টিফিন দারা… কাঞ্চনজঙ্ঘা… সূর্যোদয় আর বিস্ময়…

পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় উচ্চতম ভিউ পয়েন্ট টিফিন দারা। বলা হয় পাহাড়ের গ্যালারি। মেঘ, রোদ, পাইন, অর্কিড, রডোডেনড্রন সারাদিনের সাক্ষী। সঙ্গী। কিন্তু মায়াবী বিভ্রম তৈরি হয় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের মাহেন্দ্রক্ষণে। রিশপের কাছে টিফিন দারায় তাই যাঁরা একবার গেছেন স্মৃতির ভাণ্ডার ভরিয়ে ফিরেছেন। জানাচ্ছেন প্রীতিকণা পালরায়

Must read

একেই বলে আসলের চেয়ে সুদ বড়! কালিম্পং জেলার ছোট্ট শান্ত গ্রাম রিশপ। ৮,৫০০ ফুট উচ্চতায় নেওড়াভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের অন্তর্গত পাহাড়ি গ্রামটি বিখ্যাত দুর্দান্ত অর্কিড আর প্রচুর পাখির জন্য। অবস্থানটাও দারুণ। সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ, ভূটান— তিনের প্রায় মাঝে। ফলত ভ্রমণপিপাসুদের দারুণ প্রিয় ও পরিচিত। কাঞ্চনজঙ্ঘার মহিমাময় বিস্তারের সঙ্গে সিকিমের নীল পর্বতশ্রেণির অনায়াস বন্ধুত্ব ঘটেছে এইখানে। আকাশের ক্যানভাসে তাই একসঙ্গে ধরা দেয় কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে চেনা-অচেনা অনেক শৃঙ্গ। সব মিলিয়ে শুধু চোখের আরাম নয় মনেরও উপশম কারণ জঙ্গল, পাহাড়, উপত্যকার নিজস্ব নিস্তব্ধতা রিশপকে করে তুলেছে অনন্য। কিন্তু এহেন রিশপের কথা বলতে গিয়েও ভ্রমণপিয়াসীদের মুখে ফেরে টিফিন দারার নাম। এই রিশপ থেকেই মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে টিফিন দারা আদতে একটি ভিউ পয়েন্ট। কাঞ্চনজঙ্ঘার ৩৬০ ডিগ্রি ভিউ পেতে গেলে আপনাকে যেতেই হবে টিফিন দারা। রিশপ থেকে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেক করে যেতে হয়। আর গেলে রিশপের আগে আপনার টিফিন দারার কথাই আগে মনে পড়বে!
প্রকৃতির সঙ্গে এমন একাত্ম হওয়ার সুযোগ যে শহুরে ব্যস্ত মনের কমই মেলে। সঙ্গে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ট্রেকিং এনে দেয় বাড়তি অ্যাডভেঞ্চারের অনুভূতি। ঘন জঙ্গলের নৈঃশব্দ হাত ধরাধরি করে পুরো পথের সঙ্গী হয়। ঘণ্টাখানেকের যাত্রাপথ, কিন্তু চিরস্থায়ী স্মৃতি। পাইন, ফার, বার্চের মতো সুউচ্চ গাছের সারি যেমন রয়েছে তেমনই আছে অজস্র অর্কিডের অনন্ত সমাহার। পথের শ্রম তেমন লাগবে না শুধু এই মনোরম প্রকৃতির কারণে। আর ভিউ পয়েন্ট-এ অর্থাৎ টিফিন দারায় পৌঁছে যাওয়ার পর আর কোনও কিছুই মাথায় থাকবে না। সূর্যোদয় বা সূর্যাস্ত দুইয়ের সময়ই ঈশ্বর যেন তাঁর জাদুতুলি বুলোন। আর তাই আদিগন্ত যেসব রঙে রঙিন হয় তা বাস্তবের কোনও শিল্পীই বোধহয় যথার্থ তুলে ধরতে পারবেন না। পুরোটাই স্বর্গীয়। কাঞ্চনজঙ্ঘার অবিস্মরণীয় রূপ শুধু নয়, চোখে পড়বে কোকথাং, তালুংয়ের মতো সিকিমের বেশ কয়েকটি পর্বত শৃঙ্গ ও নাথু লা ও জেলেপ লা গিরিপথ। সূর্যোদয়ের পর আকাশ এখানে দীর্ঘ সময়ের জন্য লালবর্ণ হয়ে থাকে। একই সঙ্গে রডোডেনড্রনের সময় ধরিত্রী হয়ে থাকে লাল বর্ণের। তাই রক্তিমতার ছোঁয়ায় এই সময়টা যথার্থ অর্থেই স্বর্গীয়। এই সময় পাখি আর প্রজাপতির ভিড়ও চোখে পড়ার মতো হয়। এখানে প্রতিটি কটেজ বা রিসর্টে রয়েছে প্রশস্ত বারান্দা, যাতে এখানে যাঁরা সারাদিন থাকতে চান, প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে প্রকৃতিকে অনুভব করতে চান, তাঁরা রিসর্ট থেকেই যাবতীয় সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন।

আরও পড়ুন: দুয়ারে সরকারে করোনা ভ্যাকসিন

তবে এর পাশাপাশি ঘুরে নেওয়ার জন্যও বিস্তৃত পরিসর রয়েছে। কারণ রিশপ থেকে অনায়াসে ঘুরে নেওয়া যায় কাছাকাছি টুরিস্ট স্পটগুলো। এর মধ্যে আছে লাভা, লোলেগাঁও, কালিম্পং, কোলাখাম, চারখোলে ইত্যাদি। সবচেয়ে কাছে লাভা। মাত্র ৬ কিমি। নেওড়াভ্যালি জাতীয় উদ্যানের উঁচু-উঁচু পাইন গাছগুলো পাহাড়ের ঢালে যেখানে মিশেছে তারই কোলে সারি সারি কাঠের ছোট বাড়ি আর অজস্র রঙিন ফুল দিয়ে সাজানো গ্রাম হল লাভা। আরও আছে ছবির মতো গুম্ফা, মনেস্ট্রি, শেরপা ভিউ পয়েন্ট যেখান থেকেও একাধিক পর্বত শ্রেণির দেখা মেলে। তা ছাড়া লাভা থেকে একাধিক ছোট ছোট ট্রেক রুটও আছে, যার অন্যতম ছাঙ্গে ফলস। লাভা থেকে আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে ২৪ কিমি দূরে ফার, জুনিপার আর ক্রিপ্টোম্যানিয়া বনের ছায়ায় আরও এক পাহাড়ি গ্রাম লোলেগাঁও। পর্যটকেদের অন্যতম প্রিয় ডেস্টিনেশন। এ ছাড়াও হাতে সময় থাকলে অনায়াসে বেড়িয়ে আসা যায় কালিম্পং। কাজেই টিফিন দারাকে উদ্দেশ্য করলে বিধেয় হিসেবেও পাওনা অনেক।
কোথায় থাকবেন : থাকতে হলে রিশপে থাকাই সবচেয়ে ভাল। রিশপে একাধিক হোটেল, রিসর্ট আছে। আগে থেকে বুকিং করে যাওয়া প্রয়োজন।
বিশেষ সতর্কতা : যাঁদের ঠান্ডায় অ্যালার্জি আছে তাঁদের বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। হোটেলে রুম হিটারের বন্দোবস্তের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনীয় গরম জামা ও জরুরি ওষুধপত্র সঙ্গে নিতে হবে।

কীভাবে যাবেন?

টিফিন দারা যেতে গেলে প্রথমে পৌঁছতে হবে রিশপ। নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন পৌঁছে বা বাগডোগরা বিমানবন্দর থেকে গাড়িতে রিশপ পৌঁছনো যায়। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে রিশপের দূরত্ব ৫২ কিলোমিটার। এ ছাড়া লাভা, লোলেগাঁও, কালিম্পং থেকেও রিশপ পৌঁছনো যায়। দূরত্ব খুব বেশি নয়। রিশপ থেকে ট্রেক করে পৌঁছতে হবে টিফিন দারা।

Latest article