গড় বা দুর্গের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে রাজকীয় অহঙ্কার। আর সেই দুর্গের মধ্যে দিয়ে খানিকটা পথ হাঁটলে মনে হয় একেক পদরেখায় অতিক্রম করে যাচ্ছে ইতিহাসের একেকটি পাতা। বিন্ধ্য পাহাড়ের চুনার দুর্গে পথ চলতে চলতে মনে প্রথম ভাবনা আসে এক-দুশো নয় দু হাজার বছরের ইতিহাসের এই পথচলা। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের বড় ভাই রাজা ভর্তৃহরির কথা। রাজ্যপাট ত্যাগ করে সন্ন্যাস নিয়ে খুঁজে পান মুক্তির দিশা। চুনার দুর্গের অভ্যন্তরে তাঁর সমাধি মন্দির, পুজো পেয়ে চলেন আজও, ভোগের চেয়ে বড় ত্যাগের পথে চলে। সময়ের সঙ্গে শক্ত হয় প্রামাণ্য ইতিহাসের প্রবাহ। আসে পৃথ্বীরাজ চৌহানের নাম। আসে হুমায়ুনের নাম। তবে চুনার দুর্গের সঙ্গে যে দুর্গেশের নাম সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে তিনি হলেন শের শাহ। তাঁর আমলে চুনারের গরিমা সবচেয়ে বেশি হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে মুঘল পেয়েছে অধিকার। ইংরেজ দখল করেছে, লুঠ করেছে, ঘাঁটি তৈরি করেছে।
দুর্গের মূল প্রবেশপথ বন্ধ, ঘুরে ঢুকতে হয়। দুর্গের রাজকীয় দরবার থেকেই উন্মুক্ত হয় গঙ্গার প্রবাহদৃশ্য। অদূরেই গঙ্গা বাঁক নিয়ে উত্তরবাহিনী হয়েছে কাশীর দিকে। চুনার দুর্গের উপর থেকে গঙ্গার দৃশ্য— চোখ ফেরানো কঠিন।
প্রাচীন ভঙ্গিল পর্বত বিন্ধ্য, হিমালয়ের চেয়েও প্রাচীন। অগস্ত্যের দাক্ষিণাত্য বিজয়ের গৌরব লেখা আছে বিন্ধ্যের নতমস্তকে। বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির, বিস্তীর্ণ প্রবাহে গঙ্গা এবং আরও খানিক দেবমন্দির দর্শন সর্বোপরি পর্যটকভারে ক্লিষ্ট নয় এমন একটি জায়গা বিন্ধ্যাচল। আধুনিক জীবনযাপনের বিলাসিতা, সাধারণ পর্যটকের সাধারণ রাতযাপন কিংবা পুণ্যার্থীর ধর্মশালা— সবই অনায়াসে পাওয়া যাবে খুঁজলেই। সোহাগভরে গঙ্গা এখানে বয় তার পুণ্যের ঝাঁপি সঙ্গে নিয়েই। সেখানে স্নান সেরে বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরে যাবেন পুণ্যার্থী। উঁচু এক টিলাপথ বেয়ে দর্শনার্থী যাবেন সতীপীঠ দেখতে। বাম পায়ের বুড়ো আঙুল পড়েছে এইস্থানে বলে কথিত। ডালা, মালা-শোভিত রাস্তার দু-ধারের দোকানগুলি পেরিয়ে একটু করে চড়াই ভেঙে পৌঁছতে হবে মায়ের কাছে। বিন্ধ্যাচলে বিন্ধ্যবাসিনী ছাড়াও আছেন ভয়ঙ্কর কালীখো মন্দির। এছাড়াও আছেন অষ্টভুজা দুর্গা, বসে বসে নামা পাতালকালী। পাশেই অষ্টভুজা দুর্গা।
চুনার বিন্ধ্যাচল ঘুরে ইতিহাস-ভূগোল পড়েই তো আর বাড়ি চলে যাওয়া যায় না, সঙ্গে একটু পুণ্যকর্ম না-করলে ঠাকুর পাপ দেন! তাই ঘণ্টা দেড়েক ট্রেন জার্নি করে বারাণসী আসতেই হয়। বারাণসী এলে গঙ্গাস্নান করে বিশ্বনাথ মন্দিরে পুজো দিতে হয়। সঙ্গে মা অন্নপূর্ণা দর্শন। টোটো বা অটো ভাড়া করে দুর্গাবাড়ি, কালভৈরব, সংকটমোচন, তুলসী মানস মন্দির ঘুরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে সামনের জন্মের জন্য আগাম মানত করে আসতে হয়। বিকেলে নৌকা করে ঘাট ঘুরে, নৌকা থেকেই সন্ধ্যা সাড়ে ছ’টা থেকে দুরন্ত গঙ্গা আরতি দেখতেই হবে, সে যতবারই বারাণসী (Varanasi) যাওয়া হোক না কেন!
আরও পড়ুন- আকবরকে ফিরে পড়া দরকার
কাশী গেলে ব্যাসকাশী যেতে হয়, শাস্ত্রকথা অমান্য করার নয়। রামনগর বা ব্যাসকাশী রাজার বাড়ি, বিশাল মিউজিয়াম। দেশীয় রাজাদের বিত্ত সম্পর্কে কিছুটা ধারণা নিশ্চয় হবে। ধারণা হবে সে-যুগের বিলাসিতা সম্পর্কেও। সন্ধ্যায় যেতে হবে মোদিনির্মিত মন্দিরের দারুণ সাজানো নতুন করিডর অংশে। সবই যখন হল তখন মাত্র আধঘণ্টার পথ সারনাথ বাদ দেওয়া উচিত হবে না। ধামেক স্তূপ, মৃগদাব, বুদ্ধের প্রথম ধর্মপ্রচার-স্থান, মিউজিয়াম— সবই সুন্দর করে সাজানো। সিংহল থেকে আনা বোধিবৃক্ষের অংশ থেকে নতুন গাছ দিয়ে সেজেছে মূলগন্ধকুঠি বিহার। ভারতের জাতীয় প্রতীক সে অশোকচক্রের আসল রূপটাই এখানে পাওয়া তাই মিউজিয়ামে রাখা আছে।
বারাণসী এমন একটা জায়গা যেখানে সারা ভারত মেশে একসাথে। মণিকর্ণিকা সতীপীঠ, দেবীর কুণ্ডল পড়েছিল। মণিকর্ণিকা মহাশ্মশানে চিতা চির-বহ্নিমান, মণিকর্ণিকা তাম্বের মতোই অনন্ত আগুনের ফুলকি।