নেক্রোবোটিক্স

বিজ্ঞানের হাত থেকে আজ মুক্তি নেই মৃত প্রাণীরও। কারণ, মৃত মাকড়সা থেকে তৈরি হচ্ছে শক্তিশালী গ্রিপার। মৃত মাকড়সা পরিণত হচ্ছে যন্ত্রচালিত রোবটে। মৃতদেহকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে তৈরি করা হচ্ছে এসব, তারই ব্যাখ্যা দিলেন প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

বর্তমান যুগে যে মানুষ ক্রমশই যন্ত্রনির্ভর হয়ে পড়ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে তার প্রভাব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আমরা মশলা বাটি মিক্সিতে, কাপড় কাচি ওয়াশিং মেশিনে, ঘর পরিষ্কার করি ভ্যাকিউম ক্লিনার দিয়ে, এসব ছাড়াও রয়েছে আরও কত কি! মানুষের যন্ত্রনির্ভরতার আরও একটি উদাহরণ হল রোবটের আবিষ্কার। রোবটের কথা যখন উঠলই তখন এই রোবটিক্সের আর একটি দিক যা এখন বেশ চর্চায় রয়েছে তা হল নেক্রোবোটিক্স (Necrobotics), তার সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক।

নেক্রোবোটিক্স-এর অর্থ কী?
নেক্রোবোটিক্স (Necrobotics) হল রোবোটিক উপাদান হিসাবে জৈব পদার্থ (বা মৃত জীব) ব্যবহার করার অনুশীলন। ২০২২ সালের জুলাই মাসে, টেক্সাসের হিউস্টনের রাইস ইউনিভার্সিটির প্রিস্টন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকদের অ্যাডভান্সড সায়েন্স-এ প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রে প্রথম এই ধারণাটি উপস্থাপিত হয় যে কোনও মৃত মাকড়সাকে রোবোটিক গ্রিপার হিসাবে পুনরায় ব্যবহার করা সম্ভব, এবং তাদের আঁকড়ে থাকা বাহুগুলিতে বায়ুচাপ প্রয়োগ করলে তারা সক্রিয়তা প্রদর্শনের পাশাপাশি আঁকড়ে থাকার ক্ষমতাও প্রদর্শন করে।
নেক্রোবোটিক্স একটি দক্ষ এবং সহজ গ্রিপার সিস্টেম তৈরি করতে মাকড়সার জৈব হাইড্রোলিক সিস্টেম এবং তাদের কমপ্যাক্ট পাগুলিকে ব্যবহার করে। নেক্রোবোটিক স্পাইডার গ্রিপার ছোটো এবং হালকা বস্তু তুলতে সক্ষম, যার ফলে জটিল এবং ব্যয়বহুল ছোট যান্ত্রিক গ্রিপারের বিকল্প হিসেবে এদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

নেক্রোবোটিক্সে (Necrobotics) মাকড়সার শরীরের প্রধান আকর্ষণ হল এর কমপ্যাক্ট পায়ের কার্যপদ্ধতি এবং তাদের দেহে প্রবাহিত তরলের চাপ অর্থাৎ হাইড্রোলিক চাপের ব্যবহার। আগেই বলা হয়েছে যে মাকড়সা তাদের দেহে প্রবাহিত তরলের চাপকে ব্যবহার করে। মাকড়সার পায়ে থাকা নমনীয় ফ্লেক্সের পেশি স্বভাবতই যখন শিথিল হয়, তখন তাদের পা সংকুচিত করতে সাহায্য করে। তবে তাদের পা সোজা এবং প্রসারিত করার জন্য একটি শক্তির প্রয়োজন হয়, যা মাকড়সা তাদের পায়ের সন্ধিগুলিতে হেমোলিম্ফ তরল (রক্ত) পাম্প করে ফলে হাইড্রোলিক চাপের দ্বারা তাদের পায়ের সম্প্রসারণ সম্পন্ন করে। তাদের ফ্লেক্সের পেশির স্বাভাবিক কার্যকারিতার জন্য আবার কোনওরকম বাহ্যিক শক্তি প্রয়োগ না করেই তাদের পা আবার যথাস্থানে ফিরে আসে বা তাদের সংকোচন ঘটে।

২০২২ সালের জুলাই মাসে, রাইস ইউনিভার্সিটির প্রিস্টন ইনোভেশন ল্যাবের গবেষকরা গ্রিপার নিয়ে তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিবরণ দিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। যদিও মৃত মাকড়সার দেহ আর হিমোলিম্ফ তৈরি করে না, টে ফায়ে ইয়াপ নামক এক বিজ্ঞানী যা এই গবেষণাপত্রটির ও প্রধান লেখক লক্ষ্য করেন যে মাকড়সার সেফালোথোরাক্সে একটি সুঁচের মাধ্যমে শুধুমাত্র বায়ু পাম্প করে প্রবেশ করালেও তা হিমোলিম্ফের মতোই ফলাফল দেয়। অর্থাৎ মাকড়সার পা ঠিক একই রীতিতে প্রসারিত হতে পারে তাই তার এই গবেষণা এটি প্রমাণ করে যে মৃত মাকড়সায় মূল হাইড্রোলিক (তরল) সিস্টেমটি মূলত একটি নিউম্যাটিক (বায়ু) সিস্টেমে রূপান্তরিত হয়।

আরও পড়ুন- মহিলাদের ভোট ঢেলে তৃণমূলে, এবার তাই মার্জিন দ্বিগুণের বেশি

কীভাবে তৈরি করা হয়?
সাধারণত একটি বড় উলফ স্পাইডার নিয়ে সেটিকে ৫ থেকে ৭ দিনের জন্য -8 ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় রেখে ইউথ্যনাইজড করার পর তার সেফালোথোরাক্স অংশে একটি ২৫ গেজ হাইপোডার্মিক সুঁচ ঢোকানো হয় এবং তার চারপাশে আঠা লাগিয়ে শুকিয়ে নেওয়ার পর ওই সুঁচের সাথে একটি পাম্প যুক্ত করা হয় যার মাধ্যমে বাতাস পাম্প করে মাকড়সার পা প্রসারিত করা হয়।
বিশ্রামরত অবস্থায় মাকড়সার পায়ে সাধারণ চাপ 4kPa থেকে 6.1kPa পর্যন্ত হয়ে থাকে। গবেষকরা মাকড়সার দেহাভ্যন্তরীণ চাপ 5.5kPa বৃদ্ধি করে পা প্রসারিত করেন। দেহে বাতাস প্রয়োগ করলে তা অভ্যন্তরীণ চাপ বাড়ায়, যার ফলে পা প্রসারিত হয়। আবার দেহ থেকে বাতাস বের করে নিলে তা অভ্যন্তরীণ চাপ হ্রাস করে, যার ফলে পাগুলি তাদের পায়ের ফ্লেক্সর পেশিগুলির কারণে সংকুচিত হয়। যখন অভ্যন্তরীণ চাপ 0kPa-এ কমে যায়, তখন এই গ্রিপারটি সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়, যাতে গ্রিপার বস্তুগুলিকে ধরতে পারে। এই পদ্ধতিটি এটি প্রমাণ করে যে অভ্যন্তরীণ চাপ হ্রাসের সাথে সাথে গ্রিপিং বল বৃদ্ধি পায়। বিপরীতভাবে, যখন অভ্যন্তরীণ চাপ বৃদ্ধি পায়, তখন গ্রিপিং বল হ্রাস পায়। স্বতন্ত্র ওজনযুক্ত অ্যাসিটেট পুঁতিগুলিকে আঁকড়ে ধরার ক্ষমতার ভিত্তিতে এটি বলা যায় যে নেক্রোবোটিক গ্রিপার সর্বাধিক ০.৩৫ মিলিনিউটনের গ্রিপিং বল অর্জন করতে পারে।
যদিও ছোট এবং বড় মাকড়সার আঁকড়ে ধরার শক্তি ভিন্ন প্রকারের হয়। উলফ স্পাইডারের দৈহিক ওজন তুলনামূলকভাবে তার পায়ের আঁকড়ে ধরার শক্তির সমান। এটির ভর যদি ৩৩.৫ mg হয় তবে দেখা যায় এটি তার ওজনের ১.৩ গুণ (৪৩.৬ mg বা ০.৩৫ mN) বস্তু তুলতে পারে। যদিও আবার অনেক ক্ষেত্রে বড় মাকড়সার সাথে, দৈহিক ওজনের তুলনায় আঁকড়ে ধরার শক্তি হ্রাস পায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি ২০০ গ্রাম গোলিয়াথ বার্ডেটার তার ওজনের ১০% (২০ গ্রাম বা ১৯৬ mN) বস্তু উত্তোলন করতে পারে বলে মনে করা হয়। যদিও মাকড়সার ভর এবং আঁকড়ে ধরার শক্তির মধ্যে একটি বিপরীত সম্পর্ক রয়েছে, তবে বড় মাকড়সা ছোট মাকড়সার চেয়ে বেশি গ্রিপিং বল প্রয়োগ করে।

নেক্রোবোটিক (Necrobotics) গ্রিপারের কার্যকারিতা সম্পূর্ণরূপে মাকড়সার কাঠামোগত অখণ্ডতার ওপর নির্ভরশীল। যদি মাকড়সাটি সহজে এবং ঘন ঘন ভেঙে যায় তবে গ্রিপারটি কোনও কাজে লাগবে না। একটি নেক্রোবোটিক গ্রিপার ৭০০ থেকে ১০০০ বার সক্রিয় হতে পারে। ১০০০ চক্রের পরে, ডিহাইড্রেশনের কারণে পায়ের সন্ধিগুলির ঝিল্লিতে ফাটল তৈরি হতে শুরু করে। এই সমস্যার সমাধান হল সন্ধিগুলিতে মোম বা লুব্রিকেন্ট প্রয়োগ করা। গবেষকরা দেখেছেন যে ১০ দিনের মধ্যে, মোম দিয়ে লেপা একটি মাকড়সার ভরের তুলনায় একটি মোমহীন মাকড়সার ভর ১৭ গুণ বেশি হ্রাস পেয়েছে।

প্রয়োগ
ছোট যান্ত্রিক গ্রিপারগুলি ব্যয়বহুল এবং জটিল হওয়ার কারণে, নেক্রোবোটিক গ্রিপার সহজেই ব্যবহার করা যেতে পারে। নেক্রোবোটিক গ্রিপার কোনও বস্তুর সূক্ষ্ম হ্যান্ডলিং এবং হালকা বস্তুগুলিকে আঁটোসাঁটো জায়গায় চালনা করে। মাইক্রোইলেক্ট্রনিক্সে এর প্রয়োগ করা যেতে পারে যেখানে নেক্রোবোটিক গ্রিপারগুলি সাধারণ পিকআপ এবং ড্রপিং অ্যাকশনগুলি পরিচালনা করতে পারে।
রোবটের এত ধরনের এত প্রকারের আবিষ্কার— নেক্রোবোটিক্স (Necrobotics) থেকে হিউম্যানয়েড রোবট এমনকী আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স পর্যন্ত যা আজ মানুষের বিকল্প হিসেবে কাজ করতেও সমর্থ তাও এই বিজ্ঞানেরই দান। তবে এই সমস্ত অগ্রগতি মানুষের জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তায় আরও একটি পালক যোগ করলেও এইসব কিছুই বিজ্ঞানের অগ্রগতির পরিচায়ক হলেও কোথাও একটা আশঙ্কার মেঘ ঘনায়, সত্যিই আমরা মানুষের বিকল্প খুঁজতে গিয়ে মানুষকেই পিছিয়ে দিচ্ছি না তো?

Latest article