একেনবাবু একাই একশো

পাহাড় জয়ের পর এবার মরুভূমি বিজয়! বড়পর্দায় একেনবাবুর বিস্তার ক্রমশ জমে উঠছে! বাংলা নতুন বছরে মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য একেন রুদ্ধশ্বাস রাজস্থান’। ফের মুগ্ধ করেছেন একেন্দ্র সেন। বাঙালি রহস্য ভালবাসে। সাহিত্যে হোক বা সিনেমায় তাই গোয়েন্দা ও সহযোগীদের নজরকাড়া ভিড়। কিন্তু একেনবাবু একাই যেন একশো! জানাচ্ছেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

গত কয়েক বছরে থ্রিলার আর রহস্যে টলিউড টানটান। ছোটপর্দা, ওয়েব সিরিজ, বড়পর্দা সর্বত্র রহস্য-সন্ধানী আর গোয়েন্দাদের দাপটে খানিক কোণঠাসা বাকি নায়ক-চরিত্ররা। রহস্য-সিনেমায় হাত পাকাননি এমন পরিচালকও টালিগঞ্জে খুঁজে পাওয়া ভার। প্রযোজকদের মধ্যেও এমনকী লড়াই বেধেছে গোয়েন্দা গল্পের স্বত্ব ইত্যাদি নিয়ে। তবু উৎসাহে ঘাটতি পড়েনি, উদ্দীপনাতেও নেই ভাটার টান। এহেন পরিস্থিতিতেই একেনবাবুর আবির্ভাব এবং ধারে-ভারে ও কাটতিতে টপ অর্ডার-গোয়েন্দাদের সরাসরি চ্যালেঞ্জ! ওয়েব সিরিজে নিজেকে শানিয়ে নেওয়ার কারণেই হয়তো গোয়েন্দা একেন্দ্র সেনের আত্মবিশ্বাস নজরটানার মতো। আর এই আত্মবিশ্বাসের এলিমেন্টগুলি এতই ইউনিক যে আট থেকে আশির অনায়াস ফ্যান-বেস তৈরি। ‘দ্য একেন রুদ্ধশ্বাস রাজস্থান’ (The Eken Ruddhaswas Rajasthan) তাই অত্যন্ত উপভোগ্য একটি ছবি সব বয়সি দর্শকের জন্য। আশা করাই যায় গরমের ছুটিতে এ-ছবি আরও লাভের মুখ দেখবে।

তাপমাত্রা চল্লিশ ছুঁলেও ঠাণ্ডা হল-এ বসে রাজস্থান ভ্রমণ আপাতভাবে আহ্লাদিত করলেও আদতে তা যে বাঙালির নস্টালজিয়া উসকে দেওয়ার কারণে সচেতনভাবেই করা, ছবি এগোলেই দর্শক বুঝতে পারবেন। সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা’র প্রতি পরিচালকের সশ্রদ্ধ ও সুচারু নিবেদন যেন পরতে পরতে। প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ আলাদা কিন্তু অতি-চেনা অতি-আপন মুহূর্তগুলো মনে পড়াতে বাধ্য করেছেন পরিচালক জয়দীপ মুখোপাধ্যায়। একই সঙ্গে যে ছবিটি তিনি বানাতে চেয়েছেন তার দাবি মেনে প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শকের শিরদাঁড়া খাড়া করে দেওয়ার মতো রোমাঞ্চ সরবরাহের কাজেও একশো শতাংশ সফল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই হাজির করেছেন তাঁর গোয়েন্দাকে কিন্তু এতই নিপাটভাবে যে দর্শক যতটা গল্পের সঙ্গে ততটাই চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় অবিলম্বে।

আসলে সাবেক গোয়েন্দাদের যাবতীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে একেনবাবু এতটাই ‘ইন্টারেস্টিং’ এক গোয়েন্দা-চরিত্র যে দর্শক মাথাতেই রাখবে না সব সময়, যে রহস্যের ভাগে কতটা কম পড়ল! মাছে-ভাতে বাঙালি তো আরও অনেকেই কিন্তু এমন হাড়-কিপটে, চূড়ান্ত বাজে বকা, তস্য তস্য পিজে (পুওর জোক) বলে নিজেই হ্যা হ্যা করে হাসা, খাবার দেখলে ঝাঁপিয়ে পড়া, সহযোগীদের মুহুর্মুহু অপ্রস্তুত করা কিন্তু তীক্ষ্ণধী, ধুরন্ধর আর অতুলনীয় মগজাস্ত্রের প্রয়োগে আপন মনে কাজের কাজ করে যাওয়ার জুড়ি মেলা ভার। অনির্বাণ চক্রবর্তীর সঙ্গে প্রয়াত লেখক সুজন দাশগুপ্ত-সৃষ্ট একেনবাবুর চেহারার যে কোনওই মিল নেই তা এতদিনে সকলেই জেনে গেছেন কিন্তু যেটা না বললেই নয়, তা হল, অনির্বাণ যেভাবে একেনবাবুর চরিত্রটা একাত্ম করে পর্দায় উপস্থাপিত করেন তাতে একেনবাবুকে শুধু দর্শক নন পাঠকও আলাদা কিছু আর কল্পনা করতে পারবেন না। একজন অভিনেতার কাছে এ সাফল্য যে অনবদ্য তা স্বীকার করেন অনির্বাণ নিজেও। পছন্দের গোয়েন্দাকে দেখে মুগ্ধ হওয়া যায়, ভালবেসে ফেলে ক’জন?! একেন-রূপী অনির্বাণ ভালবাসাটা আদায় করে নেন নিজ-গুণে!

আরও পড়ুন: অ্যালোপ্যাথ চিকিৎসকদের সমান বেতন পেতে পারেন না আয়ুর্বেদিক বা হোমিওপ্যাথরা : সুপ্রিম কোর্ট

পেট অচল না করে মাথা সচল রেখে চলা এহেন একেন্দ্র সেন কিন্তু রহস্য সমাধানে রাজস্থানে (The Eken Ruddhaswas Rajasthan) যাননি। গিয়েছিলেন সঙ্গী প্রমথ ও বাপিবাবুর সঙ্গে নিছক বেড়াতে। কিন্তু ঘটনাচক্রে জড়িয়ে পড়া মূর্তিচুরির রহস্য সমাধানে। শুরুতেই দেখা যায় ভারত-পাক সীমান্তের কাছে একটি অ্যান্টিক মূর্তি হাত বদল হতে ও সেই কারণে একটা খুন হতে। খানিক বাদেই জানা যায় ইন্দাস ভ্যালি সিভিলাইজেশনের একখানি বহুমূল্য ষাঁড় খোয়া গেছে যেটা উদ্ধার হয়েছিল কালিবঙ্গান থেকে এবং জয়সলমির মিউজিয়ামে তার বদলে কেউ রেখে দিয়েছে নকল মূর্তি। অক্সফোর্ড থেকে আগত অধ্যাপক শতদ্রু ঘোষ, যিনিও আবার ওই মূর্তিটির সন্ধানেই এসেছেন, মিউজিয়ামের কিউরেটর রাজ্যশ্রী সেন, এক কর্মচারী এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ড. আনন্দ ওরফে সবাই মিলে রহস্যটা জটিল করে তোলেন। আচরণে, কথায় সারাক্ষণ সবাইকে অস্থির করে তুললেও নিজে স্থির মাথায় সবটা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে কেস সমাধান করেন একেনবাবুই। পদ্মনাভ দাশগুপ্তের চিত্রনাট্য টানটান ও গতিময় হওয়ার কারণে রহস্য-ছবির গুণমানে কোনও খামতি থাকেনি। একই সঙ্গে উল্লেখ্য সম্পাদক রবিরঞ্জন মৈত্রের নামও। এ-ধরনের ছবিতে প্রতিটি ফ্রেম গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গত করেছে আবহও। এ ছবির আবহ সংগীতের দায়িত্বে ছিলেন শুভদীপ গুহ।
ছবির সিনেমাটোগ্রাফি মন-কাড়া। রম্যদীপ সাহার ক্যমেরার গুণেই সোনার কেল্লা, জয়সলমির– যোধপুরের রাস্তাঘাট, গাদিসার লেক কিংবা মরুভূমি অনবদ্য হয়ে ওঠে। ড্রোনের ব্যবহার দুর্দান্ত। সুহোত্র মুখোপাধ্যায় (বাপিবাবু) এবং সোমক ঘোষ (প্রমথ) নিজ নিজ চরিত্রে যথাযথ। বাকি চরিত্রে সন্দীপ্তা সেন, রজতাভ দত্ত, সুদীপ মুখোপাধ্যায় এবং রাজেশ শর্মা প্রত্যেকে সমৃদ্ধ। আর যা উল্লেখ না করলেই নয় তা হল ছবির টাইটেল ট্র্যাক। অম্লান চক্রবর্তীর সুরে সিদ্ধার্থ রায় তথা সিধুর গাওয়া গানের সুর মাথার মধ্যে গুনগুন করতে বাধ্য।

Latest article