চির আনন্দের দিশারি স্বামী বিবেকানন্দ

আজ তাঁর ১২৩তম প্রয়াণ দিবস। আজকের দিনে ভারতাত্মার মূর্ত প্রতীক স্বামী বিবেকানন্দের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করলেন দেবু পণ্ডিত

Must read

যথা নদীয়াঃ স্যান্দমানাঃ সমুদ্রে অস্তম
গচ্ছন্তি নামরূপ বিহায়া
তথা বিদ্যান নমরূপাদ্ বিমুক্তঃ পরত
পরম পুরুষমুপাইতি দিব্যম্
মুণ্ডক উপনিষদ-এর বার্তা। অর্থ খুব স্পষ্ট। যেমন দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে উদ্ভূত স্রোতগুলি শেষ পর্যন্ত একই মহাসাগরে তাদের পথ খুঁজে পায়, তেমনি এখানে এবং সারা বিশ্বে উদ্ভূত বিভিন্ন ধর্মগুলি শেষ পর্যন্ত একই আধ্যাত্মিক লক্ষ্যে নিয়ে যায়।
ঠিক এই কথাটাই স্বামী বিবেকানন্দর (Swami Vivekananda) বাণীর মূল কথা।
এই ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান আজকের ভারতে রাজনৈতিকভাবে অতি প্রয়োজনীয়। ভারতে হিন্দু ছাড়াও কোটি কোটি মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি এবং বসবাস করে। একটি ধর্মীয় চেতনাকে আঁকড়ে থাকায় সংকীর্ণ রাজনৈতিক সুবিধা থাকতে পারে, কিন্তু আসল মনোভাব হল সমস্ত ধর্মের লক্ষ্যের ঐক্যকে মেনে নেওয়া। এটিই স্বামী বিবেকানন্দের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।
এরকম আর একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল মানুষের দেবত্ব। ঈশ্বরের দেবত্ব একটি খুব অভিনব ধারণা নয়। কারণ, সবার উপরে যদি একজন ঈশ্বর থাকে তবে তিনি ঐশ্বরিক হতে বাধ্য। এটা সম্পর্কে খুব বিশেষ নতুনত্ব কিছু নেই। কিন্তু বেদ এবং উপনিষদ মানুষের দেবত্ব প্রচার করে। মানব জাতির জন্য উপনিষদের একটি চমৎকার শব্দ রয়েছে : অমৃতস্য পুত্র। তার মানে, এই গ্রহে জন্মগ্রহণকারী প্রতিটি মানুষ, সে ধনী হোক বা দরিদ্র, হোক সে হিন্দু বা মুসলিম বা অন্য কোনও ধর্মের অনুসারী, সে ভারতে জন্মগ্রহণ করুক বা অ্যান্টার্কটিক বা পৃথিবীর অন্য কোনও প্রান্তে তিনি আদতে ‘অমরত্বের সন্তান!’ অমরত্ব তার জন্মগত অধিকার।
স্বামীজি একবার লিখেছিলেন যে তাঁর আদর্শকে কয়েকটি শব্দে তুলে ধরা যেতে পারে। আর তা হল মানবজাতির কাছে তাদের দেবত্ব প্রচার করা এবং জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে কীভাবে তা প্রকাশ করা যায়, সেটা তুলে ধরা। স্বামীজি সকল ধর্মের ঐক্যর কথা বলতেন। তাঁর শিক্ষা শুধু অন্য ধর্মের প্রতি সহনশীলতা নয়। কারণ, সহনশীলতা মূলত একটি নেতিবাচক মনোভাব। সহনশীলতা মানে কেবল বিরোধিতার অনুপস্থিতি। স্বামীজি যা প্রচার করতেন সেটা এটা নয়। তিনি বোঝাতে চাইতেন সেটা হল সকল ধর্মের ঐক্যের ইতিবাচক স্বীকৃতি। আসলে, তিনি পুরানো ঋগ্বেদিক অনুশাসন প্রচার করছিলেন— একম সত বিপ্রহা বহুধা বদন্তি। সত্য এক, জ্ঞানীরা একে বহু নামে ডাকে।

অথচ, বিজেপি প্রতিক্রিয়াশীল দলীয় রাজনীতির স্বার্থে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতায় মত্ত হয়ে সামাজিক বিভাজন তীব্র করতে কয়েক বছর ধরেই তৎপর। এবং তারা এতই অধঃপতিত যে, এই নিকৃষ্ট কাজে তারা স্বামী বিবেকানন্দের শিক্ষা ও বাণীকে বিকৃতভাবে ব্যবহার করে নিজেদের রাজনৈতিক হিন্দুত্বের ন্যায্যতা প্রমাণ করতে চায়। বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda) হিন্দু ধর্মের প্রবক্তা হলেও যেহেতু তাঁর ধর্মচর্চার মধ্যে কায়েমি স্বার্থ ছিল না। তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। তাই, মৌলবাদ-বিরোধী বহু কথা তিনি নির্দ্বিধায় বলেছেন। ইসলাম, খ্রিস্টান ইত্যাদি নানা ধর্মের দোষগুণ নিঃসঙ্কোচে আলোচনা করেছেন। শশধর তর্কচূড়ামণির আলোচনার জবাবে হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে বিবেকানন্দ বলেছেন যে, ‘‘…হিন্দু ধর্ম যেমন পৈশাচিকভাবে গরিব ও পতিতের গলায় পা দেয়, জগতে আর কোনো ধর্ম এমন করে না।’’ নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, মোদির ভারতে এরকম কথা বললে সেটা সংসদের কার্য বিবরণী থেকে বাদ পড়ে যেত। কোতল হত বিবেক বাণী।
ধর্ম-কর্ম প্রসঙ্গে বিবেকানন্দ বলেছেনঃ ‘‘যদি ভাল চাস তো ঘণ্টাফণ্টাগুলোকে গঙ্গার জলে সঁপে দিয়ে সাক্ষাৎ ভগবান নর-নারায়ণের— মানবদেহধারী হরেক মানুষের পূজো করগে— বিরাট আর স্বরাট। বিরাট রূপ এই জগৎ, তার পূজো মানে তার সেবা— এর নাম কর্ম; ঘণ্টার উপর চামর চড়ানো নয়, আর ভাতের থালা সামনে ধরে দশ মিনিট ব’সব কি আধ ঘণ্টা ব’সব— এ বিচারের নাম কর্ম নয়, ওর নাম পাগলা-গারদ। ক্রোর টাকা খরচা করে কাশী বৃন্দাবনের ঠাকুর ঘরের দরজা খুলছে আর পড়ছে। এই ঠাকুর ভাত খাচ্ছেন তো এই ঠাকুর আঁটকুড়ির ব্যাটাদের গুষ্টির পিণ্ডি করছেন; এদিকে জ্যান্ত ঠাকুর অন্নবিনা, বিদ্যাবিনা মরে যাচ্ছে। …তোদের বুদ্ধি নাই যে, একথা বুঝিস।’’ (বাণী ও রচনা, ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা ৪৮)

আরও পড়ুন: ব্রিটেনে আজ ভোট, সুনকের হারের ইঙ্গিত

ধর্ম প্রতিষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন : ‘‘জীবন্ত ঈশ্বর তোমাদের সঙ্গে রহিয়াছেন, তথাপি তোমরা মন্দির, গির্জা নির্মাণ করিতেছ, আর সর্বপ্রকার কাল্পনিক মিথ্যা বস্তুতে বিশ্বাস করিতেছ। মানবাত্মা বা মানবদেহই একমাত্র উপাস্য ঈশ্বর। …মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ মন্দির- মন্দিরের মধ্যে তাজমহল।’’ (বাণী ও রচনা, ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৫১)। একথা শুনলে রামমন্দিরের ধ্বজাধারীর কী বলবেন? কী করবেন?
মহাত্মা গান্ধী এবং স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekananda)। আধুনিক ভারত নির্মাণের দুই স্থপতি। প্রথম জনকে হত্যা করেছিল গেরুয়া পার্টির লোকজন। আর দ্বিতীয় জনকে বেদীতে বসিয়ে ঠাকুর বানিয়ে রেখেছে তারাই। স্বামীজির প্রতিটি বক্তৃতার মুদ্রিত কপি মোহনদাস পড়তেন রীতিমতো খুঁটিয়ে। অগ্নিবর্ষী সেইসব বাণী ছুঁয়ে যেত তার মর্মস্থল। অবিনাশী লিঙ্গমকে একটি চিঠিতে (২২ জুলাই, ১৯৪১) বলেছেনও সে কথা— ‘নিশ্চিতরূপেই স্বামী বিবেকানন্দের লেখা সম্বন্ধে কারও কাছ থেকে কোনও রকম ভূমিকার আবশ্যক হয় না, পাঠকের হৃদয়ে তার আবেদন অবিনাশী!’ দুই মহামানবের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ হয়নি, কিন্তু ভাবাদর্শে দিক থেকে তাঁদের ছিল গভীর একাত্মতা। মহাত্মার ক্ষেত্র রাজনীতির মঞ্চে, বিবেকানন্দের ক্ষেত্র আধ্যাত্মিক বেদিতে, কিন্তু ‘অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, শূদ্র জাগরণ, সর্বসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার’— এই লক্ষ্যে উভয়েই নিজের মতো করে ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ দেশ ও দেশবাসীর নিঃস্বার্থ সেবা করেছেন।
২৭ ডিসেম্বর, ১৯০১-এ গান্ধীজি ভারতীয়দের অধিকার সংক্রান্ত একটি রেজ়লিউশন পেশ করতে কলকাতায় কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিতে আসেন। আবেগভরে প্রায় পায়ে হেঁটে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে দেখা করতে চলে আসেন বেলুড় মঠে, তাঁর নিজের কথায়— ‘তাঁকে চাক্ষুষ দর্শন না করে থাকতে পারা আমার পক্ষে অসম্ভব!’ কিন্তু মঠে এসে জানতে পারেন, স্বামীজি বেলুড়ে নেই, কলকাতায়, খুবই অসুস্থ, কারও সঙ্গে দেখা করছেন না। গান্ধীজির চেয়ে বয়সে বছর ছয়েকের বড় স্বামীজি এর পর আর বেশি দিন পৃথিবীতে থাকেননি। ৪ জুলাই, ১৯০২-এ তিনি দেহরক্ষা করেন। মহাত্মার ক্ষেত্র রাজনীতির মঞ্চ, বিবেকানন্দের ক্ষেত্র আধ্যাত্মিকতার বেদি, কিন্তু উভয়েই দেশ ও দেশবাসীর নিঃস্বার্থ সেবা করেছেন। আর সেই কথাটা গুলিয়ে ও ভুলিয়ে দিতে এখন তৎপর গেরুয়া পার্টি। এ-কথা ভুলে যাওয়া পাপ।

Latest article