নয়ন রহস্য

ভোটযুদ্ধের মাঝে, গরমের ছুটির ঠিক মুখেই শহরে ফিরছেন গোয়েন্দা ফেলু মিত্তির সঙ্গে জটায়ু আর তপসে। ‘হত্যাপুরী’র পর এবার ফেলুদা করবে ‘নয়ন রহস্য’র কিনারা। আগামী সপ্তাহে মুক্তি পাচ্ছে পরিচালক সন্দীপ রায়ের ফেলুদা সিরিজের নতুন ছবি ‘নয়ন রহস্য’। ছবিতে মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করছেন ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত, অভিজিৎ গুহ এবং আয়ুষ দাস। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

খুড়তুতোভাই তপেশরঞ্জন মিত্র ওরফে তপসের বড় দাদা ফেলু মিত্তির। পেশায় গোয়েন্দা এই মানুষটি তথ্য- প্রযুক্তির ধার ধারেন না, শুধুমাত্র ভূগোল ইতিহাসের অপার জ্ঞানে, মগজাস্ত্রের কেরামতিতে, বাজিমাত করে বেড়ানোই তাঁর স্বভাব। ভাল নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্র। চলনে বলনে নিপাট বাঙালিয়ানায় মোড়া আইকনিক ফেলুদা যার সাধারণ জীবনযাপন এবং মগজাস্ত্রের গুণে গুণমুগ্ধ আপামর পাঠক। ফেলুদার মোহ কেটেও তাঁদের যেন কাটে না। ফি-বছর যখনই রব ওঠে ছবি তৈরি হচ্ছে ফেলুদাকে নিয়ে ওমনি নড়েচড়ে বসেন মোহাচ্ছন্ন পাঠক, দর্শক। গুগলে আপডেটের ফলো আপ করতে করতেই দিন কেটে যায় তাঁদের। কে হবে নতুন ফেলুদা? জটায়ুই বা কে? কোন গল্প এবার? নানান প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে। ফেলুদার স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ও বুঝি ভাবেননি শার্লক হোমস, জেমস বন্ডের আভিজাত্য ত্যাগ করে তাঁর সৃষ্ট নিপাট বাঙালি ভদ্র গোয়েন্দাটি এমন হাইপড হবেন। এমন মগজাস্ত্রের জোর বাঙালি ছাড়া ভূ-ভারতে কারও বিশেষ নেই বললে কিছু বাড়াবাড়ি হবে না।
আসলে গোয়েন্দা চরিত্রগুলোর মধ্যে একটা বেশ ‘বুদ্ধির্যস্য বলম্ তস্য’ গোছের অহঙ্কার রয়েছে তাই গোয়েন্দা গল্প পড়ে একটা ইনার স্যাটিসফ্যাকশন বা অন্তরে তৃপ্তি আসে আর বড়পর্দায় দেখলে সেই তৃপ্তি দ্বিগুণ হয়ে যায় কারণ বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা কল্পনার প্রিয় চরিত্রগুলোকে চোখের সামনে নড়তে চড়তে দেখার অনুভূতি আলাদা হয়। আর ফেলুদার ক্ষেত্রে তাঁর শাণিত বুদ্ধির সঙ্গে নিজের মোটা মগজটা ঝালিয়ে নিয়ে গভীর আনন্দ মেলে। ব্যোমকেশের ক্ষেত্রেও একই। তাই বইয়ের পাতা থেকে গোয়েন্দারা যতবার ছবির পর্দায় উঠে এসছেন জনপ্রিয় হয়েছেন।
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় থেকে সব্যসাচী চক্রবর্তী, পরমব্রত, আবির, টোটা রায়চৌধুরী— কে হননি ফেলু মিত্তির! ছোটপর্দা, ওয়েব সিরিজ সর্বত্র ফেলুর অবাধ বিচরণ। কেউ সাফল্য পেয়েছেন আবার কেউ বিশেষ গ্রহণযোগ্য হননি কিন্তু তাও ফেলুদার চরিত্রের জনপ্রিয়তা কিন্তু কমেনি। সেই কারণে বারবার ফিরেছেন ফেলু।
১৯৬৫ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় প্রথম আত্মপ্রকাশ ফেলু মিত্তিরের। গল্পের নাম ছিল ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’। তারপর থেকে প্রতিবছরই সত্যজিৎ লিখে গেছেন ফেলুদা সিরিজের কোনও না কোনও গল্প। ফেলুদাকে নিয়ে সবমিলিয়ে ৩৫টা গল্প-উপন্যাস লিখেছেন সত্যজিৎ রায়।
ফেলুদাকে নিয়ে তাঁর প্রথম ছবি ‘সোনার কেল্লা’ এবং দ্বিতীয় ছবি ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’। সত্যজিৎকে যাঁরা খুব কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা বলেন তিনি ফেলুদার চিত্রনাট্য লেখার সময় পাশে পাশে সেই চিত্রনাট্যের বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি আঁকতেন। এতটাই নিখুঁত ছিলেন নিজের কাজে। সত্যজিতের ফেলুদা মানেই সৌমিত্র চ্যাটার্জি। তাঁর কথা বলার স্টাইল, চেহারা তাকানো, চোখের চাহনি, মগজের প্রখরতা— সবকিছুই যেন কাল্পনিক ফেলুদার সঙ্গে মিলে যায়। এমন রাজযোটক মিল সবসময় ঘটে না তাই ফেলুদাকে নিয়ে ছবি করার ক্ষেত্রে সবচেয়ে কঠিন কাজ হল ফেলুদাকে খুঁজে বার করা।
সত্যজিৎ-পুত্র চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায় প্রথম ফেলুদা তৈরি করেছিলেন সব্যসাচী চক্রবর্তীকে নিয়ে। ‘বাক্স রহস্য’, ‘ফেলুদা ৩০’, ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে’, ‘কৈলাসে কেলেঙ্কারী’, ‘টিন্টরেটর যীশু’, ‘গোরস্থানে সাবধান’, ‘রয়্যাল বেঙ্গল রহস্য’তে সফল ফেলুদা হয়েছেন সব্যসাচী।
কিন্তু গল্পের ফেলুদার বয়স না বাড়লেও ছবির ফেলু মিত্তিরের বয়স বেড়েছে। অথচ দর্শকের দাবিতে বারবার যে তাঁকে ফিরতেই হবে। সন্দীপ রায়ের দ্বিতীয় ফেলুদা হলেন অভিনেতা ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত। সব্যসাচীর চক্রবর্তীর অসাধারণ সেলুলয়েড উপস্থাপন, মেজাজি চেহারার পরে ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত যেন নতুন করে যৌবনের ফেলুদায় ফিরিয়ে নিয়ে গেল দর্শকদের। ২০২২-এ সন্দীপ রায়ের ‘হত্যাপুরী’-তে ইন্দ্রনীল ফেলুদা হিসেবে যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছিলেন। এবার আবার ফিরলেন তিনি সন্দীপ রায়ের ‘নয়ন রহস্য’-এ (Nayan Rahasya)। কাজেই ফেলুদা আছে এবং থাকবে।
সদ্য ট্রেলার লঞ্চ হয়েছে এই ছবির। সুরিন্দর সিং, নিসপাল সিং প্রযোজিত ছবিটি তৈরি হয়েছে একটি ছোট্ট ছেলের অন্তর্ধান নিয়ে। মূল গল্পকে এক রেখে আজকের সময়ের নিরিখে আধুনিক ফেলুদাকে নিয়ে পরিচালক তৈরি করেছেন ‘নয়ন রহস্য’। আজকের পটভূমিতে ফেলেছেন গল্পকে। ছবিতে টিম ফেলুদা একই আছে। জটায়ু ওরফে লালমোহন গাঙ্গুলি এবং তপসের চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিজিৎ গুহ এবং আয়ুষ দাশ। হত্যাপুরীতেও তাঁরাই ছিলেন। ইন্দ্রনীল ফেলুদা হিসেবে ভালই, তবে তপসে আর জটায়ুকে নিয়ে সত্যজিৎ রায় যতটা ভেবেছিলেন বাকি পরিচালকরা ততটা ভাবেন বলে মনে হয় না। সন্দীপ রায়ের ক্ষেত্রেও বিষয়টা তেমনই। এই দুটো চরিত্রকে দারুণ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ।
ছবিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয় করেছেন বলিউডের মোহন আগাসে। এ-ছাড়া রয়েছেন কার্ল অ্যান্ড্রু হার্ট, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, রাজেশ শর্মা, শুভ্রজিৎ দত্ত প্রমুখ নামী অভিনেতারা। যাকে ঘিরে এই অন্তর্ধানের খেলা সেই জ্যোতিষ্ক অর্থাৎ ‘নয়ন রহস্য’র (Nayan Rahasya) নয়ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন অভিনব বড়ুয়া। অভিনব ক্লাস সিক্সের ছাত্র।
গল্পটা হল ফেলুদা, তপসে, জটায়ু গিয়েছেন সুনীল তরফদার নামক এক তরুণ জাদুকরের শো দেখতে। যে জাদুকর নিজের সম্মোহনী শক্তি দিয়ে সবাইকে অবাক করে দেয়। তবে তার চেয়েও বড় চমক অপেক্ষা করছিল। দর্শকের সামনে তিনি হাজির করলেন জ্যোতিষ্ক নামক এক অসাধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ছেলেকে। যাকে সংখ্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেকোনও প্রশ্ন করলেই সে তার উত্তর দিয়ে দিতে পারে। যা দেখে ফেলুদা পর্যন্ত থ বনে গেলেন। সেই জ্যোতিষ্কোর অন্তর্ধান এবং হিঙ্গোয়ানির মৃত্যুর রহস্যের কীভাবে কিনারা করবে ফেলুদার মগজাস্ত্র বড়পর্দায় সেটাই দেখবে দর্শক। গরমের ছুটি জমজমাট কারণ আর মাত্র কিছুদিনের অপেক্ষা ছবির মুক্তিতে।

আরও পড়ুন- ১৯ বছরে দেশের ১১৫ আইআইটি পড়ুয়া আত্মঘাতী

Latest article