবতারা যেন পাথরের তৈরি, অনেক দিনের চেষ্টায় তাঁদের টলানো যায়। কিংবা এ এক সফলতার গল্প— যার পিছনে শুধু মাত্র বিজ্ঞাপনের প্রকাশনী নয় লুকিয়ে থাকে এক দৃঢ় পাখির চোখ সংকল্প, প্রাণপাত পরিশ্রম এবং এগিয়ে যাওয়ার ঋজু মনোভাব। হিরণ্যতেজার প্রয়োজনে শিবের ইচ্ছায় মহাকাল পর্বত থেকে পৃথিবীতে নামলেন তিনি। শিব তাঁর চলার ছন্দে, তাঁর দর্শনে পুণ্য নামে মোক্ষ। যিনি সততার সাথে পুণ্য আর মোক্ষের দিশারি তিনিই তো প্রকৃত আনন্দ দাতা— নর্ম দা।
পৃথিবীর নানা রকমের ভূমিরূপ যেমন পাহাড় পর্বত, নদীখাত, সাগর, হ্রদ আর যত ঝঞ্ঝাট যেমন ভূমিকম্প, সুনামি সবই নাকি টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়া আর ঠোকাঠুকির ফল। মাটির নিচের পৃথিবী নাকি এমন ক’টা ভেসে বেড়ানো প্লেট দিয়ে তৈরি। দুটো প্লেট কাছাকাছি এলে চাপে পৃথিবীর উপরের চামড়া কাছে চলে এসে ভাঁজ খেয়ে একটু উঁচু হয়, একে বলে স্তূপ পর্বত। ঠিক তার পাশেই চামড়ায় টান পড়ে আর জায়গাটা একটু বসে গিয়ে তৈরি করে গ্রস্ত উপত্যকার। ভারতে এরকম স্তূপ পর্বত হল সাতপুরা আর তার পাশেই তৈরি হওয়া গ্রস্ত উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলেছে নর্মদা নদী (Narmada River)। জমির ঢাল অনুযায়ী নর্মদা বয়ে চলেছে পশ্চিম দিকে আরব সাগরের পথে। এই যাত্রাপথই তাকে ভারতের সব নদীর থেকে আলাদা করেছে। সবাই সূর্যমুখী মানে পুবের পথে, ইনি একা আলাদা পশ্চিম বাহিনী।
স্কন্দ পুরাণের রেবা খণ্ডে রয়েছে নর্মদার (Narmada River) কথা। কখনও জানা যায় অসুরেরা বেদকে নর্মদা গর্ভে নিক্ষেপ করেছিল, বিষ্ণু সেই মধু ও কৈটভকে হত্যা করে বেদ উদ্ধার করেছিলেন। এজন্য নর্মদাকে বেদগর্ভা বলা হয়। স্বয়ং শিবের বরে নর্মদা আত্মশক্তির অধিকারিণী তাই তাঁর তীরে সমস্ত দেবদেবী এবং মুনিঋষিগণ তপস্যা করে সিদ্ধ হয়েছেন। ভোগন্মুখী জীব নর্মদা-দর্শনেই মুক্তি লাভ করে। বছরে একবার গঙ্গা স্বয়ং নর্মদার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। গঙ্গা যখন মানুষের পাপ বহন করতে করতে ম্রিয়মাণ হয়ে ওঠেন তখন তিনি আত্মশুদ্ধির জন্য নর্মদায় স্নান করে যান। শিবকল্প মহাযোগী বাবা লোকনাথ দেখেছিলেন একটি কালো গরু সূর্যাস্তের পূর্বে নর্মদায় নেমে স্নান করে সাদা হয়ে ফিরে যাচ্ছে। বিশেষ যোগবলে তিনি জানতে পারলেন উনি স্বয়ং মা গঙ্গা। তাই নর্মদা সরিতাং শ্রেষ্ঠ, নর্মদা রুদ্রতেজসম্ভবা— শিবের মানসকন্যা।
টলেমির নাম্মাদাস, ব্রিটিশদের নর্বুদ্দা বা নর্বাদা আমাদের নর্মদা (Narmada River)। নর্মদা শব্দের অর্থ আনন্দদায়িনী। রেওয়া বা রেবা নর্মদার অপর নাম এসেছে পাথুরে গহ্বর পথ দিয়ে চলা কিংবা তীব্র বেগে ভীষণ শব্দে (রব) পথচলার জন্য। অমরকণ্টক পাহাড়ের নর্মদাকুণ্ড থেকে নর্মদা সৃষ্টি হয়ে দীর্ঘ তেরশো কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে গুজরাটের ভারুচের কাছে খাম্বাত উপসাগরে মিলেছে। গতিপথের অনন্যতা মতো শেষ ভাগেও সবার চেয়ে আলাদা, নদীমুখে নেই কোনও বদ্বীপ। গোটা পথে নর্মদাকে দেওয়া হয় দেবীর মর্যাদা— পুজোপাঠ, সন্ধ্যারতি, নদীবন্দনা এবং নর্মদার তীরে গড়ে ওঠা প্রচুর শৈবক্ষেত্র নর্মদা মায়ের মুকুটের রত্নরাজি। নর্মদার প্রবাহপথের পুরো অংশেই শিবের উপস্থিতি। কন্যার সাথে পিতার অচ্ছেদ্য বন্ধন।
কথায় আছে না নর্মদা কে কংকর উতরে শঙ্কর। নর্মদার জল থেকে পাওয়া পাথর ভগবান শিবের প্রতিভূ— শিবলিঙ্গ। লিঙ্গকে অঙ্গের ভাবনায় আনা হয় ঠিকই আসলে কিন্তু লিঙ্গ অর্থাৎ চিহ্ন— পরমেশ্বর ভগবানের নির্গুণ প্রতীক। বিষ্ণুর প্রতীক যেমন শালগ্রাম শিলা। এই শালগ্রাম শিলা বজ্রকীটের ফসিলে পাওয়া যায় নেপালের কালীগণ্ডকির জলে তেমনি নর্মদার জলে পাওয়া যায় বিশেষ শিবলিঙ্গ যার নাম বাণলিঙ্গ। নর্মদা গর্ভের পাথর নর্মদার স্রোতে বিশেষ উপবৃত্তাকার আকৃতি পায় আর সেটি বাণলিঙ্গ রূপে সারা ভারতে পুজো করা হয়। অবশ্যই সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুর পরিবর্তন হয়। তাই স্বাভাবিক গতিপথ, স্বাভাবিক স্রোত এসবকে রুদ্ধ করে যখন মানবকল্যাণে নদীকে বাঁধে বেঁধে রাখা হয় তখন নদী হারায় তার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। এখন নদীর স্রোতের বিশেষ ঘর্ষণে নদী গর্ভে সব কংকর শঙ্কর হয় না, নদীর তীরে শিল্পীর হাতে গড়ে ওঠে কৃত্রিম বাণলিঙ্গ। শিল্পী পেটের টানে দেবতা বিক্রি করে মানুষ পুণ্যের টানে দেবতার নামে শিল্প কেনে।
আরও পড়ুন- আজ আসানসোল-কুলটিতে মুখ্যমন্ত্রী
নর্মদেশ্বর শিবের উৎপত্তি কথা মহামুনি মার্কণ্ডেয় স্কন্দপুরাণের আটত্রিশ অধ্যয়ে রেবা খণ্ডে এবং মহেশ্বর খণ্ডে উল্লেখ করেছেন। পুরাকালে দারুবন নামে এক জায়গা দিয়ে উমা এবং শঙ্কর আকাশ পথে যেতে যেতে বেদমন্ত্র শুনতে পান। কৌতূহলী উমা শঙ্করকে জিজ্ঞাসা করেন বেদমন্ত্র শোনা যাচ্ছে। এগুলো কোন আশ্রম? মহেশ্বর বলেন এইখানে কিছু ব্রাহ্মণ বাস করেন তাঁরা গৃহী হয়েও সব ধর্মকর্মাদি করেন। এঁদের পত্নীগণ অধিক মাত্রায় পতিব্রতা। উমা কৌতুকে মহাদেবের কাছে আবদার করেন মদনভাবে ব্রাহ্মণ পত্নীদের বিচলিত করতে। শিব বোঝান এটা অনুচিত, বেদপাঠী ব্রাহ্মণদের রাগ বিষ্ণুর সুদর্শন চক্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। কিন্তু উমা বুঝলে তবে না! বারবার আবদার করায় মহাদেব রাজি হলেন। জটাজুট শোভিত হয়ে অত্যাশ্চর্য রূপ নিয়ে মহাদেব বিপ্রদের ঘরে ঘরে ঘুরলেন। মহাদেবের রমণীমোহন রূপে ব্রাহ্মণীদের মনে কাম কলুষ ভাব জাগল। তাঁরা আলুথালু পোশাকে, খোলা চুলে সন্ন্যাসী রূপ মহাদেবকে ভিক্ষা দেবার জন্য এগিয়ে এলেন। মহাদেব এইভাবে ব্রাহ্মণীদের উত্তেজিত করে উমার কাছে ফিরে এলেন। ঘরে ফিরে ব্রাহ্মণরা তাঁদের ঘরনিদের আনমনা দেখে অবাক হলেন। ধ্যানে জানতে পারলেন মহাদেবের এই তামাশার কথা। রেগে ব্রাহ্মণরা শিবের লিঙ্গ খসে যাওয়ার অভিশাপ দিলেন এবং সত্যি সত্যি শিবলিঙ্গ মাটিতে পড়ল। এর পর শিব নর্মদাতীরে গুহাবাসী হয়ে অর্বুদ বছর তপস্যা করেন এবং লিঙ্গ ফিরে পান। নর্মদার তীরে লিঙ্গ প্রাপ্তি হওয়ায় শিবের আশীর্বাদে নর্মদা গর্ভ থেকে পাওয়া সকল পাথরই শিবলিঙ্গ রূপ পেল। এইসব শিবলিঙ্গের প্রাণ প্রতিষ্ঠার দরকার পড়ে না, নর্মদার জলে অভিষেক হলেই তিনি জাগ্রত হন। এভাবে নর্মদার গর্ভের সকল পাথর হলেন শঙ্কর।
নর্মদা নদীর (Narmada River) তীরে তিনশতাধিক শিবতীর্থ আছে। হয়তো কালের প্রবাহে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের সাথে, নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের জন্য অনেক তীর্থ নর্মদা গর্ভেই বিলীন হয়েছে। গোটা নর্মদার বুক চিরে শিব আর পাড় ধরে শিবমন্দির। শিবময়ী নর্মদাই একমাত্র নদী যার বিধিসম্মত পরিক্রমার বিধান আছে। নর্মদায় তীর্থসেবা করলে সকল তীর্থসেবার ফল পাওয়া যায়। নর্মদাতট কেবল এক নদীর তীরমাত্র নয়, নর্মদাতট পাহাড় বন জঙ্গল বিস্তৃত এক তপোভূমি। শোনা যায় পরিক্রমা কালে মাতা নর্মদা কোনও না কোনও বেশে পরিক্রমাকারীকে দেখা দেন। তখন পরিক্রমাকারী তাঁর জীবনকে এক চিদানন্দে পরিচালনা করতে পারে। জীবের মুক্তির এই যে আনন্দ, অনিত্য সংসার আনন্দ থেকে নিত্য চিদানন্দময় পথে তার বিচরণ, এই পথেই মুক্তিকামী জীব জীবনমুক্তির পথের সন্ধান পায়।