বিতস্তা ঘোষাল: এই বাড়িতে কিছুতেই থাকব না। আমার নিজস্ব কোনও ঘর নেই। সারাক্ষণ লোকজনের আনাগোনা। প্রাইভেসি বলে কিচ্ছু নেই। তুমি থাকো এই বাড়িতে, কী যে মায়া তোমার এই মান্ধাতা আমলের বাড়ির (ghar bari) প্রতি কে জানে! এত নেগেটিভ এনার্জি যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে কস্তুরী ফোন কেটে দিল। প্রতিদিনই নিয়ম করে একই রকম বক্তব্য কস্তুরীর। গান্ধর্বী কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায় না। প্রথম প্রথম বোঝাতে চেষ্টা করত— দেখো সোনা, যখন এই ফ্ল্যাটটা নিয়েছিলাম তখন আমাদের বড় কোনও কিছু কেনার সামর্থ্য ছিল না, তোমার বাবা সদ্য চাকরিতে ঢুকেছিল, আর আমিও তখন পড়াশোনা করছি। লোন নিয়েই করতে হয়েছিল।
মা, বস্তাপচা কথা বলা বন্ধ করো। পঁচিশ বছর আগে একটা গলির গলি তস্য গলিতে ফ্ল্যাট নিয়ে ওই যে ঢুকে পড়লে, তারপর এতগুলো দিন হয়ে গেল, একবারও পাল্টাবার কথা ভেবেছ? নাকি ভেবেছিলে চিরকাল তুমি আর বাবাই থাকবে? তা-ও বোধ হয় ভাবোনি। আম্মা, দাদু, কাকাই… প্রথম থেকেই ছিল। এতগুলো লোক, অথচ ঘর মাত্র দুটো।
দুটো কোথায়? চারটে বলো।
হ্যাঁ, নামেই চারটে। ড্রইংরুম, ডাইনিংরুম এগুলো কি ঘর? তা-ও আবার সেখানেও গুচ্ছের জিনিস ঠাসা।
যখন কিনেছিলাম তখন এত জিনিস ছিল না। সময়ের সঙ্গে প্রয়োজন অনুযায়ী জিনিস বেড়েছে। সেই সময় তুমি কোথায়! আকাশ থেকে উঁকি মেরে দেখছিলে কার কাছে আসবে। মেয়েকে থামাবার চেষ্টা করে গান্ধর্বী।
মা, কথা ঘুরিও না। ছোটবেলায় যেসব বন্ধুর বাড়ি যেতাম, তারাও বড় ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছে, প্রতিটা বন্ধুর আলাদা ঘর, আমার বাইশ বছর বয়স, এখনও আমি তোমাদের সঙ্গে শুতে বাধ্য হচ্ছি। বাড়িতে নেমপ্লেটে পর্যন্ত আমার নাম নেই!
আচ্ছা বেশ তোর কথাই না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু আমারও তো কোনও ঘর নেই। এই যে অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে ফিরি, ঘরে এসে বিছানায় গা এলাতে ইচ্ছে করে, পারি কি? তুই কাজ করিস, পড়িস, আমি কি তখন তোকে বলি, বাইরের ঘরে যা, আমি একটু বিশ্রাম নেব! সেই রাত বারোটায় ঘরে ঢুকি, আর সকালবেলায় তুই ওঠার কত আগে বেরিয়ে যাই। সারাদিন তুই একাই থাকিস। ঘরটা তোরই।
আমার কেন হবে? একটা বারোয়ারি ঘর। যে যখন পারছে ঘরে ঢুকে উঁকি দিচ্ছে, কার সঙ্গে কী কথা বলছি আড়ি পেতে শুনছে, এমনকী স্নান সেরে দরজা বন্ধ করে একটু আয়নার সামনে যে দাঁড়াব, তারও উপায় নেই। অমনি দরজায় ধাক্কা দিতে শুরু করবে সবাই। যেন আমি সুইসাইড করতে যাচ্ছি!
কস্তুরীর কথা বলা চলতেই থাকে, যতক্ষণ না গান্ধর্বী বলে, একটু না হয় ক’দিন মানিয়ে গুছিয়ে নে। তারপর তুই চাকরি পেয়ে মনের মতো বাড়ি করে নিবি।
তখনকার মতো নীরবতা নেমে আসে। গান্ধর্বী ফিরে যায় নিজের কাজে।
আরও পড়ুন- তোমায় খোঁজা শেষ হবে না মোর…
এই শুনছ! বাড়িটা এবার ছাড়ার নোটিশ এসেছে। দু’বছরের কনট্রাক্ট বাড়িওয়ালা আর রিনিউ করবেন না জানিয়েছেন। দু’মাসের মধ্যে বাড়ি খুঁজে নিতে হবে। সাগর চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বিছানায় বসে গান্ধর্বীর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলল।
দু’বছর হয়ে গেল? এখনও আট মাস হয়নি আমাদের বিয়ের।
কিন্তু বাড়িটা নেওয়া তার আগে। ভেবেছিলাম মাসিমা রিনিউ করবেন। কিন্তু তিনি বললেন, জামাই বদলি হয়ে আসছে, তাকে আপাতত এখানেই রাখবেন।
তা হলে অন্য বাড়ি দেখতেই হবে। তবে প্লিজ একটু ভাল জায়গায় বাড়ি দেখো। এখানে আমার কোনও প্রাইভেসি নেই। এই ঘর দিয়েই বাথরুম, রান্নাঘর, বারান্দা যেখানেই যাও না কেন যেতে হয়। এমনকী রাতেও দরজা খুলে রেখে শুতে হয়। এভাবে থাকা যায়? গান্ধর্বী ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা ছোট্ট বেতের মোড়াটায় বসে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলল।
বুঝতে পারছি তোমার একটু অসুবিধা হচ্ছে এখানে। আমাদের অবশ্য অসুবিধা হয় না। যৌথ পরিবারে এতগুলো বছর কাটিয়ে এলাম। কোনটা কার ঘর, দরজা বন্ধ করা দরকার, প্রাইভেসি— এগুলো নিয়ে কেউ মাথাই ঘামায়নি কখনও।
সাগরের কথা শুনে গান্ধর্বী ঠিক কী বলা উচিত এর উত্তরে বুঝতে না পেরে চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে উঠে গেল রান্নাঘরে। রুটি বেলা আর রান্নার প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে তার। শাশুড়ি-মা আটায় জল দিয়ে কী কী কুটনো কাটতে হবে বলে দিয়ে সন্ধ্যার মুখে স্থানীয় আশ্রমে যান। ফিরে এসে ছেলের পাশে বসে এক এক করে নির্দেশ দেন—বউমা আদা বেটে রেখেছ? জিরে ফোড়ন, তেজপাতা আর শুকনো লঙ্কা তেলে দিয়ে পটলগুলো ভেজে নাও। লাল হলে তুলে নিয়ে আলুগুলো ভেজে আমাকে বলো। হাত ভাল করে ধুয়ে আটাটা ততক্ষণ মাখতে থাকো। আমি একটু জিরিয়ে নিই। হাঁফিয়ে গেছি হেঁটে এসে।
শাশুড়ি-মা’র নির্দেশমতো কাজ করতে করতে গান্ধর্বী ছেড়ে আসা বাড়ির কথা ভাবে। তাদের তিনতলা বাড়িতে ঘরের অভাব ছিল না। যৌথ পরিবার না হলেও আত্মীয়স্বজন, বাবার, তাদের বন্ধু-বান্ধবের ভিড়ে বাড়ি সবসময় ভরে থাকত। তবু স্বাতন্ত্র্য বজায় ছিল। রাতে সে নিজের বিছানায় একাই ঘুমাত, স্টাডি রুম জুড়ে বইয়ের গন্ধ, মেয়ের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিশ্বের সেরা সাহিত্য সম্ভারে সেজে উঠেছিল সে-ঘর।
ছোটবেলায় ছোটকা’র বলা গল্পে যে-ঘর গড়ে উঠেছিল মনের ভেতরে, তার দেওয়াল ছিল ক্যাডবেরিসের, দরজা-জানলা ছিল বিস্কুটের, ছাদ ছিল ব্যাঙের ছাতার আর যাবতীয় আসবাবপত্র হল বই। ছোটকা বলত— যখন খিদে পাবে হাতের সামনে যেটা পাবি— ধর দেওয়ালটাই পেলি একটু ভেঙে খেয়ে নিয়ে আবার বই পড়বি। পেটের খিদে মিটলেই হল, মনের খিদে কিন্তু মেটাতে হয় বই দিয়েই।
বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সেই ঘর তাই কেবল বই দিয়ে মোড়া। কিন্তু দু’ কামরার ঘরে বিয়েতে যৌতুক পাওয়া আসবাবপত্রের মাঝে বইয়ের বড় অভাব। কেবল পাঠ্যবই। কতবার ইচ্ছে হয়েছে নিজের বাড়ির পুরো লাইব্রেরিটা যদি তুলে আনা যেত এখানে, একটা চাকা লাগিয়ে মর্জিমতো সেটা নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যেত এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে তবে বেশ হত।
তার সেই ইচ্ছে পূরণ হয়নি। সময় তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল সেটা তার বাড়ি ছিল না। বাপের বাড়ি ছিল। তবু স্বপ্ন মরে না, এক বাসা থেকে আরেক বাসায় উঠে আসে তারা। আগেরটার থেকে একটু ভাল। চারদিক সবুজে মোড়া। দুটো ঘর, ড্রইংরুম, কিচেন, বাথরুমের পাশাপাশি একচিলতে বারান্দা। সবে ডানা মেলতে শুরু করেছিল নিজস্ব একটা বইয়ের তাকের স্বপ্ন। তখনই আবারও উচ্ছেদের বার্তা। এক বছরের চুক্তি শেষ। এক ডাঙা থেকে আরেক ডাঙায় ভাসতে ভাসতে শেষ অবধি এই ফ্ল্যাট। বড় মায়া-মমতা দিয়ে সাজানো শুরু করেছিল চারতলার ওপরে হাজার স্কোয়্যার ফিটের নিজস্ব ফ্ল্যাট। বারান্দায় মনের মতো ফুলগাছ, দেওয়ালে সমুদ্র-ফেনিল শুভ্রতা আর ঝাড়বাতিতে সেজে ওঠা ঘর। সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম।
কিন্তু গৃহপ্রবেশের (ghar bari) দিনই সে জেনে গেল এই ফ্ল্যাটটা আসলে তার নয়, শ্বশুর, শাশুড়ি, স্বামী, দেবর তারপর তার অধিকার। সে এখানে পঞ্চম ব্যক্তি। যার উপস্থিতি, মতামত বড়ই গৌণ। জানলায় বড় ভারী পেলমেট লাগিয়ে পর্দা টাঙালে শাশুড়ির দম বন্ধ লাগে, দরজায় পর্দা? সে আবার কী কথা! আলো-বাতাস খেলতে পারবে না ঘরে। অগত্যা, একের পর এক মনের মধ্যে বীজ বোনা ঘর বানাবার ইচ্ছে মরে যেতে শুরু করল।
বউমা, এভাবে চললে, বাড়িতে মন না দিলে বড় মুশকিল। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াচ্ছ— কী করো কে জানে! আমার এই বয়সে আর সংসারের কাজকর্ম দেখতে ভাল লাগে না। অফিস থেকে বাড়ি ফেরা-মাত্র শাশুড়ি-মা নিজের ঘর থেকে বলে উঠল— হেনা একেবারে কথা শোনে না। যা-ই করতে বলি, বলে বউদি বলেনি। আমি বাড়ির কর্ত্রী। অথচ আমাকে এতটুকু গুরূত্ব দেয় না। এর একটা বিহিত কর।
পাশের ঘরে ল্যাপটপে ইংরেজি সিনেমা দেখায় ব্যস্ত কস্তুরী সাউন্ড মিউট করে উঠে এসে বলল— আম্মা, মাকে বলে কী হবে? তুমিই বা কবে বাড়ির খেয়াল রেখেছ? সেই ছোট্ট থেকে আমিই সব সামলাচ্ছি। তুমি বিকেল হলে সেজেগুজে মিশন, নইলে বাপের বাড়ি চলে যেতে। এখন নেহাত বয়স হয়েছে, শরীরে পারো না, কেউ দায়িত্ব নিতেও চায় না, নিরুপায় হয়ে বাড়িতে থাকছ। মা-র বরাবরই অফিস, আমাকে সেই ছোট্টবেলা থেকে পার্মানেন্ট হোম মেকার করে রাখা হয়েছে। কী রান্না হবে, কে কী খাবে, কোন লোক এল না, কার কী হল— সব দেখার যেন আমার জন্ম হয়েছিল!
তুমি ছাড়া কে করবে দিদুভাই? তোমারই সব। শাশুড়ি উত্তর দিল।
কস্তুরী বলল, এই পৃথিবীতে কিছুই নিজের নয়, সব কিছুই কী দিলাম আর কী পেলাম সেই হিসেবে চলে। এ বাড়ি তোমার। যদি মায়ের হত তবে মা ঠিক আঁকড়ে ধরে থাকত, এত নিরুত্তাপ হত কি? নাকি এত দেরি করে বাড়ি ফিরত? বাবার কোনও মাথাব্যথা নেই কিছু নিয়েই। পড়ে রইলাম আমি। স্কুল-কলেজ বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা… যেখানেই যাই চিরদিন সেই এক গল্প, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরিস, আম্মা একা আছে… কই তোমার তো কখনও মনে হয়নি নাতনি স্কুল থেকে একা ফিরে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঘরে ঢুকবে, নিজেই খাবার গরম করে খাবে, আমারও অনেক অভিযোগ আছে…
গান্ধর্বী শাশুড়ি আর কস্তুরীর কথা শুনতে শুনতে স্নানে ঢুকল। নিজের মনেই বলল— বাড়ি কাকে বলে? মানুষ জানেই না কখন কে কোন মুহূর্তে চার দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বাড়ি নামক আশ্রয়স্থল থেকে উৎখাত হয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! কোনও নির্দিষ্ট ঠিকানাই আর থাকবে না কালের স্রোতে। সব দেওয়াল ভেঙে সেই আদিম গুহাবাসী মানুষের মতো আবার হাঁটা শুরু করবে অন্য কোনও গ্রহের সন্ধানে। যেভাবে অভিবাসন বাড়ছে, এক দেশ আর এক দেশকে দখল করে নিচ্ছে তাতে হয়তো বাড়ি শব্দটা একদিন কেবল ছবিতে দেখা যাবে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।
তারপর শাওয়ার চালিয়ে বাথরুম থেকেই চেঁচিয়ে বলল— কস্তুরী নিজের মনের বাড়িটা এখন থেকে যতরকম রং আছে তাই দিয়ে সাজিয়ে রাখ, সেখানে স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য আলোটা না জ্বালিয়ে রাখলে যত বড় বাড়িই হোক না কেন, ক্রমশ অন্ধকার নেমে আসবে…।
অঙ্কন : শংকর বসাক