অন্য ভাষার শব্দকে ধারণ করে একটি ভাষার প্রবাহী হওয়ার কথা অস্বীকার করতে পারেননি আচার্য সুকুমার সেনও। লিখেছেন, “ দ্রাবিড় অস্ট্রিক প্রভৃতি অন্যভাষী অধিবাসীর সম্পর্কে আসিয়া ভারতীয় আর্যেরা অনেক নূতন বস্তু ও বিষয়ের সহিত পরিচিত হইয়াছিল এবং সেই সেই ভাষার শব্দ গ্রহণ করিয়াছিল।” কদলী, তাম্বুল, গণ্ড প্রভৃতি অনার্য ভাষার মতো আরও অনেক শব্দ সংস্কৃত শব্দকোষে অন্তর্ভুক্ত হয়ে ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। একইভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে আমাদের ভাষা ‘বাংলা’ (Bengali Language)।
সময়টা ১২০৫-’০৬ খ্রিস্টাব্দ। বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হল সুলতানি শাসন। বাংলাদেশে মুসলমান শক্তির আধিপত্য শুরু হয় ত্রয়োদশ শতকে এবং ইংরেজ শাসনের মাধ্যমে এর অবসান ঘটে অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে। মধ্যবর্তী প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছরের সহাবস্থানের ফলে শাসকের ভাষা ফারসি (কিছু তুর্কি এবং প্রচুর আরবি) থেকে বহু শব্দ বাংলা ভাষায় (Bengali Language) ঢুকে পড়েছে। বাংলায় প্রায় আড়াই হাজার শব্দ সরাসরি ফারসি বা ফারসির মারফত তুর্কি ও আরবি থেকে এসেছে। সুলতানি শাসনের পরবর্তী ষোড়শ শতাব্দী থেকে মুঘল শাসনের প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পেলে বাংলায় ফারসি শব্দের প্রবেশ বিশেষ বেড়ে যায়। সরকারি কাজের ভাষা হওয়ার কারণে অষ্টাদশ শতকে বাংলা ভাষার ওপর এই ভাষার প্রভাব ছিল সর্বাধিক। ঊনবিংশ শতক থেকে সরকারি কাজে ইংরেজির অনুপ্রবেশে ফারসির ব্যবহার কমতে থাকে। কিন্তু ততদিনে ফারসি শব্দ এমনভাবে বাংলা ভাষার শিকড়ে প্রবেশ করেছে যে বাংলা শব্দ হিসেবেই তা এখন ব্যবহৃত হয়। যেমন— খুব, হাওয়া, জমি, লাল, বাগান, পছন্দ, বিদায়, বদল ইত্যাদি ভীষণ সাবলীলভাবে বাংলা শব্দরূপে ব্যবহার করা হয়।
সাহিত্যের আধার যেহেতু ভাষা সেহেতু বাংলা সাহিত্যেও ভাষার ব্যবহারে ফারসি শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়।
কেতকাদাস ক্ষেমানন্দের ‘মনসামঙ্গল কাব্য’-এ হাসান-হুসেন পালাতে আরবি-ফারসি শব্দের বিশেষ প্রয়োগ দেখা যায়— “নটিয়া পটিয়া : পাগড়ী জটিয়া : হাম গএ যেন ডরকো।/ হামকো ধরিয়া : মারনে সে হরিয়া : ঝুটবাত্ কহতো থাকিসো।।” মুকুন্দরাম তাঁর চণ্ডীমঙ্গলে মুসলমানদের কলিঙ্গ নগরে আগমন অংশে লিখছেন— “বসিল অনেক মিঞা/ আপন তরফ নিঞা/কেহ নিকা কেহ করে বিয়া।/ মোলনা পড়ায়্যা নিকা/দান পায় সিকা সিকা/ দোয়া করে কলমা পড়িয়া।।” বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’, কৃত্তিবাসের ‘রামায়ণ’, মালাধর বসুর ‘শ্রীকৃষ্ণবিজয়’, কবীন্দ্র পরমেশ্বরের ‘মহাভারত পাঁচালী’ দ্বিজ শ্রীধরের ‘বিদ্যাসুন্দর’-এর মতো কালজয়ী কাব্যগুলিতেও আরবি-ফারসি শব্দের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়। পদাবলী সাহিত্যে রামপ্রসাদের গানেও এইধরনের শব্দের ব্যবহার দেখা যায়— “মন রে কৃষিকাজ জান না।/ এমন মানব জমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলত সোনা।”
আরও পড়ুন: ভাষাশহিদদের শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতিসংঘের বাংলা ফন্ট
সুলতানি ও মোঘল শাসনের সময়ে স্থানীয় প্রজাদের সঙ্গে দরবারের লোকজনদের ওঠা-বসা, লেনদেন ও ভাবের আদানপ্রদানের অনিবার্য পরিণামে দৈনন্দিন ব্যবহারে আন্দাজ, খরচ, কম, বেশি, নগদ, পর্দা, শহর, জোর, বস্তা, সিন্দুক, আইন, আক্কেল, হুকা, কেচ্ছা, তাজ্জব, দফা, উজবুক, কাঁচি, বিবি, বোঁচকা শব্দগুলি এমনভাবে একাত্ম হয়ে গেছে যা এখন বাংলা ভাষা বলেই মনে করা হয়। এরই সঙ্গে বহুল প্রচলিত ফারসি প্রত্যয়-উপসর্গগুলি : –আনা, -গিরি, -দার, -বাজ, সই, বে ইত্যাদি বাংলায় এনে দিয়েছে বাবুয়ানা, কেরানিগিরি, অংশীদার, পাওনাদার, ধড়িবাজ, টেকসই, বেহাত প্রভৃতি শব্দগুলি।
অষ্টাদশ শতকে বহু পণ্ডিত ফারসি ভাষা চর্চা করতেন। কবিরা, পণ্ডিতরা এইসময়ে সংস্কৃত গ্রন্থ আরবি ফারসিতে অনুবাদ করতে থাকেন। পরবর্তীকালে রাজা রামমোহন রায় ছিলেন ফারসি ভাষায় বিশেষ দক্ষ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের তুলনায় কম হলেও আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আরবি-ফারসি এক অনন্য রূপ পায় বিশ শতকে।
এখনও বাড়ির দলিল-দস্তাবেজে আরবি-ফারসির আধিক্য দেখা যায়। বর্তমানে আরবি-ফারসি শব্দের আত্তীকরণ এতটাই সাবলীল যে বেশিরভাগ মানুষই উৎস না জেনে এই শব্দগুলিকে খাঁটি বাংলা শব্দ মনে করেন। এই সংশ্লেষ আমাদের বাংলা ভাষাকে করেছে সুসমৃদ্ধ, যা একটি ভাষার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। ভাষাতাত্ত্বিক রামেশ্বর শ-এর মতে : যে ভাষা যত বিচিত্র ভাব ও বস্তু এবং যত গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম সে ভাষা তত উন্নত। ভাষার এই প্রকাশক্ষমতার মূল আধার হল ভাষার শব্দসম্পদ। এই শব্দসম্পদের এক বিশেষ সমৃদ্ধি হয় ‘অন্য ভাষা থেকে গৃহীত কৃতঋণ শব্দের সাহায্যে’। এই সকল শব্দের ব্যবহারে আজকের বাংলা ভাষা (Bengali Language) এত উন্নত। একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবেন না। বিশুদ্ধবাদী হওয়ার অনর্থক চেষ্টায় ইতিহাসের সমর্থন নেই, ভবিষ্যৎ বিকাশের প্রতিশ্রুতিও তাতে অনুপস্থিত।