অথ রেউড়ি সমাচার

একদিন যাকে রেউড়ি ভিক্ষার দান, এসব বলে ব্যঙ্গ করেছে রাম-বাম-হাত, আজ তারাই তাকে আঁকড়ে ভোট-বৈতরণী পেরোতে চাইছে। কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডার কেবল ভোট ব্যাঙ্ক বাঁচানোর হাতিয়ার নয়, সমাজ বদলের উপচার। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বাংলা গতকাল যা ভেবেছিল, আজ সারা ভারত তাই ভাবছে। মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে লিখছেন দেবাশিস পাঠক

Must read

মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’। দশরথকে চিঠি লিখছেন কৈকেয়ী দেবী। দাসী মন্থরার মুখে শুনেছেন, দশরথ রামের অভিষেক করতে চলেছেন। অথচ দশরথের মুখে শুনেছিলেন অন্য কথা। ভরতকে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দশরথ। হতবাক কৈকেয়ী দশরথকে লেখেন, সেই বিখ্যাত লাইন, ‘একী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে’। আজ চারদিকের হালচাল দেখে আমাদেরও বলতে ইচ্ছে করেছে, ‘এ কী কথা শুনি আজ মোদিজির মুখে’।
উত্তরপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ডে এক্সপ্রেস ওয়ে উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন মোদি ২০২২-এর জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। তখনই, গরিব ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল মানুষজনকে সরকারি উদ্যোগে ভর্তুকি দিয়ে জরুরি পণ্য ও পরিষেবা সরবরাহ করা এবং বিভিন্ন খাতে আর্থিক অনুদান দেওয়ার জনমুখী পদক্ষেপকে ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ বলে ব্যঙ্গ করেন তিনি। এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, এই রেউড়ি সংস্কৃতি দেশটাকে গোল্লায় পাঠাবে। ব্যাস! ‘রেউড়ি সংস্কৃতি’ (Rewari Culture) কথাটা ঢুকে পড়ল ভারতীয় রাজনীতির অভিধানে।
গদাইয়ের সঙ্গে সেদিন জগাই-মাধাইও ছিল। বাম-কংগ্রেসের শিবির থেকে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’কে ভিক্ষার দানের সঙ্গে উপমিত করার ক্ষেত্রে কোনও খামতি ছিল না। ঘরে বসে ফেসবুক ট্যুইটারে বিভিন্ন লাল-সবুজ নেতা লক্ষ্মীর ভাণ্ডারকে ‘উৎকোচ’ তকমা দিতে ইতস্তত করেননি।
আর এখন? এই ২০২৪-এর শেষপাদে? স্বয়ং নরেন্দ্র মোদির মুখেই আর ‘রেউড়ি’ শব্দটা শোনা যায় না। এহ বাহ্য! নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচন বৈতরণী পেরোতে আঁকড়ে ধরেছে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’কেই। সেখানে ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্পের নাম ‘লড়কি বহিন যোজনা’। জগাই-মাধাইরাও ডিগবাজি খেয়েছে। বামশাসিত কেরলে এ-ধরনের প্রকল্প আছে। তেলেঙ্গানা, কর্নাটকেও কংগ্রেস এইরকম প্রকল্প চালু করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে।
আর বিজেপির ক্ষেত্রেও ‘লড়কি বহিন যোজনা’ এবারই প্রথম ভোটের হাতিয়ার হল, তা মোটেই নয়। গত বছর মধ্যপ্রদেশ বিধানসভার ভোটে মহিলাদের কত টাকা দেওয়া হবে সেই অঙ্ক নিয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে রীতিমতো রেষারেষি শুরু করেছিল।
অস্যার্থ একটাই। নারীর সশক্তীকরণের ক্ষেত্রে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের ইতিবাচক প্রভাব কেউই অস্বীকার করতে পারছে না। বাম, বিজেপি, কংগ্রেস এ নিয়ে একদা যথেষ্ট ঠাট্টা-মশকরা করার পর, এখন মাথা মুড়িয়ে (কৌস্তুভ বাগচীর কথা বলছি না) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো পথেই হাঁটার প্রয়াস চালাচ্ছে।
ইতিহাস বলছে মোদি কিংবা বামেদের থেকে নয় রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর রোমান প্রজাতন্ত্রের উদ্ভবের সময় থেকে জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলোকে রেউড়ি বা ভিক্ষা বলার রেওয়াজ চালু হয়েছিল। সেসময় রোমে বাস করতেন এক কবি। নাম জুভেনাল। তিনিই প্রথম নাগরিকদের সরাসরি আর্থিক অনুদান প্রদানকে ‘রুটি ও সার্কাস’ প্রকল্প হিসেবে অভিহিত করেন। তাঁর মনে হয়েছিল, নাগরিকদের প্রকৃত দাবিদাওয়া সুযোগ-সুবিধার স্বল্পতা, এসব থেকে নজর ঘোরাতেই এরকম আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়। আর তার ফলে সরকারের অর্থ ভাণ্ডারে টান পড়ে। তার জেরে প্রকৃত উন্নয়নের কাজ সরকার করে উঠতে পারে না।
কিন্তু ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’-এর ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়। কারণটা পরিষ্কার।
ভারতের মতো দেশে শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৮ শতাংশ। দেশে তিনজন যুবকের একজন এখানে শিক্ষা, চাকরি আর প্রশিক্ষণ থেকে বঞ্চিত। আর এই বঞ্চিত যৌবনের ৯৫ শতাংশ মহিলা। সংস্থার ব্যবস্থাপক পদে আসীন প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে মাত্র একজন মহিলা। আন্তর্জাতিক লিঙ্গবৈষম্য সূচকে ১৪৮টি দেশের মধ্যে ১২৭তম স্থানটি ভারতের। নীতি আয়োগের সমীক্ষাই বলছে, ১৮-৪৯ বয়সি মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৩ জন গার্হস্থ্য হিংসার শিকার।

আরও পড়ুন- রাজধানীর বাণিজ্যমেলায় নজরকাড়া বাংলার প্যাভিলিয়ন

এমতাবস্থায় প্রতীচী ট্রাস্টের সমীক্ষা থেকে জানা যাচ্ছে, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রকল্পের সুবিধাপ্রাপকদের (সরকারি হিসাবে, মোট সুবিধাভোগীর সংখ্যা প্রায় আড়াই কোটি) ৬১ শতাংশেরও বেশি মহিলা মনে করেন, এই প্রকল্প তাঁদের ক্ষমতা দিয়েছে, সামাজিক শক্তি বাড়িয়েছে। এঁদের ৬.৩ শতাংশ মহিলা জানিয়েছেন, কেবল সংসার খরচের জন্য নয়, নিজেদের ছোটখাটো ব্যবসার ক্ষেত্রেও এই প্রকল্প থেকে পাওয়া নগদ অর্থ কাজে লাগান তাঁরা। ৮৫.৬ শতাংশ সুবিধাভোগী প্রকল্প থেকে প্রাপ্ত নগদ অর্থ কীভাবে ব্যয়িত হবে, সে সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নিজেরাই নেন। ১০.৮ শতাংশ মহিলা স্বামীর সঙ্গে যৌথভাবে সে সিদ্ধান্ত নেন। প্রত্যেক মাসে নিয়মিত নগদ অর্থের জোগান সার্বিকভাবে তাঁদের অনিশ্চয়তা অনেকাংশে দূর করেছে। প্রকল্পে প্রাপ্ত নগদ পেয়ে সুবিধা ভোগীদের প্রায় ৭৬ শতাংশ সেটা ব্যয় করেন সংসারের খরচ মেটাতে, এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও সত্য যে প্রায় ৪২ শতাংশ সুবিধাভোগী মহিলা ওই অর্থ ব্যয় করেন ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার পেছনে আর ৩৪ শতাংশ মহিলা প্রাপ্ত অর্থ খরচ করেন ওষুধ কিনতে। ৩৫.৩ শতাংশ মহিলা নিজেদের মর্জিমাফিক, নিজস্ব চাহিদা মেটাতে ওই নগদ অর্থ ব্যয় করেন। সব মিলিয়ে, মহিলাদের আপন স্বপ্ন পূরণে ব্যয়িত হয় লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো প্রকল্পের নগদ অর্থ।
কেন্দ্রীয় সরকারের ৫৩টি মন্ত্রকের অধীনে ৩১৪টি সরাসরি সুবিধা হস্তান্তর বা ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফারের প্রকল্প আছে। সেগুলোর কোনওটাকে কিন্তু আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার (আইএমএফ) ‘সরবরাহ ও বণ্টনের বিস্ময়’ (লসিস্টিক্যাল মার্ভেল) হিসেবে অভিহিত করেনি। ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’কে করেছে।
সুরতাং ‘রেউড়ি’ আর ‘ভিক্ষা’ বলে মশকরা করছিলেন যাঁরা, তাঁদেরও মমতাপন্থী হয়ে ওঠা ছাড়া উপায় কী!
পরিশেষে একটা কথা— টুকলিবাজ কখনও ফার্স্ট হতে পারে না। ২০২০-র জানুয়ারিতে ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি চালু করেছিল জগনান্না আম্মা ভোদি। সেই প্রকল্পের সৌজন্যে কিন্তু জগন্মোহন রেড্ডি ২০২৪-এ অন্ধ্রপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরতে পারেননি।
সুতরাং বাম-বিজেপির মতো যেসব বেড়াল ঠেলায় পড়ে গাছে উঠতে চাইছে, তারা সাবধান।

Latest article