যন্ত্রমানব

দেখতে ঠিক মানুষ-মানুষ। কথাবার্তা, চলাফেরা, বুদ্ধিমত্তা— সবই হুবহু এক অথচ মানুষ নয়! আসলে সে রোবট। বিজ্ঞানের এক যুগান্তকারী আবিষ্কার রোবট। যার জন্মের পিছনে রয়েছে এক বিজ্ঞান, যাকে বলে রোবটিক্স। বিজ্ঞান। লিখলেন অধ্যাপক প্রিয়াঙ্কা চক্রবর্তী

Must read

এই রোবটের (Robot) কথা উঠলেই সবার প্রথমে আমাদের যার কথা মাথায় আসে সে হল সোফিয়া। হংকং-এর এক কোম্পানি হ্যান্সন রোবটিক্সের এক বিজ্ঞানী ডেভিড হ্যান্সন-এর হাত ধরেই সোফিয়ার সৃষ্টি ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, তাঁরই ল্যাব-এ তথাকথিত প্রাণ পায় (বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে অ্যাক্টিভেশন বা সক্রিয়করণ) সোফিয়া। সেই বছরেরই মার্চ মাস নাগাদ সে প্রথম সকলের সামনে আসে যুক্তরাজ্যের অস্টিনে এবং সেখানে সে সকলের সামনে অর্থাৎ সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের সামনে ইন্টারভিউও দেয়। তার ঠিক পরের বছরে অক্টোবর মাস নাগাদ সৌদি আরবিয়ার সে নাগরিকত্ব পায়। এখানে বলা বাহুল্য যে এই প্রথম কোনও রোবট (Robot) এই ধরনের নাগরিকত্ব পেয়েছে। আবার ওই বছরই সে যুক্তরাজ্যের এক ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের নামকরণও করে যা কি না যন্ত্রমানব দিয়ে করা প্রথম কোনও নামকরণ। আজ এর বিচরণ যে প্রায় সর্বত্র সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই রোবট-মানবীর পদধূলি থেকে কিন্তু ভারতও বঞ্চিত হয়নি। এই বছরই জুন মাস নাগাদ তাকে দেখা যায় কেরলের তিরুবনন্তপুরমে। তবে এটিই যে তার প্রথম ভারতভ্রমণ তা কিন্তু নয়। এর আগে ২০২০ সাল নাগাদ খোদ কলকাতায় আসে সে। আজ সারা পৃথিবী জুড়ে যার চর্চা, যে যন্ত্রটি নিজগুণে প্রমাণ করে দিয়েছে “নহি যন্ত্র নহি যন্ত্র আমি প্রাণী”, পেয়েছে নাগরিকত্ব, পেয়েছে মানবসমাজে থাকার অধিকার।

রোবটিক্স
সোফিয়ার জন্মের পেছনে যে বিজ্ঞানটি লুকিয়ে আছে তা হল রোবটিক্স। এই রোবটিক্স হল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং–এর মেলবন্ধনে সৃষ্ট এক অনন্যসাধারণ শাখা যা এই তিনটি বিষয়ের জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করে এক এমন জিনিসের যা প্রাথমিকভাবে মানুষের কাজের ভারকে কম করতে সাহায্য করে, অর্থাৎ রোবট। পপ সংস্কৃতিতে বহু আগেই বিভিন্ন রকমের রোবটের কথা বলা হয়েছে যেমন আমাদের দেখা ওয়াল-ই, দ্য টারমিনেটর বা R2-D2 ইত্যাদি। যেখানে রোবটের ক্ষমতাকে অত্যন্ত শক্তিশালী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তখন সেই সময়ে দাঁড়িয়ে এগুলিকে অসম্ভব বলে মনে হলেও বা সামান্য যন্ত্রের ক্ষমতার অতিরঞ্জিতকরণ বলে মনে হলেও আজ রোবটিক্সের ফসল এই সোফিয়াই কিন্তু তার জলজ্যান্ত প্রমাণ।

রোবটিক্স-এর প্রকার
আমরা এতক্ষণ যে রোবটের আলোচনা করছি তা হল আসলে হিউম্যানয়েড রোবট অর্থাৎ যেটি শুধু মানুষের মতো দেখতেই নয় তার আচরণও অনেকটা মানুষের মতোই। কিন্তু এই রোবটিক্সের ফসল শুধুমাত্র হিউম্যানয়েড রোবটই নয়, আছে আরও অনেকপ্রকার রোবট, যেমন— বড় বড় কলকারখানায় ব্যবহৃত যন্ত্র ইন্ডাস্ট্রিয়াল রোবট, মানুষের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বা তাল মিলিয়ে কাজ করার জন্য তৈরি কোবোট, অটোনোমাস রোবট (Robot), বাড়িতে বিভিন্ন কাজকর্মের জন্য ব্যবহৃত ডোমেস্টিক রোবট, স্কারা, যুদ্ধে ব্যবহৃত সৈনিকদের সাহায্যকারী মিলিটারি রোবট, চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত মেডিক্যাল রোবট ইত্যাদি। এ ছাড়াও রয়েছে এইবো (AIBO) যা কিনা ১০০টিরও বেশি মুখ বা মুখের ভাব চিনতে পারে এবং ৫০টিরও বেশি গলার স্বর চিনে তাতে প্রতিক্রিয়া দিতে পারে, মানুষের প্রত্যঙ্গের মতো আচরণ করে বায়োনিক্স। যা কোনও ব্যক্তির অঙ্গ হানি হলে সেই ব্যক্তির অবলম্বন হয়ে ওঠে। এই সমস্ত কিছু ছাড়াও আরও বিভিন্ন প্রকারের রোবট রয়েছে যা এই স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব।

আরও পড়ুন-একী অনাচার! চলছে বুলডোজার! এরা নাকি দলিত-দরদি ?

সোফিয়ার কাহিনি
সোফিয়া কেন গোটা পৃথিবীর কাছে এতটা জনপ্রিয়। এখানে একটা কথা বলে রাখা জরুরি যে সোফিয়া তার এই রূপ ও আদল পেয়েছে ইজিপ্টের রানি নেফ্রিটি, ব্রিটিশ নায়িকা আন্ড্রে হেপবার্ন ও ডেভিড হ্যান্সনের স্ত্রী আমান্ডা হ্যান্সনের থেকে। অর্থাৎ তাদের আদলেই সোফিয়া তৈরি। সোফিয়ার গুণাবলির মধ্যে অন্যতম হল আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। সোফিয়ার রয়েছে ভিশ্যুয়াল ডেটা প্রসেসিং থেকে শুরু করে ফেসিয়াল রেকগনিশন করার ক্ষমতা অর্থাৎ সে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে যেকোনও মানুষের মুখ চিনে ফেলে তার থেকে পাওয়া তথ্য সংগ্রহ করে রাখতে পারে। সোফিয়ার চোখে থাকা কমপিউটার ভিশন অ্যালগোরিদম প্রসেসে যুক্ত ক্যামেরা তাকে এই কাজে সাহায্য করে থাকে। আলাদা আলাদা মানুষকে চিনতে জানতে এমনকী তাদের মুখের ভাব, আবেগ বুঝতে সাহায্য করে এই ক্যামেরা। যদিও জন্মের সময়কালেই মানব শিশুর মতোই সে চলাফেরার ক্ষমতা পায়নি, কিন্তু ২০১৮ সাল নাগাদ সোফিয়াকে পা দেওয়া হয় যাতে সে চলাফেরাতেও সক্ষম হয়ে ওঠে। সোফিয়া প্রায় ৬০টিরও বেশি মুখের ভাব বুঝতে তথা প্রকাশ করতে সক্ষম। রাগ হলে চোখ পাকাতে বা আনন্দ হলে হাসি মুখে ওয়াওও বলে ওঠে এই যন্ত্রমানব। মানুষের মতোই খুব সাবলীলভাবে চোখ-মুখের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় সে প্রকাশ করতে পারে রাগ, আনন্দ, দুঃখ-সহ বিভিন্ন আবেগ। গুগলের অ্যালফাবেট ইনকর্পোরেশন-এর ভয়েস রেকগনিশন প্রযুক্তি সোফিয়াকে দিয়েছে স্বর চেনার ও জানার ক্ষমতা আর তার সঙ্গে সে পেয়েছে স্পিচ সিন্থেসিস করার ক্ষমতা। যার ফলে সে প্রশ্নকর্তার কথা বুঝে সেই অনুযায়ী উত্তর দিতে পারে। এ ছাড়া সোফিয়ার মধ্যে এমন ব্যবস্থাই করা আছে যার ফলে যে-কোনও প্রয়োজনীয় মুহূর্তে সে কোনও প্রবীণকে হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে ভর্তি করার বা তাকে চিকিৎসা পাওয়ার বন্দোবস্ত করে দেওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে। এক কথায় এই রোবট-মানবীর গুণের কোনও শেষ নেই। এই পর্যন্ত সে প্রায় ৬৬-র বেশি দেশ ঘুরে বিভিন্ন সম্মেলনে তার বুদ্ধিমত্তার নজির রেখে গেছে। এই মানবী আবার সংসার করারও স্বপ্ন দেখে, সে-কথাও সে স্বীকার করেছে অকপটে। লস অ্যাঞ্জেলসবাসী এই কৃত্রিম মানবী যে তার অকৃত্রিম গুণে আজ প্রায় সকলেরই মন জয় করে নিয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

এত প্রশংসার পরেও কোথাও যেন মনে হয় মানুষের সৃষ্টি কখনও মানুষকেই ধ্বংস করবে না তো? বাঙালির প্রিয় সত্যজিৎ রায়ের যন্ত্রমানব গল্পের ‘অনুকূল’-এর মতো বা সম্প্রতিকালে বিখ্যাত অভিনেতা রজনীকান্তের বানানো রোবট-এ (Robot) দেখানো যন্ত্রমানব চিড্ডির মতো, এই সমস্ত যন্ত্রের মানবায়ন আমাদের গোটা মানবজাতিকে খাদের ধারে এসে দাঁড় করাবে না তো? প্রশ্ন থেকেই যায়।

Latest article