অজানা আফিম

আফিমের অপবাদ থাকলেও এর রয়েছে বিশেষ ঔষধিগুণ। প্রাচীন বিশ্বে এর ভাল ব্যবহার ছিল। যদিও এখন এটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে অবৈধ বিনোদনমূলক ওষুধ হিসেবে। আফিম নিয়ে কিছু অজানা কথা বললেন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও গবেষক ড. অমিতকৃষ্ণ দে

Must read

আফিমের (Opium) ব্যবহার চলে আসছে বহু যুগ ধরে। প্রাচীন বিশ্বে আফিম-ব্যবহারের বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। সম্প্রতি ইজরায়েলের একটি কবরস্থান আবিষ্কৃত হয়েছে যেটি ব্রোঞ্জ-যুগের শেষের দিকে খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতকের দিকের। সেখানে দেড় ডজনেরও বেশি ৩৫০০ বছরের পুরনো মৃৎপাত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে পোস্ত গাছের বীজের ক্যাপসুল ব্যবহার করে তৈরি করা মাদকের অবশিষ্টাংশ।

প্যাপাভেরা সমনিফেরাম
আফিম বা ওপিয়াম (opium) পাওয়া যায় পোস্ত বা পপি (poppy) গাছ থেকে। আফিম শুকনো ল্যাটেক্স যা আফিম পপি (বৈজ্ঞানিক নাম : প্যাপাভার সোমনিফেরাম Papaver somniferum) বীজ থেকে পাওয়া যায়। আফিমের মধ্যে আছে মরফিন (morphine) যা যে কোনওরকম ব্যথা-যন্ত্রণা কমাতে সাহায্য করে। ১৮০০-র দশকের গোড়ার দিকে জার্মান ফার্মাসিস্ট সার্টার্নার (Friedrich Serturner) আফিম থেকে মরফিন অ্যা লকালয়েড বিচ্ছিন্ন করেন। এটি সরাসরি কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের (সিএনএস) উপর কাজ করে ব্যথার উপশম ঘটায় ও শারীরিক ও মানসিক সহনশীলতা বিকাশ-এ সাহায্য করে। এই মরফিন আবার আনে মাদকতাও। এই কারণে যাঁরা মরফিন নেন তাঁরা ধীরে ধীরে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। আফিম বা মরফিনের নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারাটা খুব শক্ত কাজ।
২০০০ সালে আফিমকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল অবৈধ বিনোদনমূলক ওষুধ হিসেবে। এটির বিক্রি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় এবং উচ্চ কর আরোপিত করা হয়। ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া আফিম কোনও দোকানে বিক্রি করার অনুমতি নেই।

ইতিহাসের আফিম (Opium)
আফিমকে ব্যথা উপশমের জন্য এবং অস্ত্রোপচারের জন্য ব্যবহার করা হয়ে এসেছে বহু যুগ ধরে। ঐতিহাসিক নথি অনুসারে সুমেরীয় পুরোহিতরা আফিম ব্যবহার করত আধ্যাত্মিকতার উচ্চতর অবস্থায় পৌঁছনোর জন্য। অন্যদিকে, মিশরীয় যোদ্ধাদের পাশাপাশি পুরোহিতদের জন্য আফিম সংরক্ষিত রেখেছিল, সম্ভবত এটি শুধুমাত্র মনোসক্রিয় প্রভাবের জন্য নয়, বরং ওষুধের জন্যও ব্যবহার করেছিল। এই কারণে হয়তো এটি দেবতার জন্য একটি নৈবেদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হত এবং সম্ভবত তাঁরা মনে করতেন যে মৃত ব্যক্তির পরবর্তী জীবনে এটির প্রয়োজন হতে পারে।

আরও পড়ুন-খাদ্যের অধিকার মৌলিক অধিকার কোনও দয়ার দান নয়

গ্রিক সংস্কৃতিতে
আফিম ব্যথা উপশমের এবং অস্ত্রোপচারের জন্য কয়েক শতাব্দী ধরে ব্যবহার করা হয়ে এসেছে । প্রাচীন গ্রিক সংস্কৃতির কিছু লিপিতে পপির ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের একজন দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে যাঁর চুল সম্ভবত পপি ক্যাপসুল দিয়ে সজ্জিত এবং তাঁর বন্ধ চোখগুলিতে অবসাদে ভরা। এছাড়াও সাইপ্রাস এবং মিশর উভয় ক্ষেত্রেই সম্ভবত পপি ক্যাপসুল অনুকরণ করা জুগলেট গুলি পাওয়া গিয়েছে।

মরফিন
মরফিন সক্রিয় করে মস্তিষ্ক, মেরুদণ্ড, পাকস্থলী এবং অন্ত্র। নিয়মিত ব্যবহারের ফলে মাদক সহনশীলতা বা শারীরিক নির্ভরতা হতে পারে। ১৯০৬ সালে চিন বা আধুনিক ইরানে দীর্ঘস্থায়ী আফিম আসক্তরা দৈনিক গড়ে আট গ্রাম আফিম খেত। ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসার ২০২১ সালে গবেষণার দ্বারা প্রমাণ করেছে যে আফিম একটি মানব কার্সিনোজেন, যা বেশিরকম ব্যবহার করলে স্বরযন্ত্র, ফুসফুস এবং মূত্রথলির ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।

আফিমের (Opium) ব্যবহার
এক সময় বাগদাদ শহরে আফিমের পিল ব্যবহার করা হত ওষুধ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের রোগের চিকিৎসা করতে। এমনকী কুষ্ঠ রোগীদের ক্ষেত্রেও আফিম দেওয়া হত। ভারতবর্ষে কবে আফিমের চলাচল শুরু হয়েছে তার সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে ১৫৯০ সালে আউট এলাহাবাদ ও আগ্রা শহরের আফিমের চলাচল ছিল বলে কিছু তথ্য পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য হওয়ার আগে ডাচরা আফিম ব্যবহার করত বলে জানা যায়। ১৭৭৩ সালে বাংলার গভর্নর ব্রিটিশের সাহায্যে বাংলা, ওড়িশা ও বিহারের আফিমের চাষ ও ব্যবসার উপর দখল নিয়ে নেয়। স্বাধীনতার পর আফিমের সমস্ত অধিকার ভারত সরকার হাতে নিয়ে নেওয়া বর্তমানে উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও হিমাচল প্রদেশে আফিমের চাষ করা হয়। কিন্তু এই চাষের পরিমাণ গত কয়েক শতাব্দীতে যা হত তার থেকে অনেক কম।
গত কয়েক দশকে আফিমের উৎপাদন অনেক বেশি রকম বৃদ্ধি করা হয়েছে। আফগানিস্তানে নতুন ধরনের উন্নত বীজ আনা হয়েছে যার থেকে আফিমের উৎপাদন আরও বেড়ে গেছে। কিন্তু আফিমের চাহিদা সারা বিশ্বে এত বেশি যে ঠিকমতো উপাদান না হলে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সঠিক পরিমাণে ভিটামিন জোগান দেওয়া নিকট ভবিষ্যতে দুষ্কর হয়ে দাঁড়াবে। সেই কারণে বর্তমান আফিমের উৎপাদনের অন্তত পাঁচ গুণ বেশি উৎপাদন করা প্রয়োজন।

আফিমের ঔষধি বৈশিষ্ট্য
আয়ুর্বেদ মতে, নির্দিষ্ট পরিমাণের আফিম ঘাম নিঃসরণ প্রতিরোধ করে। আফিম মস্তিষ্কের শক্তিকে উদ্দীপিত করে, মাইগ্রেন, কোমরের ব্যথা, জয়েন্ট পেন, ডায়াবেটিস, বিভিন্ন শ্বাসযন্ত্রের রোগ, ডায়েরিয়া, রক্তের ডায়েরিয়ার জন্য কার্যকরী। শুধু আয়ুর্বেদিক ওষুধেই নয়, আফিন থেকে প্রাপ্ত মরফিন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় অ্যালোপ্যাথি ওষুধে।

আফিম আর পোস্ত
পোস্ত হল শুকনো ফলের বীজ আর ও কাঁচা অবস্থায় ওই ফলের খোসার নির্যাস হল আফিম। তাই পোস্ত আর আফিমের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। সরকারি তত্ত্বাবধান ছাড়া পোস্ত চাষ করা যায় না। মজার বিষয় হল, আফিমের ঔষধি গুণ যেমন আছে তেমন অনেক দোষও রয়েছে তাই আফিম ব্যবহার নিষিদ্ধ অথচ পোস্তর হাজার গুণ। পোস্তর দাম এতটাই যে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পোস্তর ডায়েটারি ফাইবার রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়েটারি ফাইবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা মেটায়। পোস্তদানার মধ্যে থাকা ভিটামিন বি কমপ্লেক্স (থায়ামিন, প্যান্টোথেনিক অ্যাসিড, রাইবোফ্লাভিন, নিয়াসিন, ফোলিক অ্যাসিড ইত্যাদি) শরীরের বিপাকক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। আয়রন, কপার, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, জিঙ্ক, ম্যাগনেশিয়ামের মতো বেশ কিছু উপকারী খনিজের উপস্থিতি রয়েছে পোস্তে। কপার রক্তে লোহিতকণিকার পরিমাণ বাড়ায়। পোস্তর ক্যালসিয়াম হাড় শক্ত রাখে। আয়ুর্বেদে অনিদ্রা রোগে পোস্ত খেতে বলে। মুখের আলসারে পোস্ত ভাল ওষুধ। শরীরকে ঠান্ডা করতেও। পোস্ততে রয়েছে উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যা দৃষ্টিশক্তি উন্নত করে। পোস্তবীজের মধ্যে রয়েছে ওয়েলিক অ্যাসিড যা আমাদের ব্লাড প্রেশারকে নিয়ন্ত্রণ করে।

Latest article