যে নারীদের হাতে তরবারি

কন্যা জায়া জননী। নারীদের প্রাথমিক পরিচয় আজও এই পরিসরেই সীমাবদ্ধ। যারা ব্যতিক্রম তারা নিয়মকেই যেন প্রমাণ করে। অকুতোভয় কিছুজন এরই মধ্যে কোনও প্রমাণের ধার-বাকির তোয়াক্কা না করে, গোল্লা ছুটের জীবন ত্যাগ করে, দেয় দে উড়াল। তাদের কাজ, তাদের শক্তি, তাদের উদ্যম, তাদের মনোবল বাকিদের হাতছানি দেয় জীবনযুদ্ধের ক্ষেত্র বদলের। তেমনই কিছু নারীর কথা জানাচ্ছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী ও সৌরভকুমার ভুঁইয়া

Must read

বন্যদের বন্ধু : ড. কৃতি কে কারান্থ
কৃতি কারান্থ যিনি তাঁর জীবনের বেশিরভাগ সময়, বিশেষ করে গত দুই দশক ধরে তথ্য সংগ্রহের জন্য কাটিয়েছেন ঘন জঙ্গল, তৃণভূমি, বন্যপ্রাণী-ভরা অভয়ারণ্য এবং পার্কের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে। বন্যপ্রাণীদের প্রতি এই অকৃত্রিম টান তাঁর আজকের নয়। খুব ছোট বয়স থেকেই বন্য-পশুপাখিদের সঙ্গে যুক্ত কৃতি। যে বয়সে কেউ বন্য পশু সামনে থেকে চাক্ষুষ করার কথা ভাবতেই পারবে না, চিড়িয়াখানায় যায় সেই আনন্দ উপভোগ করতে, সেই বয়সে অভয়ারণ্যে চোখের সামনে দেখেছিলেন বাঘ, চিতাবাঘ-সহ অনেক পশুকে। কে এই কৃতি কারান্থ? বেঙ্গালুরুস্থিত সেন্টার ফর ওয়াইল্ড লাইফ স্টাডিজের মুখ্য কনজারভেশন সায়েনটিস্ট বা সংরক্ষণ জীববিজ্ঞানী হলেন ড. কৃতি কে কারান্থ। যিনি ২০২১ সালে পেয়েছেন ‘ওয়াইল্ড লাইফ ইনোভেটর অ্যাওয়ার্ড’। ভারত তথা এশিয়ার প্রথম মহিলা হিসেবে তিনিই একমাত্র এই পুরস্কার বা সম্মানটি পেয়েছেন।

শৈশবেই সখ্যতা
কৃতির শৈশব আর পাঁচটা বাচ্চার মতো ছিমছাম, সরল ছিল না। তাঁর বাবা ড. উল্লাস ছিলেন খুব প্রসিদ্ধ বাঘ-জীববিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবাদী এবং ঠাকুরদা কোটা শিবরাম কারান্থ ছিলেন পরিবেশবিদ এবং লেখক। তাই ছোট থেকেই বাবা এবং ঠাকুরদার সঙ্গে ঘুরে বেড়াতেন জঙ্গলে, জাতীয় উদ্যানে, অভয়ারণ্যে ফলে বন্যপ্রাণী দেখতে দেখতেই বেড়ে ওঠা তাঁর। জীবনে প্রথমবার যে বন্যপশুটিকে চোখের সামনে দেখেছিলেন সে জঙ্গলের রাজা। একটা সাদা রঙের অ্যাম্বাসাডার গাড়ি চড়ে পরিবারের সঙ্গে নাগেরহোল জাতীয় উদ্যানে গিয়ে তাঁর প্রথম বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা হয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা চিতাবাঘও দেখতে পান কৃতি। অত ছোট বয়স, যখন জীবনকে সবে চিনতে শিখছেন কৃতি ঠিক তখন চোখের সামনে বাঘ আর চিতাবাঘ ঘুরতে দেখাটা তাঁর কাছে এক অনন্য, অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা ছিল। এরপর বছরের পর বছর সেই গহীন জঙ্গল, অভয়ারণ্য, জাতীয় উদ্যানগুলোই হয়ে ওঠে তাঁর শৈশবের খেলার মাঠ এবং সেই শৈশব স্মৃতিবিজড়িত খেলার মাঠগুলোই পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে তাঁর কাজেরও জগৎ। ফলে শৈশব থেকে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে সখ্য, তাঁদের প্রতি তীব্র আকর্ষণ খুব স্বাভাবিক ছিল।
এক বছর বয়স থেকেই কৃতি তাঁর বাবাকে সঙ্গ দিতে বেরিয়ে পড়তেন ওয়াইল্ড লাইফ এক্সপিডিশনে। কৃতির এই অন্বেষণ চলতে থাকে শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত।

অকৃত্রিম টানে
কিন্তু তা সত্ত্বেও পরিবারের তরফ থেকে কখনও কৃতিকে জোর করা হয়নি একই পেশায় বা নেশায় ভাগীদার হতে। উদার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা কৃতি কারান্থ নিজের পছন্দকে বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা পেয়েছিলেন। বাবাকে এই পেশায় নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে দেখেছিলেন তিনি ফলে প্রথমদিকে এই কাজ নিয়ে কৃতির মনে সংশয় ছিল। তিনি চাননি তাঁদের পথে হাঁটতে। তবে পরিবারে মা, বাবা, ঠাকুরদার মতোই পিএইচডি করতে চেয়েছিলেন। তাই চলে যান বিদেশে। কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে পোস্ট ডক্টরেট করেন। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর গবেষণা করার সময় জঙ্গলজীবন, বন্যপ্রাণীদের প্রতি একটা টান অনুভব করেন। জঙ্গলজীবন তাঁকে ডাকছিল। একটি প্রোজেক্টের জন্য কৃতি ভদ্রা অভয়ারণ্যে ফিল্ডওয়র্ক করেন চার মাস। এই সময় তিনি উপলব্ধি করেন যে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ এবং তাদের সুরক্ষার কাজে তাঁর যুক্ত হওয়া উচিত। এরপর থেকে তিনি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ, মানববসতি ও বন্যপ্রাণীর সম্পর্ক এবং মানুষ ও বনপ্রাণীর মিথস্ক্রিয়া এবং ভারতে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উন্নয়মূলক অনুশীলনের ওপর কাজ শুরু করেন। তাঁর গবেষণার উদ্দেশ্য মানুষ এবং পশুর মধ্যেকার বিরোধ মুছে প্রকৃতির সুন্দর ইকোসিস্টেমটিকে বাঁচিয়ে রাখা।
বর্তমানে কৃতি সেন্টার অফ ওয়াইল্ড লাইফ স্টাডিজের চিফ কনজারভেশন সায়েনটিস্ট। বাইরে ঘুরে অর্থাৎ ফিল্ডে গিয়ে কাজ করতেই পছন্দ করেন কৃতি ফলে ৪০টা দেশ তাঁর ঘোরা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। দেখে নিয়েছেন নানা ধরনের বন্য জীবনযাত্রা। তবে আজও ভদ্রা, বন্দিপুর এবং নাগরহোল অভয়ারণ্য কৃতির সবচেয়ে পছন্দের ওয়র্ক ফিল্ড।

কৃতিত্বের কৃতি
ইতিমধ্যেই কৃতির ঝুলিতে রয়েছে অনেক কৃতিত্ব। একশোর ওপর বিজ্ঞানভিত্তিক আর্টিকল লিখে ফেলেছেন ইংরেজি ও কন্নড় ভাষায়। তাঁর একটা এডিটোরিয়াল বোর্ডও রয়েছে। যেখানে ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইউকে, চিলি, অস্ট্রেলিয়া-সহ বহু দেশ থেকে প্রায় ২৫০ জন তরুণ বিজ্ঞানী রয়িছেন যাঁদের তিনি মেন্টর। প্রায় ৭৫০ জন স্বেচ্ছাসেবী নিযুক্ত করেছেন তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রোজেক্টের সঙ্গে। শুরু করেছেন বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। তাঁর বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও গবেষণাগুলো তিনটে অ্যাওয়ার্ড উইনিং বিবিসি সিরিজে দেখানোও হয়েছে। বন্যপ্রাণীদের নিয়ে পাঁচটি তথ্যচিত্রে সহকারী প্রযোজক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি। তাঁর বিভিন্ন কাজের জন্য বিভিন্ন সময়ে পেয়েছেন ৪৫টির বেশি সম্মান ও স্বীকৃতি। যার মধ্যে উল্লেখ্য, আইজেনহাওয়ার ফেলোশিপ, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম ইয়ং গ্লোবাল লিডার, ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং অ্যালামনাস, আইএনকে ফেলো, ‘ফেমিনা’র তরফে ইন্ডিয়া’স পাওয়ার উইমেন, ‘এলে ইন্ডিয়া’র তরফে উইমেন অফ দ্য ইয়ার, হয়েছেন ‘ভোগ’ উইমেন অফ দ্য ইয়ার এবং সিয়াটেল চিড়িয়াখানার থ্রাইভ কনজারভেশন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ইত্যাদি। শেষ হবে না তালিকা।

অকুতোভয় : জোসফাইন জোস
বয়স তাঁর প্রায় পঞ্চাশের কাছাকাছি। এই বয়সে যখন সবাই থিতু হয়ে বসার কথা ভাবেন বা দায়-দায়িত্ব সামলে বিশ্রাম নেওয়ার কথা ভাবেন ঠিক সেই বয়সে একা চারচাকায় ভর করে তিনি চষে বেড়িয়েছেন ১৮টি রাজ্য এবং ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল— তাও আবার মাত্র ৭৫ দিনে। তিনি জোসফাইন জোস। কেরলের ত্রিশূরের বাসিন্দা জোসফাইন পেশায় সাইকোলজিস্ট বা মনোবিজ্ঞানী। কিন্তু কেন এমন অদ্ভুত ইচ্ছে বা এমন এক অসম্ভব স্বপ্নপূরণের তাগিদ তৈরি হয়েছিল তাঁর মনে। জোসফাইনের মনে এই দুরন্ত আকাঙ্ক্ষার শুরুটা সেই কোন শৈশবে। বাবা জোস কাভালাক্কাট ছিলেন মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিসে। বাবার সঙ্গে জসফাইনের অনেক উজ্জ্বল স্মৃতি। বাবার টু-স্ট্রোক বাজাজ সুপার টু-হুইলারে চড়ে ঘুরে বেড়াতেন মেয়ে জসফাইন। সেই সময় বাবা তাঁকে প্রায়শই বলতেন গাড়িতে চেপে দেশভ্রমণের ইচ্ছের কথা। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল একসঙ্গে টু-হুইলারকে সঙ্গী করে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী সফর করার। বাবার এঁকে দেওয়া সেই স্বপ্ন মেয়ের চোখে এবং মনে গেঁথে গিয়েছিল তখন থেকেই।

স্বপ্নপূরণের অঙ্গীকার
কিন্তু ভাগ্য তাঁদের সেই স্বপ্নপূরণ করতে দেয়নি। এর মাঝে বাবার মৃত্যুর প্রায় ১৭ বছর অতিক্রান্ত। সেইসময় বাবা-মেয়ের ভাগ্য সঙ্গ না দিলেও পরলোকগত বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে এবং তাঁর সেই অধরা স্বপ্নকে পূরণ করতে জসফাইন সিদ্ধান্ত নেন গাড়ি করে ভারতভ্রমণের। খুব সহজ ছিল না এই সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তাতে টিকে থাকা। এই তো বিগত বছরের কথা প্রায় ছ’বছর ধরে একজন পেশাদার মনোবিদ হিসেবে ত্রিশূরে প্র্যাকটিস করেছিলেন জোসফাইন। তার আগে জোসফাইনের ছিল প্রায় ১৯ বছরের লম্বা এক সফল কর্পোরেট কেরিয়ার। মুম্বইয়ের একটি শেয়ার বিপণন সংস্থার জাতীয় গ্রাহক পরিষেবা-প্রধান হিসেবে কাজ করতেন জোসফাইন। সেই কাজের প্রতি নিষ্ঠা থাকা সত্ত্বেও এবং চূড়ান্ত সফলতা পেলেও একটা সময় শেয়ার মার্কেটের দীর্ঘ কর্পোরেট কেরিয়ার ছেড়ে দেন তিনি। কারণ জোসফাইনের মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। মায়ের সেবাযত্ন করার উদ্দেশ্যে ২০১৩ সালে ফিরে আসেন কেরল। পরিবারকে সময় দেন। সেইসময় নতুন করে ভারতভ্রমণের শখ আবার চেপে বসে। এর আগে একবার গাড়ি এবং সাইকেলে করে তাঁর লাদাখ ঘোরার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কেরলেই পেশাদার মনোবিদ হিসেবে প্র্যাকটিস শুরু করেছেন তখন। পাশাপাশি পিএইচডিও করছিলেন। কিন্তু পিএইচ ভাইভা স্থগিত হয়। সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হয়েছিল এটাই ঠিক সময় তাঁর এবং স্বর্গত পিতার স্বপ্নপূরণের জন্য। যদিও একটু তাড়াহুড়ো হয়ে গিয়েছিল প্রস্তুতি নিতে কিন্তু শেষপর্যন্ত তিনি অসাধ্যসাধন করতে সক্ষম হন। ২০২৪-এর ২ অক্টোবর যাত্রা শুরু করেন জোসফাইন। এই সম্পর্কে জোসফাইন বলেছেন, প্রতি বছর নিজেকে একটা করে অভিজ্ঞতা উপহার দেওয়া আমার অভ্যেস। সেই অভিজ্ঞতা আমার পছন্দের যা কিছুই হতে পারে। আর সেই তালিকায় কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর বাই রোড ঘোরা সবসময় থাকত। ওটাই ছিল আমার প্রথম প্রায়োরিটি। কিন্তু আমি পরিকল্পনা করে পথে বেরইনি। আসলে পরিকল্পনা করে কিছু হয় না। পুরোটাই ভাগ্য। ফলে অপরিকল্পিতভাবেই ইচ্ছেটা পূরণ হয়ে গেল। তিনি আরও বলেন, ‘আমি কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়েছিলাম নিরাপত্তার জন্য। আমার আত্মীয় কাজিন ভাই-বোন এবং আমার নিজের মা আর বোনকে বলেছিলাম আমার পিএইচডির থিসিস সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে যাচ্ছি। কারণ সবাই জানলে বাধা পেতে পারতাম।’

পায়ের তলায় সরষে
জোসেফাইনের পায়ের তলায় এবার সরষে। এই চলার পথে সঙ্গী হল তাঁর নতুন গ্র্যান্ড ভিটারা গাড়িটি। যার নাম তিনি রেখেছিলেন লাডলি। স্নেহ করে বলতেন লাড্ডু। ১৮ রাজ্য এবং ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গাড়ি করে ঘুরতে তিনি পার করেছেন মোটামুটি ১৪২৭৭ কিলোমিটার। যদিও বেরনোর সময় কতদূর যাবেন বা কতটা যেতে পারবেন এই বিষয় কোনও ধারণাই তাঁর ছিল না। তাঁর কাছে ছিল না সেই অর্থে কোনও রুট ম্যাপও, কোনও বিস্তারিত ভ্রমণপথ বা ভ্রমণগাইড। তাই প্রায়শই পথ পরিবর্তন করতে হত তাঁকে। নানারকম চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হত। জোসেফাইন নিজের সুরক্ষার্থে একটা নিয়ম চালু করেছিলেন, তা হল, রাতে তিনি কোনও সফর করবেন না। সারাদিন গাড়ি চালাতেন। সন্ধে গড়ালেই কোথাও হল্ট নিতেন। প্রতিদিন ভোর পাঁচটায় গাড়ি নিয়ে যাত্রা শুরু করতেন এবং বিকেল পাঁচটায় শেষ করতেন। সেইসময় যে এলাকায় রয়েছেন সেখানকার কোনও হোটেল অথবা হোম-স্টে খুঁজে নিতেন রাত কাটানোর জন্য। এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের মধ্যে একটা পাগলামিও ছিল।

হাল ছেড়ো না বন্ধু
কিন্তু সবরকম বাধা-বিপত্তির সম্মুখীন হয়েও হাল ছাড়েননি জোসেফাইন। একবার ওড়িশার কাছে একদল বাইকার তাঁকে আক্রমণ করে। সম্পূর্ণ একা একজন মহিলা দেখে ডাকাতি করবে বলে মিথ্যে দুর্ঘটনায় জড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল তারা। সেই সময় জোসেফাইন বুদ্ধি করে মরিচ স্প্রে এবং কাঠের লাঠি ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং কাছেই একটা গ্রামে পৌঁছে যান সাহায্যের জন্য। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর। গুজরাতের ওপর দিয়ে ভ্রমণের সময় একটা গরুকে ধাক্কা মারতে মারতে বেঁচে যান। বাঁচিয়ে নিয়েছিলেন গরুটিকে কারণ সেই সময় যদি নিজেকে এবং গাড়িটিকে সামলাতে না পেরে গরুকে ধাক্কা দিয়ে দিতেন তবে ওই এলাকার মানুষের ক্রোধ তাঁকে আর আস্ত রাখত না! কারণ গরু তাদের কাছে ভগবান। বিপদসঙ্কুল পথে হিমালয়, উত্তরাখণ্ডের রাস্তায় কতশত অবাধ্য, অধৈর্য ট্রাকচালকের মুখোমুখি হয়েছেন জোসফাইন।
সেই পথ, সেই ট্রাকচালকেরা তাঁকে শিখিয়েছে প্রবল চাপের মুখে মাথা ঠান্ডা রাখতে তা না হলে যে কোনও মুহূর্তে চরম বিপদ হয়ে যেতে পারে। সম্পূর্ণ একা একটা মেয়ের পদে-পদে এমন আতঙ্ক, ভয়, অ্যাডভেঞ্চারকে পুঁজি করে নিজের ধৈর্যে আর সংকল্পে অটল থেকে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। পাঞ্জাব এবং উত্তরপ্রদেশ ট্রিপ চলাকালীন অমৃতসর যাওয়ার পথে তিনি একদিনে ৭৫০ কিলোমিটার গাড়ি ড্রাইভ করেছিলেন। শুধু গাড়ি চালিয়ে গেছেন এমনটা নয়, বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছে নতুন গাড়ির সার্ভিসিংও নিজেই ম্যানেজ করে নিয়েছেন। প্রথমদিকে নিজের পরিবারের কাছে এই পুরো বিষয়টা গোপন করলেও পরের দিকে যখন তিনি কেরলে ফিরছেন, ফেরার পথে যেসব আত্মীয়স্বজনের বাড়ি পড়েছে সবার সঙ্গে দেখা এবং সৌজন্য বিনিময় করেছেন। পরবর্তীতে তাঁর এই অভূতপূর্ব সাফল্য পরে তিনি ভাগ করে নিয়েছেন মায়ের সঙ্গে। মা ব্লুমি জোস মেয়ের এই অভাবনীয় সাফল্যে খুশি তো বটেই, তিনি এটাই মনে করেন জোসফাইনের জন্য তাঁর স্বর্গত স্বামীও নিশ্চিতভাবেই আজ গর্বিত।

নারী বঞ্চনার প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর : জেহরা নিগাহ
উর্দু সাহিত্য হল ইতিহাস, সংস্কৃতি ও রাজনীতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এর ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ। সেই সমৃদ্ধির ধারায় নারীদের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। একটা সময় উর্দু সাহিত্যে ছিল পুরুষ আধিপত্য। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নারীরাও তাঁদের প্রতিভা ও সাহসী কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে উর্দু সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং তাদের অবস্থান মজবুত করেছেন। তেমনি এক সাহসী নারী কণ্ঠস্বর হলেন জেহরা নিগাহ।

শৈশবের কথা
জেহরা নিগাহ একজন কবি, লেখক ও চিত্রনাট্যকার। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ভারতের হায়দরাবাদে তাঁর জন্ম। দেশভাগের পর ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে পরিবারের সঙ্গে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে চলে আসেন। ছোটবেলা থেকে শিক্ষা এবং সাহিত্যিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন। বাবা গোলাম কাদির ছিলেন একজন সরকারি কর্মচারী তথা একজন লেখক। তাঁর বোন ফতিমা সুরাইয়া রাজিয়া ছিলেন উর্দু সাহিত্যের একজন খ্যতনামা ঔপন্যাসিক ও নাট্যকার। তাঁর ভাই আনোয়ার মাকসুদ ছিলেন লেখক। পরবর্তীকালে যাঁর সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল সেই মজিদ আলির সুফি কবিতার প্রতি আগ্রহ ছিল। এককথায় জীবনের চলার পথে সাহিত্যিক পরিমণ্ডল পেয়েছেন তিনি।
অভিজাত পরিবারে মেয়ে জেহরার বাড়িতে সংস্কৃতির পরিবেশ ছিল। তাঁর মা পর্দার আড়ালে থেকে ওস্তাদজির কাছে গানের তালিম নিতেন। তাঁর দাদু তাঁদের ভাইবোনেদের কবিতা পাঠে উদ্বুদ্ধ করতেন এবং নিজে দায়িত্ব নিয়ে তাঁদের হালি, ইকবালের কবিতা মুখস্থ করাতেন। কবিতার বিশ্লেষণ, শব্দের সঠিক উচ্চারণ ও তার অর্থ, সঠিক পাঠ পদ্ধতি তাঁদের বলে দিতেন। এসব জেহরাকে ছোটবেলা থেকে কবিতার প্রতি গভীরভাবে উৎসাহী করে তোলে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি বিখ্যাত কবিদের অসংখ্য কবিতা মুখস্থ করে ফেলেছিলেন। খুব ছোটবেলা থেকে জেহরা কবিতা লিখতে শুরু করেন। এই ক্ষেত্রে পরিবারের মানুষদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন যা তাঁকে গতানুগতিক সমাজ ভাবনার বাইরে গিয়ে এক নতুন ছন্দে জীবনকে চালিত করতে সাহায্য করেছিল। ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিকে উর্দু সাহিত্যের জগতে তিনি এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে হাজির হন।

শায়েরি, মুশায়েরা
অভিজাত বংশের নারীরা শায়রি, মুশায়েরা করবে এটা সেই সময়ে কল্পনাতীত ছিল। জেহরা সেই প্রচলিত ধারা ভেঙে দেন। এই ব্যাপারে পাশে পান পরিবারের মানুষজনকে। স্কুলে পড়ার সময় যখন স্থানীয় একটি মুশায়েরাতে যোগদানের আমন্ত্রণ পান বাড়ির লোক বাধা দেননি। ১৯৫৪-এ দিল্লি থেকে আমন্ত্রণ আসে মুশায়েরাতে যোগদানের জন্য। বলতে গেলে তখন তিনি ছিলেন কিশোরী। বাড়ির লোকজন তাঁকে বাধা দেননি। তবে তাঁরা চেয়েছিলেন জেহরা বোরখা পরে যাক। কিন্তু জেহরা বোরখা পরেননি। নিজের পছন্দমতো সালোয়ার কামিজ পরে গিয়েছিলেন। দিল্লিতে মুশেয়ারাতে তিনি মানুষের মন জয় করেন। তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু আলাদা করে তাঁর শায়েরি শুনেছিলেন। এভাবেই একটু একটু করে তাঁর কৃতিত্ব ছড়িয়ে পড়তে থাকে। পুরুষ-প্রাধান্যের কাব্যিক জগতে নিজের স্থান দৃঢ় করেন তিনি। অতি অল্প সময়ে তিনি শক্তিশালী নারী কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

নারীর যন্ত্রণার আবেগের কথা
জেহরা নিগাহর কবিতায় ফুটে উঠেছে নারীর স্বপ্ন, আবেগ, জীবনযন্ত্রণা, বঞ্চনা ও লড়াইয়ের কথা। সামাজিক রাজনৈতিক সংকট নিয়েও কবিতা লিখেছেন তিনি। কিছু কিছু কবিতায় যেমন প্রকাশ পেয়েছে নিষ্পাপ শৈশবের স্মৃতি, আবেগ তেমনি আবার স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাত ব্যক্ত করেছেন কবিতার মধ্য দিয়ে। সহজ সরল ভাষায় লেখা তাঁর কবিতাগুলি গভীর আবেগময় ও তাৎপর্যপূর্ণ।
‘দ্য মুনফ্লাওয়ার ট্রি’ কবিতায় তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন শৈশবের এক বাগানের কথা যার ফুলগুলিকে তিনি চাঁদের আলোর সঙ্গে তুলনা করেছেন। সেই গাছগুলিকে ভুতুড়ে মনে করা হত এবং বিজ্ঞ মানুষেরা তাতে পেরেক গেঁথে রেখেছিলেন যাতে করে সেই দুষ্ট আত্মারা বেরিয়ে এসে কারও ক্ষতি করতে না পারে। নিগাহর মতে, এই বন্দি আত্মারা আসলে নারীর সত্তা। পেরেকরূপী নানান সামাজিক রীতি, আচার আর কুসংস্কার দ্বারা তাদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। নারী জীবনের স্বপ্ন ও বাস্তবতার সংঘাত তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন এই কবিতায়।
‘মাই প্লেমেট’ কবিতায় তিনি শৈশব স্মৃতি আর অবচেতন মনের কথা ব্যক্ত করেছেন। এখানে তাঁর খেলার সাথী বলতে কোনেও ব্যক্তির কথা বলেননি তিনি। তাঁর মনের যেসব ইচ্ছে সামাজিক রীতি আর আচারের বেড়াজালে বন্দি, সেগুলিকে তিনি তাঁর খেলার সাথী বলে উল্লেখ করেছেন। নারী জীবনের শৃঙ্খলা ও পরাধীনতার ছবি ফুটে উঠেছে এই কবিতায়।

জেহরার কাব্যগ্রন্থ
তাঁর চারটি কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। ‘সাম কা পেহেলে তারা’, ‘ওয়ারাক’, ‘ফিরাক’ ও ‘গুল চাঁদনী।’ পাশাপাশি তিনি গজল লিখেছেন। নাটক এবং চিত্রনাট্যও লিখেছেন। এগুলিও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। জেহরা নিগাহর কথা বলতে গেলে যে কাব্যগ্রন্থটির কথা অবশ্যই করে বলতে হয় তা হল ‘দ্য স্টোরি অব ইভ।’ এই উর্দু কবিতার সংকলনটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন রাখশান্দা জলিল। এর মধ্যে ৬৫টি কবিতা ও ১১টি গজল রয়েছে। নারীজীবনের নানা দিক ফুটে উঠেছে এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলির মধ্যে দিয়ে। তার জীবনসংগ্রাম, যন্ত্রণা, সামাজিক শৃঙ্খলা প্রভৃতি তিনি তুলে ধরেছেন। সেই সঙ্গে ব্যক্ত করেছেন আত্মপরিচয় ও অস্তিত্বের জন্য নারীর লড়াইয়ের কথা। সমাজ নানারকম বিধিনিষেধ নারীদের ওপর চাপিয়ে দেয়। তাদের নিপীড়ন করে। এর সমালোচনা করেছেন তিনি। কন্যাভ্রূণ হত্যার নির্মম ছবি তুলে ধরেছেন। ‘ম্যায় বচ গয়ি মা’ কবিতায় এক অনাগত কন্যা মাকে জানিয়েছে সে জন্মলাভ করেনি তাই সে বেঁচে গেছে। বিদ্রুপাত্মক সুরে কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনা ও সাহসী প্রতিবাদ করেছেন তিনি। নারীর পোশাক নিয়ে সমাজের যে দৃষ্টিভঙ্গি তার সমালোচনা করেছেন তিনি। একটি কবিতায় তিনি বলেছেন, আমি যদি আমার মাথা থেকে পর্দা সরিয়ে ফেলতাম তাহলে আমার ভাইয়ের পাগড়ি মাটিতে পড়ে যেত অর্থাৎ ভাইয়ের সম্মান লুণ্ঠিত হত। নারীর পোশাকের ওপর পুরুষের মর্যাদা নির্ভর, এটাকে তিনি মানতে পারেননি। নারী কী পোশাক পরবে এটা পুরুষ ঠিক করে দেবে? তিনি এর কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলছেন নারী কেবল একজন কন্যা, স্ত্রী কিংবা মা নয়; সে এক স্বতন্ত্র সত্তা। তার মন আছে, নিজস্ব ইচ্ছে-অনিচ্ছে, চাওয়া-পাওয়া আছে। সমাজের নানান ধর্মীয় নীতি, কুসংস্কার যার শিকার নারীরা তার সমালোচনা করেছেন। ইভের কথা আমরা অনেকেই জানি। খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাস মতে ইভ হলেন সৃষ্টির প্রথম নারী। সেই হিসেবে প্রতিটি নারীর মধ্যে রয়েছে ইভের সত্তা। সেই ইভকে নারী জাতির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করেছেন। এছাড়াও বাতাস, নদী, পাথর প্রভৃতি নানান চিত্রকল্প অসাধারণ দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন। এককথায় এই কাব্যগ্রন্থর কবিতাগুলি আসলে সাহসী নারীর বলিষ্ঠ প্রতিবাদ। সমাজকে তিনি চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁদের বলতে চেয়েছেন নারীদের দমিয়ে না রেখে তাদের প্রকৃত মর্যাদা দিতে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে এমন বলিষ্ঠ উচ্চারণ তাঁকে অনন্যতা দান করেছে।
সাহিত্যকর্মের জন্য তিনি অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রাইড অফ পারফরম্যান্স পুরস্কার। ২০০৬ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি তাঁর হাতে এই পুরস্কার তুলে দেন।
জেহরা নিগাহ উর্দু সাহিত্য জগতে এক অমূল্য সম্পদ। তিনি কেবল একজন কবি নন। নিজের কবিতার মাধ্যমে নারী জাগরণের জয়গান গেয়ে আগামী প্রজন্মের নারীদের কাছে নিজেকে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে স্থাপন করেছেন।

সুপার-মম : র্যা চেল কৌর
প্রতিদিন ভোরের আলো ফোটার আগে বাসা থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি। তারপর আকাশে ডানা মেলে দেন। তবে তিনি পাখি নন। সত্যিকারে ডানাও নেই তাঁর। উড়োজাহাজে চেপে আকাশে ভেসে পড়েন তিনি, পৌঁছে যান নিজের কর্মক্ষেত্রে। দিনের কাজ শেষে আবারও আকাশ পাখির ডানায় চেপে বাড়ি ফিরে আসেন। প্রতিদিন এভাবে আকাশ পাড়ি দিয়ে অফিস আর সংসার সামলে সম্প্রতি শিরোনামে উঠে এসেছেন যে দুঃসাহসী নারী তিনি হলেন ‘সুপার মম’ র্যাচেল কৌর। আজকের দিনে অনেক চাকরিজীবী বাবা-মা পরিবার আর কর্মক্ষেত্র সামলাতে গিয়ে হিমশিম খান। প্রতিদিন যেন অসম লড়াই লড়তে থাকেন আর হয়তো নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করেন। র্যাচেল কৌর সেখানে ব্যতিক্রম। পরিবারকে তিনি যেমন গুরুত্ব দেন, সমান গুরুত্ব দেন কর্মক্ষেত্রকে। আর দুই জায়গার মধ্যে সাম্য বজায় রাখতে তিনি দুঃসাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। প্রতিদিন প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার পথ বিমানে পাড়ি দিয়ে অফিস যান তিনি। কাজ শেষে সেই একই পথ পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন। ব্যাপারটা শুনতে অবাস্তব কিংবা অসম্ভব মনে হলেও সত্যি। সেই অসম্ভবকে সত্যি করেছেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত র্যাচেল কৌর।

আর নারী নয় দুর্বল
সভ্যতার ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় দীর্ঘ সময় ধরে নারীরা লাঞ্ছনা, বঞ্চনা, অবমাননার শিকার। তাঁদের গায়ে ‘দুর্বল’ এর তকমা এঁটে দিয়ে এসেছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। আজও যে সেই ধারণার আমূল বদল ঘটে গেছে এমনটা নয়। তবে নারীরা কোনওকালে দুর্বল ছিলেন না, আজও নয়। আজকের নারী তাঁদের কর্মদক্ষতা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন তাঁরা পুরুষদের থেকে কোনও অংশে কম নন। অনেকক্ষেত্রে তাঁরা পুরুষদের টেক্কা দিয়েছেন। র্যাচেলের ঘটনা সেটাই প্রমাণ করে। একজন মেয়ের পক্ষে রোজ সাতশো কিলোমিটার বিমান যাত্রা করে অফিস আর পরিবার সামলানো, ব্যাপারটা ভাবতে গেলে বিস্ময়ে থ হয়ে যেতে হয়। সেই অসাধ্য সাধন করেছেন ‘সুপার মম’ র্যাচেল কৌর।

আরও পড়ুন-জনতাই মমতার ক্ষমতা, এটাই ওরা বুঝছে না

দুঃসাহসিকতায়
পৃথিবীর সমস্ত সম্পর্কের মধ্যে সবচেয়ে মধুর এবং নিবিড় হল মা ও সন্তানের বন্ধন। সন্তানের জন্য মায়ের কৃচ্ছ্রসাধনের কত না ঘটনার কথা আমরা শুনে থাকি। তাই বলে র্যাচেলের মতো এমন দুঃসাহসিক কাজ! দুঃসাহসিকই বটে। প্রতিদিন সন্তানদের দেখার জন্য, তাদের পাশে থাকার জন্য, তাদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য তিনি বেছে নিয়েছেন অবিশ্বাস্য এক আকাশযাত্রা।
র্যাচেল কৌর এয়ার এশিয়ার ফাইনান্স অপারেশন বিভাগের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। তাঁর বাড়ি মালয়েশিয়ার পেনাং-এ আর অফিস কুয়ালালামপুরে। প্রথমে তিনি অফিসের পাশাপাশি একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতেন। সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরতেন। তাঁর দুই সন্তান। ছেলের বয়স বারো আর মেয়ের এগারো। পাঁচদিন সন্তানদের ছেড়ে থাকাটা তাঁর কাছে মানসিক যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে। পাশাপাশি একজন দায়িত্বশীল মা হিসেবে তিনি অনুভব করেন এই সময় ছেলেমেয়েদের পাশে তাঁর থাকা দরকার। কেননা মায়ের সান্নিধ্য সন্তানদের সুন্দর বিকাশের পক্ষে জরুরি। এমতাবস্থায় তাঁর সামনে সমাধানের সহজ যে পথটি ছিল তা হল কাজ ছেড়ে দেওয়া। র্যাচেল তেমনটা ভাবেননি। আসলে তিনি নেতিবাচক ভাবনার মহিলা নন। তিনি বোঝেন কাজ ছেড়ে দেওয়াটা প্রকৃতপক্ষে কোনও সমাধান নয়। ওটা আসলে হেরে যাওয়া। কর্মক্ষেত্র সামলেও পরিবারকে সময় দিতে পারাটাই হল সত্যিকারের সফলতা। সেই সাফল্যের পথে হাঁটতে চেয়েছেন তিনি।
সেক্ষেত্রে তাঁর সামনে দ্বিতীয় যে পথটি খোলা ছিল তা হল বাড়ি থেকে কাজ করা। করোনা মহামারীর পর থেকে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতি কমবেশি অনেক অফিসে চালু হয়েছে। কিন্তু র্যাচেল ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ পদ্ধতিতে কাজ করতে পছন্দ করেন না। প্রথমত, অফিসে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। তিনি বোঝেন সহকর্মীদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলে কোনও কাজ যত সুষ্ঠুভাবে হবে, ঘরে বসে সেটা সম্ভব নয়। অনেক সময় কাজের ক্ষেত্রে একে অপরের পরামর্শের প্রয়োজন হয়। অফিসে থাকলে সেটা যতটা সহজে সম্ভব, বাড়ি থেকে নয়। তাছাড়া অফিসে বসে কাজ করলে নিজেকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করা যায়। এসব নানান কথা চিন্তা করে ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোমে’র ভাবনা তিনি মাথা থেকে সরিয়ে দেন।

অতিমানবীয় যাত্রাপথে
র্যাচেলের কাছে তখন বিকল্প বলতে সাধারণ চোখে কিছু ছিল না। কিন্তু র্যাচেল সাধারণ নারী নন। তাই তাঁর ভাবনাচিন্তাও অসাধারণ। অনেক ভেবে তিনি দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেন। স্থির করেন প্রতিদিন বাড়ি থেকে বিমানে করে অফিস যাতায়াত করবেন। প্রতিদিন ৭০০ কিলোমিটার বিমানযাত্রা! শুনলে মনে হবে পাগলামি। কিন্তু সংসারের প্রতি ভালবাসা আর কর্মক্ষেত্রের প্রতি দায়বদ্ধতায় শেষমেশ সেটাকেই জীবনের রুটিন করে ফেলেন তিনি। বিগত বর্ষের প্রথম দিক থেকে শুরু হয় তাঁর এই রোজকার অতিমানবীয় বিমানযাত্রা। প্রতিদিন ভোর চারটের সময় ঘুম থেকে ওঠেন তিনি। প্রাত্যহিক কাজকর্ম সেরে পাঁচটার সময় বাড়ি থেকে বের হন। নিজে ড্রাইভ করে পৌঁছে যান বিমানবন্দরে। ৫-৫৫-তে তিনি চেক ইন করেন। বিমান ছাড়ে সাড়ে ছ’টার একটু পরে। কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকে তাঁর অফিস খুব দূরে নয়। অফিস শুরুর সময় সকাল ন’টা। কিন্তু আটটার মধ্যে তিনি অফিসে পৌঁছে যান। দিনের কাজ শেষে বিমান ধরে রাত্রি আটটার মধ্যে আবার বাড়ি ফিরে আসেন। এত দীর্ঘ যাত্রার পরও কাজ শেষ হয়ে যায় না তাঁর। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় টুকটাক সাহায্য করেন, তাঁদের সঙ্গে গল্প করেন। রোজকার এই বিমানযাত্রা তাঁর কাছে একদমই একঘেঁয়েমির হয়ে ওঠে না। এই সময়টা তিনি একান্ত নিজের মতো করে কাটান। ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রর্থনা করেন, গান শোনেন, বাইরের শোভা দেখেন, নিজের জীবন ও পরিবার নিয়ে পরিকল্পনা করেন। তবে প্রতিদিন এই দীর্ঘ বিমানযাত্রা কি তাঁকে ক্লান্ত করে না? অবশ্যই করে। কিন্তু দিনের শেষে বাড়ি ফিরে যখন সন্তানদের দেখেন, তাদের সঙ্গে সময় কাটান তখন সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
রোজকার এই বিমানযাত্রা তাঁকে আর্থিক সাশ্রয়তাও দিয়েছে। আগে কুয়ালালামপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকার সময় প্রতি মাসে যে খরচ হত, রোজকার বিমানযাত্রায় তার থেকে অনেক কম খরচ হয়।
র্যাচেলের এই দুঃসাহসিক কাজের জন্য কেউ কেউ তাঁকে আখ্যা দিয়েছেন ‘সুপার মম’, কেউ বলছেন ‘সুপার কম্পিউটার।’ যে সম্বোধনে ডাকা হোক না কেন র্যাচেল আসলে একজন অতিমানবীয় নারী। তাঁর এই রোজকার বিমানযাত্রা নিয়ে সমজমাধ্যমে ঝড় উঠেছে। অনেকে যেমন তাঁকে বাহবা জানিয়েছেন, তেমনি নিন্দা করার লোকজনের সংখ্যাও কম নয়। অনেকে তাঁকে পাগল বলে মন্তব্য করেছেন। কেউ কেউ বলেছেন র্যাচেলের পক্ষে এমনটা করা সবসময় সম্ভব হবে না। এরকম অসংখ্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক মন্তব্য আছড়ে পড়ছে সমাজমাধ্যমের পাতায়।

পাগলামি নয়, স্নেহের টানে
র্যাচেলের কাজকে যদি পাগলামি বলে ধরে নেওয়াও যায়, তাহলে বলতে হবে সন্তানের জন্য এমন পাগলামি কেবল একজন মায়ের পক্ষেই বোধহয় সম্ভব। আর পাগলামি হোক বা অন্য কিছু, অতিমানবীয় কাজটি তো তিনি করে চলেছেন এবং বেশ সাফল্যের সঙ্গে। সমালোচকদের কথা মেনে নিয়ে ধরা যাক তিনি সবসময় এমনটা করতে পারবেন না। তবুও তাঁর এই কৃতিত্বকে ছোট করা যাবে না। কোনও কিছু সবসময় একইভাবে করে যেতে হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। প্রয়োজনের তাগিদে র্যাচেল তাঁর রোজকার জীবন রুটিনে পরিবর্তন আনতেই পারেন। তবে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে যে অতিমানবীয় কাজটি তিনি করে চলেছেন তাতে তাকে কুরনিশ জানাতে হয়। র্যাচেল আরও একবার প্রমাণ করে দিয়েছেন নারীরা কোনওভাবেই দুর্বল নয়। মাতৃত্বের চিরকালীন সুর বহন করে তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন, সন্তানের জন্য মা যে কোনও অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন।
র্যাচেল কৌর কেবল একজন মা কিংবা চাকুরে নারী নন। তিনি দায়িত্ব, কর্তব্য, ভালবাসা ও অধ্যাবসায়ের মূর্ত প্রতীক। নিজের কাজ দিয়ে তিনি প্রমাণ করে দিয়েছেন লক্ষ্য যদি স্থির হয় আর মনে যদি থাকে দৃঢ় সংকল্প তাহলে কোনও কাজই অসম্ভব নয়; যে কোনও প্রতিকূলতাকে অনায়াসে জয় করা যায়। জীবনের চলার পথে ব্যতিক্রমী ও দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি যে নজির গড়েছেন তা কর্মক্ষেত্রের মানুষদের কাছে তো বটেই, পাশাপাশি সমস্ত মায়েদের কাছেও জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা।

Latest article