শিল্পীকর্মা

স্বর্গলোকের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি ও ভাস্কর ছিলেন বিশ্বকর্মা। বেদে, পুরাণে তাঁর জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে রয়েছে নানা মতভেদ। সেই জন্মকাহিনি, তাঁর স্থাপত্যের নানা অনিন্দ্যসুন্দর দিক, বিশ্বকর্মা পুজোর ঐতিহ্যের, লোকপ্রিয়তার কথা লিখছেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

‘দেবশিল্পী মহাভাগ দেবানাং কার্যসাধক
বিশ্বকর্ম্মণ্য নমস্তুভ্যং সর্ব্বাভীষ্টং প্রদায়ক’।
বেদে বিশ্বকর্মাকে (Vishwakarma Puja) পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। তিনি স্বর্গলোকের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থপতি ও ভাস্কর। তিনি অলংকার শিল্পের স্রষ্টা, শিল্পসমূহের প্রকাশক। দেবতাদের গমনাগমনের জন্য উড়ন্ত রথ তৈরি করেছিলেন তিনি। অর্থাৎ শিল্পবিদ্যায় দেবলোকের কারিগরের পারদর্শিতার জুড়ি মেলা ভার।

জন্মবৃন্তান্তে বিশ্বকর্মা
বিশ্বকর্মার জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে বেদে এবং পুরাণে নানা কাহিনি রয়েছে। ক্ষীরসমুদ্রে একবার নারায়ণ বিশ্রাম করছিলেন। একদিন লক্ষ্মী সেই সময় জানতে চাইলেন এই বিশ্বসৃষ্টির অনন্ত রহস্য। বিষ্ণু জানালেন এই সবই আমার অনন্ত রূপের কণা কণা অংশ মাত্র। আমি চেয়েছিলাম প্রাণিকুল রচনা করতে। যারা আমার সেবা ও পুজো করবে। সেজন্য আমি ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করি। ব্রহ্মার নাভিদেশ থেকে জন্ম হয় বিশ্বকর্মার।
মৎস্য পুরাণ অনুসারে, বিশ্বকর্মা অষ্টবসুর অন্যতম ঋষি প্রভাসের ঔরসে বৃহস্পতির কন্যা বরশ্রীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। বরশ্রীর আরেক নাম যোগসিদ্ধা। আবার ভিন্ন মতানুসারে, বিশ্বকর্মার মা হলেন দেবগুরু বৃহস্পতির বোন বরবর্ণিনী।

দেবস্থপতির নানা রূপ
বেদ ও পুরাণ অনুযায়ী বিশ্বকর্মার ভিন্ন ভিন্ন রূপ। তিনি ব্রহ্মাস্বরূপ। তাঁর পাঁচটি মুখ। এই পাঁচটি মুখের চারটি চারিদিকে এবং একটি ওপরদিকে। যেমন সদ্যোজাত, বামদেব, অঘোর, তৎপুরুষ এবং ঈশান। তাঁর দশটি হাত এবং বাহন হাঁস। তাহলে দেখা গেল একদিকে তিনি বিশ্বতোমুখ এবং জ্ঞানস্বরূপ। বাহন হাঁস সেই জ্ঞানকেই প্রকাশ করছে। এখানে ব্রহ্মা বিশ্বকর্মা এক হয়ে যান। সৃষ্টির দেবতা হিসেবে নানা নামে পরিচিত তিনি। কখনও প্রজাপতি কখনও তক্ষক, কাক বা দেববর্ধকি নামেও পরিচিত তিনি। একবার তো ভয়ানক বৃত্রাসুর ও তার দলবলের আক্রমণে পরাজিত দেবরাজ ইন্দ্র স্বর্গচ্যুত হলেন। স্বর্গ দখল করে এর থেকে মুক্তির উপায়ের জন্য বিষ্ণু বললেন ধ্যানরত মহামুনি দধীচি যদি তাঁর অস্থি দান করেন, সেই অস্থি দিয়ে তৈরি অস্ত্রেই অসুরদের বিনাশ হবে।
তৎক্ষণাৎ ইন্দ্র গিয়ে দধীচিকে সেকথা জানাতেই তিনি যোগবলে দেহত্যাগ করলেন। সেই দেহ থেকে অস্থি এনে ইন্দ্র বিশ্বকর্মাকে দিলেন। বিশ্বকর্মা তৈরি করলেন দুটি বজ্র। শোভন কর্মা এবং অপরটির নাম সুপ্রেরণীয়। এই দুটি বজ্র দিয়ে ইন্দ্র বৃত্তাসুর এবং অন্যান্য অসুরদের বধ করে স্বর্গে শান্তি ফেরালেন।
আমরা যে বিশ্বকর্মার পুজো করি তাঁর কিন্তু আবার অন্যরূপ। তাঁর রূপ অনেকটা কার্তিকের মতো। তাঁর একটি মুখ, চারটি হাত, হাতি তাঁর বাহন। বর্তমানে হস্তশিল্পীরা বিশ্বকর্মার এই রূপের পুজো করেন। তাঁর হাতে ছেনি, হাতুড়ি আবার কখনও মানদণ্ড। এগুলো যেমন নির্মাণের প্রতীক তেমন শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে পরিমাপের হিসাবকে নির্দেশ করে।

বাস্তুশাস্ত্রমের রূপকার
রামায়ণে বলা হয়েছে অপূর্ব শোভা ও সম্পদবিশিষ্ট লঙ্কা নগরীর নির্মাতা বিশ্বকর্মা। তিনি স্থাপত্যবেদ উপবেদ ও চতুঃষষ্টি কলার প্রকাশক। মর্ত্যলোকের মানুষের জন্য ‘বাস্তুশাস্ত্রম’ রচনা করেছিলেন তিনি। বেদ যেমন চারটি। উপবেদও সেইরকম চারটি। আয়ুর্বেদ, ধনুর্বেদ, গান্ধর্ববেদ এবং স্থাপত্যবেদ। এই স্থাপত্যবেদ বা বাস্তুশাস্ত্রের স্রষ্টা বিশ্বকর্মা। দেবশিল্পীরূপে তিনি দেবপুরী, দেবাস্ত্র ইত্যাদিরও নির্মাতা। শিল্পকর্মে নিযুক্ত দারুশিল্প, স্থাপত্যশিল্প, মৃৎশিল্প কর্মকার প্রভৃতি মানুষেরা নিজেদের কর্মে দক্ষতা অর্জনের জন্য বিশ্বকর্মা পুজো করে থাকেন।
দেবশিল্পী হিসেবে বিশ্বকর্মাকে নিয়ে রয়েছে সুন্দর একটি পৌরাণিক কাহিনি।
ইন্দ্রের ইচ্ছে হয়েছিল একবার তিনি এমন এক সুরম্য প্রাসাদ নির্মাণ করবেন যা হবে সর্বশ্রেষ্ঠ। যা কখনও হয়নি এবং পরেও হবে না।
দেবশিল্পী বিশ্বকর্মাকে (Vishwakarma Puja) ডেকে সেইরকম এক অপরূপ প্রাসাদ তৈরির তিনি অনুরোধ করলেন।
বিশ্বকর্মা এক-একটি প্রাসাদ নির্মাণ করেন কিন্তু তা ইন্দ্রের পছন্দ হয় না। এরপর বারবার তিনি প্রাসাদ নির্মাণ করান, আবার ভেঙে ফেলেন। বিশ্বকর্মা বুঝতে পারলেন ইন্দ্রকে সন্তুষ্ট করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তখন তিনি ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা সব কথা শুনে তাঁকে বিষ্ণুর কাছে যেতে বললেন। বিষ্ণুর কাছে পৌঁছে বিশ্বকর্মা সব কথা খুলে বললেন।
এরপর বিষ্ণু এক বালকের রূপ ধরে ইন্দ্রের কাছে গেলেন। বিষ্ণুকে ইন্দ্র কিন্তু চিনতে পারলেন না। তিনি বালককে বললেন, ‘এখানে কেন এসেছ?’ বালকরূপী বিষ্ণুকে বললেন, ‘আপনাকে ও আপনার প্রাসাদ দেখতে এসেছি’ ইন্দ্র বললেন, ‘আমি ইন্দ্র। তুমি চেনো আমাকে?’
বিষ্ণু বললেন, ‘হ্যাঁ, আপনি ইন্দ্র। সেটা আমি জানি। আমি অনেক ইন্দ্রকে জানি, আপনার আগে অনেক ইন্দ্র ছিলেন তাঁদের অনেক সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ ছিল। আপনার পরেও অনেক ইন্দ্র আসবেন তাঁদেরও অনেক সুন্দর সুন্দর প্রসাদ হবে। সুতরাং এই জগতে অগণিত ইন্দ্রের সমাহার। শত শত ঐশ্বর্যমণ্ডিত অপরূপ সুন্দর প্রাসাদ, তাদের কোন প্রাসাদটা বেশি সুন্দর তার তুলনা কী করে সম্ভব!’
বালকবেশী বিষ্ণুর কথা শুনে ইন্দ্র বুঝলেন তিনি এক আত্মসর্বস্ব মোহতে ডুবে আছেন।
বিষ্ণু তাঁকে বোঝালেন— বিশ্বকর্মা (Vishwakarma Puja) যে প্রাসাদই তৈরি করেন তার সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। আরও একটা কথা আপনি জেনে রাখুন যে, এই ব্রহ্মাণ্ডে সবই অনিত্য। যা আজ আপনার, কাল তা আপনার নয়। শত শত ইন্দ্রের মধ্যে আপনি একটি কণামাত্র। গলায় বিনয়ের সুর আর হাতজোড় করে ইন্দ্র তখন বললেন, ‘আমি সবই বুঝেছি ভগবান, আমি আর অহংকার করব না।’ বিশ্বকর্মা তাঁর জন্য একটা অপরূপ সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রাসাদ নির্মাণ করে দেন।
বিশ্বকর্মাকে বলা হয়, ‘দেবানাং কার্যসাধক।’ এখানে কার্য অর্থাৎ শিল্পকর্মকে বা সৃষ্টিকে বোঝানো হয়েছে। তাই তিনি শিল্পের দেবতা।
তিনি কর্মেরও দেবতা।

আরও পড়ুন- বেনজির আন্তরিকতা মুখ্যমন্ত্রীর, ফের অন্যায় জেদেই বৈঠকে বসল না পড়ুয়ারা

ঐতিহ্যের ভগবান
বিশ্বকর্মা ছাড়া দেবতাদের বিলাসের কথা ভাবাই যায় না। তাঁর অমর শিল্পকর্মের মধ্যে সত্যযুগের স্বর্গলোক, ত্রেতাযুগের রাবণের স্বর্ণলঙ্কা, কলিযুগের হস্তিনাপুর ও ইন্দ্রপ্রস্থ। দেবাদিদেব মহাদেব ঘুরে বেড়ান যত্রতত্র। বেশিরভাগ সময়ই শ্মশানে পড়ে থাকেন তিনি। পার্বতীর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার পর তিনি বিশ্বকর্মাকে নির্দেশ দেন স্বর্ণপ্রাসাদ নির্মাণের।
সেই প্রাসাদের গৃহপ্রবেশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন শিবভক্ত লঙ্কেশ্বর রাবণ। দশানন সেই প্রাসাদ দেখে বিমোহিত। তিনি শিবকে বললেন, আমিও এমন একটি প্রাসাদ তৈরি করতে চাই। শিব তখন বিশ্বকর্মাকে অনুরোধ করায় বিশ্বকর্মা রাবণের জন্য স্বর্ণপুরী নির্মাণ করেন। কৃষ্ণ যখন জরাসন্ধের থেকে দূরে থাকার বাসনা নিয়ে মথুরা ছেড়ে দ্বারকা চলে আসবেন বলে মনস্থ করেন তখন তাঁর জন্য বিশ্বকর্মা সেখানে এক সুরম্য প্রাসাদ তৈরি করে দেন। কৃষ্ণের জন্য তিনি বিপুল ওষুধের ভাণ্ডার তৈরি করে দেন। দ্বারকাপুরী হল এক অপরূপ প্রাসাদ। ক্রমে দ্বারাবতী বা দ্বারকা হয়ে উঠল স্বর্গতুল্য। এবার আসি ইন্দ্রপ্রস্থের কথায়। খাণ্ডবপ্রস্থে ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডবদের এক টুকরো জমি দিয়েছিলেন। সেখানে কৃষ্ণের অনুরাধে বিশ্বকর্মা ইন্দ্রপ্রস্থ নির্মাণ করেন। ইন্দ্রপ্রস্থ ছিল এক মায়ানগরী। দেখে মনে হত সর্বত্র স্বচ্ছ জল। ভূমি এবং জলাশয়— পার্থক্য বোঝাই যেত না। পাণ্ডবদের নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে সেই মায়ানাগরীতে এসে অভিভূত কৌরবরা। ভূমি এবং জলাশয় পার্থক্য করতে না পেরে জলাশয়ে পড়ে যান দুর্যোধন। সেই দেখে হেসে উঠেছিলেন দ্রৌপদী। বলা হয় সেই রোষ এবং অপমান মনের ভেতর পুষে রেখেছিলেন দুর্যোধন। যা কিনা পরবর্তী সময়ে দ্রৌপদীকে অপমান করতে উৎসাহ জুগিয়েছিল। সেটাই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সৌন্দর্যমণ্ডিত অপরূপ সব প্রাসাদ নির্মাণের পাশাপাশি অস্ত্র ভাবনার প্রকাশও আমরা পাই বিশ্বকর্মার মধ্যে।

দেবনাং কার্যসাধক
অসুরদের দুই ভাই সুন্দ এবং উপসুন্দের অত্যাচারে দেবতারা কাতর হয়ে যখন দিশেহারা হয়ে উঠেছিলেন তখন তাঁরা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হয়েছিলেন। অনেক ভেবেচিন্তে দেখে তিনি স্থির করেছিলেন বিশ্বকর্মা ছাড়া এই সঙ্কট থেকে দেবতাদের কেউ উদ্ধার করতে পারবেন না। তাই তিনি বিশ্বকর্মার কাছে গিয়ে বললেন, আপনি এমন এক শক্তির প্রকাশ ঘটান যা কিনা দুষ্ট অসুর দ্বয়কে বধ করে দেবলোককে রক্ষা করতে পারবে। বিশ্বকর্মাও চিন্তা করে দেখলেন একক শক্তি দিয়ে এই অসুর ভ্রাতৃদ্বয়কে বধ করা যাবে না।
ব্রহ্মাণ্ডের সর্ববস্তুর অন্তস্থ কণার শক্তি ও সৌন্দর্য সংগ্রহ করে তা দিয়ে তিলে তিলে গড়ে তুললেন এক নারী শক্তি। তিনিই তিলোত্তমা।
বিশ্বকর্মার (Vishwakarma Puja) কন্যা সংজ্ঞা বিয়ে করেন সূর্যদেবকে। কিন্তু সূর্যের তাপ তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছিলেন না। একথা জানতে পেরে বিশ্বকর্মা সূর্যের মোট তাপকে সমান আটটি ভাগে ভাগ করেন। তার মধ্যে থেকে একটি দান করেন সূর্যকে। বাকিগুলির তেজ থেকে তিনি বিভিন্ন অস্ত্র নির্মাণ করেন। বিষ্ণুর চক্র, মহাদেবের ত্রিশূল, কার্তিকের তির-ধনুক এবং অন্যান্য দেবতার নানা অস্ত্র। এছাড়া তিনি দুটি মহাধনুও নির্মাণ করেন। তার একটি তিনি দেন শিবকে এবং আরেকটি দেন বিষ্ণুকে। শিবকে তিনি যে ধনুটি দিয়েছিলেন সেটি হরধনু নামে খ্যাত। সেই হরধনু ভঙ্গ করে রামচন্দ্র সীতাকে বিয়ে করেছিলেন। আর বিষ্ণু সেই ধনুটি পরশুরামকে দিয়েছিলেন। সেটি এবং তার কুঠার দিয়ে পরশুরাম এ-বিশ্বকে একুশবার নিঃক্ষত্রিয় করেন। যদিও সেই ধনু দিয়েই বিষ্ণু পরশুরামের গর্ব সংহার করেন।
মহামায়া যখন অসুরবধের জন্য যাত্রা করছিলেন, তখন সব দেবতা তাঁদের আয়ুষ দিয়ে দেবীকে সজ্জিত করেছিলেন। তখন বিশ্বকর্মা দেবীকে দিয়েছিলেন তাঁর কুঠার এবং মহাশক্তিশালী কবচ।
কুবেরকে ব্রহ্মা যে পুষ্পক রথ প্রদান করেছিলেন সেটি নির্মাণ করেন বিশ্বকর্মা। আবার তিনি এক বিমানও নির্মাণ করেছিলেন। এই বিদ্যা যাতে মানবলোক, দানবলোকেও প্রসার ঘটে তাই তিনি শিল্পী ও স্রষ্টা তৈরি করেছিলেন। কীভাবে? আসুন জেনে নেওয়া যাক।

শিল্পী ও স্রষ্টার প্রসার
বায়ু এবং পদ্মপুরাণ থেকে জানা যায়, দানব শিল্পী ময় বিশ্বকর্মার (Vishwakarma Puja) পুত্র। দৈত্যরাজ প্রহ্লাদের কন্যা বিরোচনা ছিলেন ময়ের মা। আবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ থেকে জানা যায় যে দেবনর্তকী ঘৃতাচীর অভিশাপে বিশ্বকর্মা এক ব্রাহ্মণঘরে জন্মগ্রহণ করেন। আবার বিশ্বকর্মার অভিশাপে ঘৃতাচী এক গোপকন্যা হিসেবে প্রয়াগে জন্মগ্রহণ করেন। দু’জনের শুভপরিণয় সম্পন্ন হওয়ার পর তাঁদের ন’টি সন্তানের জন্ম হয়। সেই সন্তানদের বিশ্বকর্মা নানা শিল্পবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলেন। কারণ, তাহলে মর্ত্যের মানুষ ও শিল্পসৃষ্টির ক্ষেত্রে দক্ষ হয়ে উঠবে। মৃৎশিল্প, লৌহশিল্প, পুষ্পশিল্প, অলংকার শিল্প, শঙ্খশিল্প, বয়নশিল্প, অঙ্কনশিল্প, কংসশিল্প এবং দারুশিল্প— এই ন’টি শিল্পে তিনি ন’জন পুত্রকে শিক্ষা দেন।

‘দেবী পুজোর আগে কেন হয় দেব স্থপতির পুজো’

দুর্গাপুজোর সঙ্গে বিশ্বকর্মা পুজোর একটা যোগ রয়েছে। ভাদ্রের সংক্রান্তি বিশ্বকর্মা পুজোর নির্দিষ্ট তিথি। আর আশ্বিনে দেবী মায়ের আগমন। বৃহদেবতা গ্রন্থ অনুসারে, বিশ্বকর্মা হলেন বর্ষাকালীন সূর্য। বসুমতী হয় শুষ্ক রুক্ষ। শস্যশ্যামলা হয় বর্ষায়। যিনি বিশ্বের কর্ম বা কৃষিকর্ম সৃষ্টি করেন, সূচনা করেন তিনিই বিশ্বকর্মা। বসুমতী শস্যশ্যামলা না হলে মহামায়া মহাশক্তির আবির্ভাব হবে কী করে? বিশ্বকর্মা আসেন ধরিত্রীকে সজ্জিত করতে। তারপরই দেবী উপস্থিত হন। কোথায় যেন দেবস্থপতির বাদ্যির সুরে মিলেমিশে যায় আগমনীর সুর।

ঘুড়ির উৎসব
বিশ্বকর্মা পুজো একটি জনপ্রিয় উৎসব। কারিগর শিল্পী এবং নির্মাণ শ্রমিকরা এই পুজো উদযাপন করে তাদের দেবতার কাছে শ্রদ্ধা জানান এবং সফলতা কামনা করেন। বলা হয় বিশ্বকর্মা (Vishwakarma Puja) দেবতাদের জন্য উড়ন্ত রথ তৈরি করেছিলেন তা স্মরণ করতেই এই পুজোর দিনে ঘুড়ি ওড়ানোর প্রচলন শুরু হয়। এতে আছে রাজামলে বর্ধমান রাজবাড়িতে ঘুড়ি ওড়ানোর চল ছিল। রাজা মহাতাপ চাঁদ নাকি নিজেই ঘুড়ি ওড়াতেন। বর্ধমানের রাজারা এসেছিলেন পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে, সেখানে ঘুড়ি উৎসব বেশ জনপ্রিয়। বর্ধমানের রাজাদের হাত ধরেই ঘরে উৎসবের চল শুরু বলে মনে করা হয়। একটা সময় পর্যন্ত ছিল বিশ্বকর্মা পুজো মানেই সকাল থেকেই আকাশ-বাতাস ভোকাট্টা আওয়াজে মুখরিত। ছেলে-বুড়ো সবাই মেতে উঠত ঘুড়ি ওড়ানোর উৎসবে। আগের রাত থেকে শুরু হত ঘুড়িতে মাঞ্জা দেওয়া। ঘুড়ি ওড়ানোর প্রস্তুতি থাকত তুঙ্গে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে আজকের উত্তর আধুনিক সময়ে এই বিশেষ দিনে আকাশে রংবেরঙের ঘুড়ির মেলা কমলেও কিছু মানুষের উৎসাহ-উদ্দীপনা আর নির্মল আনন্দ আজও অমলিন রয়ে গেছে।

Latest article