সুমন করাতি, হুগলি: কঠোর নিয়ম। প্রতিমা গড়ার সময়ে নিরামিষ আহার করতে হবে মৃৎশিল্পীদের। ভুল করেও চলবে না আমিষ আহার। কঠোরভাবে নিষিদ্ধ নেশার উপকরণও। অন্যথা হলেই নাকি নাটমন্দিরে উপদ্রব ঘটে সাপ আর বিষাক্ত বিছের। সঙ্গে নানা পোকামাকড়ের। হুগলি জেলার হরিপালের সরকার বাড়ির পুজো এবার ২২০ বছরে পা দিল। পুজোর প্রতিষ্ঠাতা একজন মহিলা। আর পুজোর সময় এই বাড়ির জাগ্রত দেবীর দর্শনে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। হরিপালের অলিপুরের সরকার বাড়ির দুর্গাপূজা নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে। কথিত আছে, একবার ভয়ে মৃৎশিল্পীদের মাঝপথেই পাততাড়ি গোটাতে হয়েছিল। লোককথায়, দেবী এখানে খুবই জাগ্রত। বনেদি বাড়ির পুজোর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় বেশিরভাগ পুজোর প্রতিষ্ঠাতা সেই পরিবারের কোনও পুরুষ। কিন্তু সরকার বাড়ির ক্ষেত্রে সেই নিয়মের ব্যতিক্রম রয়েছে। এই পুজো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন একজন মহিলা। বঙ্কুবিহারী সরকারের স্ত্রী নিরাদাময়ী দাসী স্বপ্নাদেশ পেয়ে বাড়িতেই দুর্গাপুজাের সূচনা করেন। সরকার পরিবারের সদস্য তপন, সঞ্জীব ও সত্যজিৎরা বলেন, পুরনো মন্দির সিংহদুয়ার বর্তমানে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পরিবর্তে নতুন করে তৈরি হয়েছে আটচালা ও নাটমন্দির। একসময় জমিদারি ছিল এই পরিবারে। বর্ধমানের রাজাকে খাজনা দেওয়া হত। ধীরে ধীরে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়। পরিবারের অনেকেই কর্মসূত্রে বিভিন্ন জায়গায় চলে গিয়েছেন। তবে পুজোর সময় অনেকেই এখানে আসেন। পরিবারে সদস্য সংখ্যা এখন প্রায় ১৩০ জন। একচালার মূর্তি ষোড়শ আচারে নিষ্ঠার সঙ্গে পুজো হয় সরকার বাড়িতে। কথিত আছে, একসময় সিংহদুয়ার ভেঙে ডাকাত দল ঢুকেছিল বাড়িতে। ডাকাত দল দরজা ভাঙার পর দেখতে পায় দুয়ারে দাঁড়িয়ে স্বয়ং দেবী দুর্গা। তারপর ডাকাতি না করেই ভয়ে ফিরে যায় ডাকাতের দল। পরবর্তীকালে ডাকাত দলের লোকজনের কাছ থেকেই দুয়ারে দুর্গার কথা জানাজানি হয়। আগে একটা সময় মোষ ও ছাগল বলি হত। শোনা যায় বছর ষাটেক আগে যে ছাগলটি বলি দেওয়ার জন্য আনা হয়েছিল সেটি সাপের কামড়ে মারা যায়। তখন পরিবারের কর্তা নীলরতন সরকারের নির্দেশে বন্ধ হয়ে যায় পশুবলি। আদা, ছাচি কুমড়ো বলি দেওয়া হয় এখন। সরকার বাড়ির দেবী যে জাগ্রত তার সপক্ষে যুক্তি দিয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের বাসিন্দা প্রতিমাশিল্পী প্রদ্যোৎ শী। তিনি বলেন, গত ১০ বছর ধরে আমি প্রতিমা তৈরি করছি। আগে যিনি এখানে প্রতিমা তৈরি করতেন তিনি আমাকে বলেছিলেন এই প্রতিমা তৈরি করলে মাছ-মাংস, মদ্যপান কোনও কিছুই করা যাবে না। একদিন নাকি তিনি মাংস খেয়ে প্রতিমা তৈরি করতে এসেছিলেন। আর তার পরিণাম হয়েছিল ভয়াবহ। সাপ, বিছে সহ অন্যান্য বিষাক্ত কীটপতঙ্গে ভরে উঠেছিল গোটা মন্দির। তিনি ভয়ে পালিয়ে যান। মহালয়ায় হয় দেবীর চক্ষুদান। সেদিন নির্জলা উপোস। প্রতিবছর জাগ্রত দেবী দুর্গার মূর্তি দর্শন করতে হরিপালে উপচে পড়ে ভিড়।
আরও পড়ুন- রাতবিরেতে টোটোয় অসুস্থকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন তনুশ্রী