ভারতীয় কন্যার কান-জয়

ফের ‘কান’-এ ভারতীয় নারীর জয়জয়কার। সম্প্রতি শেষ হল ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসব। এ-বছর সেখানে ইতিহাস গড়লেন পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া। তাঁর নারীকেন্দ্রিক ছবি ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ় লাইট’ পেল সেরার শিরোপা। জিতে নিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান গ্রাঁ প্রি। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

১৯৪৬ সালে প্রথম কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্রাঁ প্রি জিতে নিয়েছিল ভারতীয় চলচ্চিত্র ‘নিচা নগর’। ছবির পরিচালক ছিলেন চেতন আনন্দ এবং এই ছবির মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন উমা আনন্দ, কামিনী কৌশল, রফিক আনোয়ার প্রমুখ। এই ছবিটি ছিল মূলত ভারতের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য, আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি, দারিদ্র্য, দুর্দশা, বাস্তবতার এক জীবন্ত দলিল। সেই থেকে আজ কান-এ ভারতীয় ছবি অন্য মর্যাদা পেয়েছে। ২০২৪ সালের কান-এর মঞ্চের গুরুত্বও অনেকটাই কারণ ভারতকে আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসালেন এক ভারতীয় কন্যা। তিনি পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া (Payal Kapadia)। তাঁর ‘অল উই ইমাজিন অ্যাজ় লাইট’ সিনেমার জন্য গ্রাঁ প্রি পেলেন পায়েল। প্রায় তিরিশ বছর পর কোনও ভারতীয় ছবি কান চলচ্চিত্র উৎসবের প্রথম বিভাগে জায়গা পেল। সর্বশেষ ভারতীয় ছবি হিসেবে শাজি এন করুণের ‘সোয়াহাম’ কানের মূল প্রতিযোগিতার প্রথম বিভাগে জায়গা পেয়েছিল ১৯৯৪ সালে। কানের সর্বোচ্চ সম্মান পাম ডি’ওর অল্পের জন্য হাতছাড়া হলেও উৎসবের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সম্মান গ্রাঁ প্রি ‘Le Grand Prix’ পুরস্কার জিতল পায়েলের ছবি।

প্রসঙ্গত, ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবেই ‘আন সার্টন রিগার্ড’ বিভাগে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর সম্মান পেয়েছেন কলকাতার মেয়ে অনসূয়া সেনগুপ্ত। ‘দ্য শেমলেস’ ছবির জন্য অনসূয়া পেয়েছেন এই সম্মান।
আন্তর্জাতিক মঞ্চে যে মেয়ে ভারতের হয়ে ছিনিয়ে আনলেন সম্মান সেই পায়েলেরই অনুদান আটকে দিয়েছিল পুণের এফটিআই (ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়া)।
কে এই পায়েল কাপাডিয়া (Payal Kapadia)? জানতে হলে একটু পিছন ফিরে তাকাতে হবে। সালটা ২০১৫। তখন পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অফ ইন্ডিয়ার ছাত্রী পায়েল। ওই সময় অভিনেতা গজেন্দ্র চৌহান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। গজেন্দ্র ‘মহাভারত’ সিরিয়ালের ‘যুধিষ্ঠির’ চরিত্রের জন্য দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান পদে গজেন্দ্রর নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তৎকালীন এফটিআই-এর পড়ুয়ারা। কারণ তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ এই পদে নিয়োগ করেছিল কেন্দ্র সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক। সেই সময় প্রতিবাদে নামেন পড়ুয়ারা। ১৩৮ দিন ধরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন তাঁরা। পুণের থানায় ৩৫ জন পড়ুয়ার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়। শেষমেশ ওই পদ থেকে ইস্তফা দেন গজেন্দ্র চৌহান। সেই আন্দোলনে শামিল ছিলেন পায়েল। কর্তৃপক্ষের রোষানলে পড়েন তিনি। তাঁর অনুদান বন্ধ করে দেন এফটিআই কর্তৃপক্ষ। এমনকী ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে’ যাওয়ার পথও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
কিন্তু কোনও প্রতিকূলতা তাঁর পথ রোধ করতে পারেনি।

আরও পড়ুন- “পরিকল্পিতভাবে বাংলাকে ডোবাচ্ছে”, কেন্দ্রকে তোপ মুখ্যমন্ত্রীর

এর আগেও কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মানিত হয়েছেন পায়েল (Payal Kapadia)। ২০১৭ সালেই কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে স্টুডেন্ট ফিল্ম বিভাগে সেরা ১৬-র তালিকায় নাম ছিল পায়েল কাপাডিয়ার। তাঁর ছবি ‘আফটার নুন ক্লাউড’-এর জন্য তাঁর নাম উঠেছিল সেই তালিকায়। এরপরে পুণে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের উপর হিন্দুত্ববাদ এবং রাজনীতির প্রভাব নিয়ে একটা তথ্য চিত্র তৈরি করেছিলেন তিনি। আর সেই তথ্যচিত্রের জন্য তিনি পেয়েছিলেন গোল্ডেন আই পুরস্কার। সেই জয়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার গ্রাঁ প্রি জিতে নিলেন তিনি।
‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট’
ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্রে রয়েছেন দুই নারী। মুম্বইয়ে বসবাসকারী এই দুই মালয়ালি নার্স অনু এবং প্রভা কাজ করেন মুম্বইয়ের হাসপাতালে। অনু ভালবাসে শিজ নামের এক মুসলিম ছেলেকে। এই বিশাল শহরে বয়সে ছোট ছেলেটির সঙ্গে সম্পর্কে গোপনীয়তা রাখার ব্যক্তিগত জায়গা খুঁজে পায় না সে। অন্যদিকে প্রভা দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকা স্বামীর কাছ থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে একদিন একটি উপহার পায়। এই দুই নার্স অনু আর প্রভা নিজেদের সম্পর্ক নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। একদিন এক সমুদ্র সৈকত শহরে বেড়াতে গিয়ে সুন্দর এক জঙ্গলে তাঁরা তাঁদের অনেকদিনের স্বপ্নকে পূর্ণ করার সুযোগ পেয়ে যায়। ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন কানি কুশ্রুতি, দিব্য প্রভা, ছায়া কদম, রিদু হারুন। পরিচালনা ছাড়াও গল্প লিখেছেন পায়েল কাপাডিয়া। সিনেমাটোগ্রাফিতে রণবীর দাস। ছবির প্রযোজনা করেছেন থমাস হাকিম এবং জুলিয়ান গ্রাফ। সহ প্রযোজনায় রয়েছেন ভারত, নেদারল্যান্ড, লুক্সেমবুর্গ এবং ইতালির প্রযোজনা সংস্থাও। সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করেই কানের মঞ্চে সম্মানিত হল একজন মহিলা পরিচালিত ছবি যাঁর কেন্দ্রবিন্দুতেও রয়েছেন মহিলারাই।

ভারত ছাড়াও ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সম্মান এবং পুরস্কারের তালিকায় রয়েছে অনেক ছবি, নির্মাতা, অভিনেতা, অভিনেত্রী। কান-এর সর্বোচ্চ পুরস্কার গোল্ডেন পাম জিতেছে শন বেকারের ছবি ‘অনোরা’।
ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলা, আলি আব্বাসি, জ্যাক অদিয়াঁর, ক্রোনেনবার্গ, কানাডা, জিয়া জ্যাং-কির মতো নির্মাতাদের টপকে শেষ পর্যন্ত গোল্ডেন পাম জিতল শন বেকারের সিনেমাটি। কমেডি-ড্রামা ঘরানার এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন মাইকি ম্যাডিসন। এক যৌনকর্মীর জীবনের গল্প নিয়ে তৈরি হয়েছে সিনেমাটি। সেরা নির্মাতার পুরস্কার পেয়েছেন পর্তুগালের মিগুয়েল গোমেজ। পিরিয়ডিক ড্রামা ‘গ্রান্ড ট্যুর’-এর জন্যে পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার পেয়েছেন এবারের উৎসবের সবচেয়ে আলোচিত ছবি ‘এমিলিয়া পেরেজ’-এর চার অভিনেত্রী অ্যাড্রিয়ানা পাজ, যোয়ি সালদানা, সেলেনা গোমেজ ও ক্লারা সোফিয়া গ্যাসকন। সিনেমাটির নির্মাতা গোল্ডেন পাম জয়ী ফরাসি পরিচালক জ্যাক অডিয়াঁর। ‘কাইন্ডস অব কাইন্ডনেস’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য সেরা অভিনেতার পুরস্কার পেয়েছেন মার্কিন অভিনেতা জেসি প্লেমনস। সেরা চিত্রনাট্যের পুরস্কার পেয়েছেন কোরালি ফারজাঁ। ইরানি নির্মাতা মোহাম্মদ রাসুলফ তাঁর ‘দ্য সিড অব দ্য স্যাক্রেড ফিগ’ সিনেমার জন্য বিশেষ পুরস্কার পেয়েছেন। এককথায় জমজমাট এবং সাফল্যে, ঐতিহ্যে পরিপূর্ণ ছিল এ-বছরের কান চলচ্চিত্র উৎসব।

Latest article