কী আছে ওই অতলে?
ঢেউয়ের নিচে অন্ধকার।
তারও নিচে?
অসংখ্য প্রাণী (Marine Animals) আর উদ্ভিদ।
সে তো জানা কথাই। কিন্তু তারা যে সব প্রতিপ্রভ, এমন খবর জানা ছিল না আগে। প্রতিপ্রভ মানে ফ্লুরোসেন্ট। অর্থাৎ, যাদের গায়ে আলো পড়লে তারা আলো ঠিকরিয়ে আরও মায়াবী হয়ে ওঠে। সমুদ্রের আঁধারমাখা জগতে তারা মায়াবী আলো গায়ে মেখে নিয়ে নিজেদের চেনায়। আত্ম উপস্থিতির জানান দেয়।
এই অদ্ভুত তথ্যটা সামনে এনেছেন নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং মেরিন বায়োলজিস্ট ডেভিড গ্রুবার। গবেষণায় তাঁকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছেন হার্ভার্ডের অধ্যাপক রবার্ট উড। গবেষণার ফলে উঠে এসেছে এক চমকে দেওয়ার মতো সংবাদ। নয় নয় করে ১৮০টা সামুদ্রিক প্রাণী (Marine Animals) আছে যারা নানা কারণে, বিচিত্র সব অজুহাতে তাদের এই জাদু আলো সঞ্চারী ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।
কেন কোনও কোনও বিশেষ প্রাণীর এমন অত্যাশ্চর্য ক্ষমতা থাকে?
কারণ খুঁজতে গিয়ে গবেষকরা দেখেছেন, এর পেছনে আছে প্রোটিনের কারসাজি। যেমন, প্রবালের শরীর। সেই শরীরে যতটা প্রোটিন থাকে তার অন্তত ১৫ শতাংশ ওই প্রতিপ্রভ করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটিন। এটির নাম ইওস ফ্লুরোসেন্ট প্রোটিন (Eos FP)।
গ্রিক পুরাণে এক দেবী ছিলেন। অসামান্যা সুন্দরী সেই নারী রোজ ঘুম থেকে উঠে ঊষা লগ্নে ওশিয়ানাস নদীর তীরে তাঁর নিজের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। তিনি টাইটানস হাইপেরিয়ন ও থেলার কন্যা। সূর্যদেব হেলিওস ও চন্দ্রদেবী সেলেনার বোন তিনি। রোজ সকালে সুয্যিদাদার আগমনবার্তা মর্ত্যলোকে ছড়িয়ে দিতে দুই ঘোড়ায় টানা রথে চেপে আসেন তিনি। তাঁর আঙুলগুলোর রং গোলাপের পাপড়ির মতো। সেই রঙে রঙিন হয় ভোরের আকাশ। প্রাচীন গ্রিকরা এই দেবীর নাম দিয়েছিল ইওস। ভাষাবিদরা বলছেন, এই ইওসের অনুষঙ্গেই বৈদিক সাহিত্যে দেবী ঊষার আবির্ভাব। এমন স্নিগ্ধপ্রভ দেবীর নামেই নামাঙ্কিত প্রবালের প্রতিপ্রভার জন্য দায়ী প্রোটিনখানি।
অমর্ত্যের দেবী হলেও ইওস কিন্তু মানুষের প্রেমে পড়েন। যেমন ট্রোজানের যুবরাজ টিথোনাসকে তিনি ভালবেসেছিলেন। মরণশীল মানুষের সঙ্গে অমর্ত্যমাধুরী মাখা সেই প্রেমের পরিণামে টিথোনাস অমরত্ব অর্জন করেছিল। তার দৈবী প্রেমিকা ভোরের দেবী তাকে অমরত্ব উপহার দিলেও নিশ্চিত করতে পারেনি তার অনন্ত যৌবন। টিথোনাস তাই বেঁচে থাকলেও বুড়িয়ে যায়। অমরত্ব তাকে অজর করতে পারে না।
এথেন্সের সেফালাস যেতে চায়নি ইওসের সঙ্গে। নিজেকে ডুবিয়ে দিতে চায়নি তাঁর রূপের গভীরে। নিজের বউকে নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল সেই সুদর্শন যুবা। সহ্য হয়নি ইওসের। সেফালাসকে কার্যত টেনে এনেছিলেন তাঁর কাছে। শেষে যখন ইওসের কবল থেকে ছাড়া পেল সেফালাস ততদিনে তার মনে নিজের স্ত্রীকে ঘিরে সংশয় তৈরিতে সফল ইওস। মুক্তি পেয়েও দাম্পত্যে ফিরতে পারে না পরিত্যক্ত সেফালাস।
ইওসের মতোই আকর্ষক প্রবালের প্রোটিন। প্রবালের ভেতর থেকে বিকীর্ণ প্রভা তার দিকে টেনে আনে কীটাণুদের। এইসব মাইক্রোবদের (Marine Animals) সঙ্গে প্রবালের মিথোজীবী সম্পর্ক। অমেরুদণ্ডী প্রবাল। কীটাণুদের সঙ্গে তারা এক গোত্রে পড়ে না। তবু তারা ওদের ডাকে। আলোর প্রভায় মিশিয়ে দেয় যৌথ যাপনের ইশারা। কীটাণুর দল গুঁড়ি মেরে মেরে আসে। ঘাপটি মেরে জায়গা খুঁজে নেয় প্রবালের পলিপ অস্তিত্বে।
ঠিক যেমন করে দেবী ইওস তাঁর নরম গোলাপি গভীরে টেনে নিয়েছিলেন মানুষ টিথোনাস আর সেফালাসকে। মিথোজীবনের আকর্ষণ দেখিয়ে। সেই একইরকমভাবে।
আর্কটিক স্নেলফিশ, গোবি আর ব্রিম মাছেরাও একইভাবে নিজেদের প্রতিপ্রভ বিশেষত্বকে ব্যবহার করে ডাক দেয় অন্য মাছেদের, নিজেদের কাছে আসার জন্য। আবার কখনও ওই একই প্রভা ছদ্মবর্ম তুলে দেয় শত্রুকে বিভ্রান্ত করার জন্য। আলেয়ার আলো মেখে তারা আত্মরক্ষা করে।
হাঙরদের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তাদের গায়ে আলো পড়লে হ্রস্ব তরঙ্গদৈর্ঘ্য আলোকে শুষে নিয়ে তারা দীর্ঘতর তরঙ্গদৈর্ঘ্যযুক্ত আলোর বিকিরণ নিশ্চিত করে। হাঙরের দেহে যে অণুগুলো তাদের প্রতিপ্রভ হয়ে ওঠার কারণ, সেগুলো আদতে কীটাণুদের ঠেকায়। জমতে দেয় না হাঙরের গায়ে। সেজন্য, সেজন্যই সাগরের তলদেশে যদি কিচ্ছুটি না করে হাঙর স্রেফ চুপটি করে জ্যান্ত লাশ হয়ে পড়েও থাকে, তাহলেও তার গায়ে কোনও কীটাণু আসর জমাতে পারে না। বাঁধতে পারে না বাসা।
ডেভিড গ্রুবারের গবেষণাপত্র বলছে, সমুদ্রের প্রতিপভ প্রাণিকুল সবচেয়ে সংবেদনশীল নীল আলোর প্রতি। নীল আলো গায়ে পড়লেই তারা সেই আলোর নীল রং শুষে নিয়ে বিকিরণ করে লাল, সবুজ কিংবা কমলা রং।
সমুদ্রের তিরিশ ফুট গভীরে স্কুবা ডাইভিং করতে গেলে আপনি চারদিকে কোনও লাল রং দেখতে পাবেন না। কারণ, সেক্ষেত্রে সূর্যের আলোর লাল রং শুষে নিচ্ছে সাগরের জল। কিন্তু পঞ্চাশ ফুট নিচে ডুব দিলে দেখতে পাবেন লাল প্রবাল। সেটা কিন্তু সূর্যরশ্মির কারণে নয়। ওটার কারণ, প্রবালের গায়ে পড়া নীল আলো। সেই আলোর নীল রং শুষে নিয়ে প্রবাল তখন বিকিরণ করে লাল রং। তাই, তাই-ই আপনার চেতনার রঙে প্রবাল ওঠে রাঙা হয়ে।
আরও পড়ুন: কসমেটোলজি পড়ে কাজের উপায়
যদি দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গভীরে ডোবেন, তবে দেখবেন ফ্ল্যাশলাইট ফিশ (Marine Animals) জোনাকিদের মতো নিজেদের আলো জ্বেলে সাঁতরাচ্ছে। রাতের অন্ধকারে তারা নিজেদের কাছাকাছি এসে কিংবা দূরে সরে গিয়ে, এঁকেবেঁকে কিংবা সরলরেখায় অথবা বৃত্তাকারে নিরন্তর তৈরি করে চলে অযুত আলোর নকশা, রাত-তারাদের মতো। মায়ালোক তৈরি হয় তখন লবণাক্ত জলের তলায় প্রভাময়ী লাবণ্যের উদ্ভাসে। সমুদ্রের গভীরতর প্রদেশে ভিড় করে অজস্র নাম না-জানা মাছ। মানুষের চেনা জগৎ যাদের চেনার সুযোগই পায়নি কোনওদিন। আগামীতে যে পাবে তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই অচেনা-অজানা জললোকে বেঁচে থাকে সামুদ্রিক স্পঞ্জরাও। তাদের এক-এক জনের আয়ু ১৮ হাজার বছর।
নীচের অন্ধকার মাঝে মাঝে ঘুচে যায় হিপোক্যাম্পাস ইরেক্টাস সীহর্সের চলাফেরায়। ছোট্ট লাজুক প্রাণী। এই গহন অন্ধকারেই জ্বলে ওঠে অ্যাকানথুরিড মাছেরা। জ্বলজ্বলে সবুজে তাদের চেনা যায়।
আর এসবের মধ্যেই মাঝে-মাঝে সমুদ্রের তলদেশে চলতে থাকে সমুদ্র গভীরে খনিজ উত্তোলনের কাজ। মেঝেতে গর্ত করে তোলা হয় খনিজ সম্পদ। মানুষের প্রয়োজনে। সভ্যতার চাকা সচল রাখার প্রণোদনায়। আর তাতেই ভেঙে চৌচির হয়ে যায় অজানা অতীত থেকে তৈরি হয়ে আসা প্রবালকীটদের মিথোজীবন। নিমেষে।
এভাবে মুহূর্তের পর মুহূর্ত জুড়ে তৈরি হয় ধ্বংসের প্রহর। আর তাতেই উধাও হয়ে যায় একের পর এক প্রবালপ্রাচীর। তার ভেতরে বাসাবাঁধা কীটাণু, জীব, অণুজীব, মাছ, উদ্ভিদ— সবকিছু সমেত।
ক্যারিবিয়ান সাগরের গভীরে দু-দশক আগেও যেসব সামুদ্রিক প্রজাতির দেখা পেয়েছিলেন ডেভিড গ্রুবাররা, সেগুলোর সব ক’টার হদিশ আর পান না।
তন্ন তন্ন করে খোঁজার পর প্রতিপ্রভার বিনাশে জেগে থাকে শুধু হতাশার কালচে সময়। জীববৈচিত্র্যের গৌরব হরণ করে টিকে থাকার চেষ্টা করে শুধুই মানবসভ্যতার দানব।
সাগর তলের আলোরা ফুরোতে থাকে।
নিশ্চিত মায়াপ্রহর মুছে রয়ে যায় কেবল অতল অন্ধকার, আগামীর জন্য।