তৃণমূল ছাত্র পরিষদের (TMCP Foundation Day) প্রতিষ্ঠা দিবসের মঞ্চে হাজার হাজার ছাত্র যুব-র মাঝে এই অনন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখল গোটা বাংলা। যোগমায়াদেবী কলেজের এক দাপুটে ছাত্রনেত্রী থেকে তিনি আজ দেশনেত্রী। এই ছাত্র রাজনীতিই তাঁকে শিখিয়েছে লড়াইয়ের সংজ্ঞা। তাই কি ছাত্র রাজনীতির মঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে খানিক স্মৃতি মেদুর আমাদের প্রিয় মুখ্যমন্ত্রী? ফিরে গেলেন তাঁর কিশোরীবেলায়। যেখানে কলেজ গেটে স্লোগান থেকে তৎকালীন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিএমের বিরুদ্ধে চোখে চোখ রেখে লড়াইয়ের দিনগুলোর কথা তিনি মনে করিয়ে দিলেন আজকের ছাত্রছাত্রীদের। কীভাবে বামফ্রন্ট তথা সিপিএম আমলে হলদিয়া থেকে চমকাইতলা অথবা কলকাতার রাজপথে তাঁর ওপর আক্রমণ নেমে এসেছিল। ক্ষতবিক্ষত শরীরেও তিনি সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে যাননি সেকথা তো বঙ্গ তথা দেশের রাজনীতির সকলেরই জানা। ছাত্রযুবদের মধ্যে সেই লড়াইয়ের তেজই যেন ছড়িয়ে দিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সিপিএমকে হারিয়েই যে তিনি ক্ষান্ত হননি বরং আগামিদিনে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে দেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষার স্বার্থে তিনি যে আরও একবার লড়াইয়ের রণাঙ্গনে নেমেছেন এবং বিজেপিকে এক ইঞ্চিও জমি ছেড়ে দিতে নারাজ সে-কথা বুঝিয়ে দিলেন দলনেত্রী। তাৎপর্যপূর্ণভাবে এদিন রাজনৈতিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, সারাদেশে ‘জয় ইন্ডিয়া’। কিন্তু বাংলায় ‘জয় বাংলা’। অর্থাৎ, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে যে বাংলার ৪২টি আসনেই তৃণমূলই নির্ধারক শক্তি তা তিনি কোনওরকম রাখঢাক না রেখেই বুঝিয়ে দিয়েছেন। একই সঙ্গে যে তিনি বাংলায় সিপিএমের রক্তাক্ত অতীত মনে করিয়ে দিয়েছেন, বুঝিয়ে দিলেন সিপিএমের সঙ্গে আগামীদিনেও কোনও সমঝোতার প্রশ্নই নেই। বস্তুত সিপিএমের এক অংশ যে বিজেপির কাছে বিকিয়ে গেছে তা-ও তুলে ধরেছেন তাঁর বক্তৃতায়। আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মানেই স্ফুলিঙ্গ। আর সেই স্ফুলিঙ্গকে তিনি ছড়িয়ে দিলেন ছাত্র যুবর মঞ্চেই। তাই শিক্ষাঙ্গনে দাঁড়িয়ে, ‘গোলি মারো…’ স্লোগান যে তিনি বরদাস্ত করবেন না, এটা যে বাংলার সংস্কৃতি না তা স্পষ্টত বুঝিয়ে দিলেন দলনেত্রী। একই সঙ্গে শিক্ষাক্ষেত্রকে বিজেপি-আরএসএস গৈরিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে যেখানে পাঠক্রম থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হচ্ছে মোগল ইতিহাস, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বা মহম্মদ ইকবালের কবিতা। কেন্দ্রীয় সরকারের নিযুক্ত রাজ্যপাল তাঁর ইচ্ছেমতো শিক্ষাঙ্গন গৈরিকীকরণ করছেন ইউজিসি’র নির্দেশাবলিকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে! কখনও বিজেপির শাখা সংগঠনের কোনও নেতা বা কখনও প্রাক্তন আইপিএস অফিসারকে যিনি জীবনে কখনও অধ্যাপনাই করেননি, এহেন ব্যক্তিদের উপাচার্যের পদে বসিয়ে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটিকেই একটি ‘রসিকতা’য় পরিণত করা হচ্ছে রোজ। প্রশাসনিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানেই রাজ্যপালকে তাঁর এক্তিয়ার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন! মনে করিয়ে দিয়েছেন, রাজ্যপাল পদটি একটি মনোনীত পদ! কিন্তু মানুষের রায়ে নির্বাচিত একটি সরকারকে এড়িয়ে নিজের মর্জিমতো কাজ করার কোনও ক্ষমতা সংবিধান রাজ্যপালকে দেয়নি। ‘মনোনীত’ এবং ‘নির্বাচিত’র মধ্যের ফারাকটা মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রশাসনিক মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং ছাত্র যুবর ভবিষ্যৎ নির্মাণই যে তাঁর সরকারের প্রধান লক্ষ্য তা এদিনের বক্তৃতায় তথ্য ও পরিসংখ্যান দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কন্যাশ্রী থেকে ঐক্যশ্রী, দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের জন্য ‘তরুণের স্বপ্ন’ প্রকল্পে স্মার্ট ফোন প্রদান থেকে রাজ্যে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দেশের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় স্তরে নিয়ে যাচ্ছে তা শিক্ষাবিদরাও স্বীকার করেন। সাথে সাথে জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ‘স্পোকেন ইংলিশ’ এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের আরও বেশি করে দক্ষ তৈরি করা, রাজ্য থেকে আইএএস, আইপিএস তৈরির জন্য সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সিভিল সার্ভিস স্টাডি সেন্টার নির্মাণ, যেখান থেকে ইউপিএসসি পরীক্ষায় আজ সফল হচ্ছে বাংলার ছেলেমেয়েরা। এসবই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘপ্রসারী চিন্তার ফসল। নরেন্দ্র মোদির সময়কালে যেখানে গোটা দেশে বেকারত্বের হার ৪০% বেড়েছে, সেখানে বাংলায় কর্মসংস্থান ৪৫% বৃদ্ধি পেয়েছে৷ একের পর এক শিল্পতালুক। দেউচা-পাঁচামিতে এক লক্ষ প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান, বানতলা চর্মশিল্পে ২ লক্ষ কর্মসংস্থান, ৯০ লক্ষ এমএসএমই, ৩টি নতুন ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল করিডর নির্মাণের মধ্য দিয়ে বাংলায় কর্মসংস্থানের নবজোয়ার আনতে যে তিনি বদ্ধপরিকর একথা বারবার তাঁর কথায় উঠে এসেছে। যে বক্তব্য শুনে হাসি ফুটে উঠেছে সদ্য কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাত্তকোত্তর শেষ করা শুভজিৎ বা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাইক্রো বাইলজির স্নাতকোত্তরের পড়ুয়া রুবিয়াদের মুখে। একরাশ স্বপ্ন নিয়ে নেত্রীর বক্তব্য শুনতে ছুটে এসেছিল কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহারের হাজার হাজার পড়ুয়া। নেত্রীর বক্তব্যে আগামী দিনের রাজনীতির রূপরেখার সাথে সাথে নিজেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্নও দেখতে পেল ওরা। পড়াশোনা করে এই বাংলায় থেকেই যে নিজেদের পরিবারের পাশে থাকতে পারবে এই আনন্দে কলকাতার রাজপথে রোদের মধ্যে তিন ঘন্টা সভা শোনার পরেও চোখ-মুখ উজ্বল লাগছিল শুভজিৎ, রুবিয়াদের। এখানেই যে তিনি, অনন্যা। বাংলার ছাত্র যুব’র মনের কথা সব চাইতে ভাল তিনিই বোঝেন। আর বোঝেন বলেই তাদের শুধু স্বপ্ন দেখিয়ে স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে কাজ সারেন না। সেই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন! ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য, আনেন ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড। তিনি জানেন একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসে পরিবারের পাশে থেকে রাজনীতি করে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য কতটা লড়াই করতে হয়। আর জানেন বলেই হয়তো তৃণমূল ছাত্র পরিষদের মঞ্চে দাঁড়িয়েই তিনি ছাত্রছাত্রীদের আগামীর ভবিষ্যৎ গড়ার কান্ডারির ভূমিকা পালন করেন৷ একদিন তিনিও তো এই ভিড়টারই অংশ ছিলেন। যোগমায়া দেবী কলেজের ইউনিট প্রেসিডেন্ট থেকে বাংলার তিন বারের মুখ্যমন্ত্রী। ভবিষ্যতের দেশনায়িকা। যাত্রাটা সহজ ছিল না। অনেক রক্ত-ঘাম অনেক বিদ্রুপ-ব্যঙ্গ- বাঁকা হাসি পেরিয়ে তবে এই জায়গাটা অর্জন করতে হয়। বেশিরভাগই এই যাত্রাপথে হারিয়ে যান আর কয়েকশো কোটিতে একজন সফল হন, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
আরও পড়ুন- গঙ্গাভাঙন ঠেকানোই হবে আমার প্রধান কাজ