সে এক সময় ছিল। যখন রোদের রং আরও সোনালি ছিল। ফুলের রং গাঢ়। পাখিরা আরও সুরেলা। বাতাস তাজা। আর মানুষজন পবিত্র, নির্মল, নিষ্পাপ! অনেকটা এভাবেই এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মকে নিজেদের সময়ের কথা বলে। বরাবর। স্মৃতি বড় শৌখিন! আবার খানিক স্বার্থবাজও! হল্লা করে এমন অনেক বিষয় নিয়ে যাদের সঙ্গে নিজেও এক সময় সহবাস করেছে! এসব যাঁরা ফ্রন্ট লাইন থেকে প্রত্যক্ষ করেন, তাঁরা পেশায় সাংবাদিক! আর এসব পড়ে-ফেলা মাত্র যাঁরা ফ্রেম বাই ফ্রেম দেখতে পেয়ে যান তাঁরা চিত্রপরিচালক! অরিন্দম শীল এভাবেই আচমকা পড়ে ফেলেছিলেন সাংবাদিক-লেখিকা দীপান্বিতা রায়ের থ্রিলার ‘অন্তর্ধানের নেপথ্যে’। ‘ওঠ ছুঁড়ি’ গতিতে বাকি কাজ। লেখিকার থেকে রাইটস কেনা। প্রযোজক ফিরদউসল হাসান (ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশন) ও আদীপ্ত মজুমদার (কাহাক স্টুডিও)-এর সঙ্গে কথা বলা এবং প্রধান চরিত্র ‘মৌসুমি সেন’-এর জন্য ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তকে রাজি করিয়ে ফেলা! অরিন্দমের কথায়, ‘‘প্রত্যেকেই উত্তেজিত। আমি নিজেও। কারণ অনেকগুলি বাণিজ্য-সফল থ্রিলার বা রহস্য ছবি বানানোর পরেও বলছি, ‘কর্পূর’-এর (Karpoor) মতো পলিটিকাল থ্রিলার আমি এই প্রথম বানাব।”
কথা হল পরিচালক যাঁর লেখা পড়ে এত থ্রিলড সেই থ্রিলার-লেখিকা দীপান্বিতা রায়ের সঙ্গেও। উপন্যাসটি দীপান্বিতা লিখেছিলেন গত বছর শারদীয় নবপত্রিকা’য়। দে’জ পাবলিশিং থেকে বই হয়ে যা বেরোয় এই বছর বইমেলায়। দীপান্বিতা জানালেন, তিরিশ বছর সাংবাদিকতার সূত্রে নানা ধরনের খবর, খবরের ভেতরের খবরের সঙ্গে ওঠা-বসা করতে হয়েছে। এর পাশাপাশি অন্য লেখালিখি করলেও সেখানেও কাজে লাগিয়েছি সাংবাদিকের অভ্যস্ত অনুসন্ধিৎসা, ইন্সটিঙ্কট। থ্রিলারের চাহিদা বেশি বলেই মেটেরিয়াল খুঁজতে গিয়ে একটি ঘটনার কথা মনে পড়ে। ১৯৯৭ সালে ঘটা মনীষা মুখার্জি অন্তর্ধান রহস্য। প্রায় রোজ ‘স্টোরি’ হত এ নিয়ে। ব্যস এ নিয়ে রিসার্চ শুরু করি। জড়ো হয় প্রচুর তথ্য। সেসব ‘এলিমেন্ট’-এর সঙ্গে নিজের কল্পনা মিশিয়ে একটি পরিপূর্ণ থ্রিলার লিখে ফেলতে পারি! যেহেতু সংবাদের শিরোনাম হত ‘অন্তর্ধান রহস্য’, তাই দীপান্বিতা নাম রেখেছিলেন, ‘অন্তর্ধানের নেপথ্যে’, অরিন্দম যা পাল্টে করেছেন, ‘কর্পূর’ (Karpoor)। তা সে ‘গোলাপকে যে নামেই ডাকা হোক না কেন’, স্মৃতির তল থেকে উঠে আসবেন, মনীষা মুখার্জি! যাঁর রহস্যময় ‘হারিয়ে যাওয়া’ নিয়ে আজও চর্চা হয়।
অরিন্দম বললেন, ঘটনাটা যে সময়ের, সেসময় রাজ্যে ছিল অন্য সরকার। মনীষা মুখার্জি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন সহকারী পরীক্ষা নিয়ামক। বাড়ি থেকে বেরনোর সময়, মাকে, ফিরতে দেরি হবে, বলে আর ফেরেননি। রাজনৈতিক চাপান-উতোর প্রচুর হয়েছে। বলা হয় মনীষা তৎকালীন শিক্ষা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, ব্ল্যাঙ্ক মার্কশিট পাওয়া গিয়েছিল তাঁর বাড়ি থেকে, বড় স্ক্যাম চাপা দিতেই তাঁর ‘কর্পূর’-এর মতো উবে যাওয়া! ঘটনাটি থ্রিলারের মতো করেই উপন্যাসে ধরা আছে, আমিও আমার মতো করেই থ্রিলার বানাব। হলিউডে যেমন দারুণ সব বাস্তবধর্মী পলিটিকাল থ্রিলার বানানো হয়, আমাদের এখানে সেটা হয় না। আমি সেই ট্রেন্ডটা চালু করতে চাইছি।
আরও পড়ুন: চিড়িয়াখানার দত্তক নিল কোল ইন্ডিয়া
অরিন্দমের ভাবনার জাদুতে সাহিত্য যখন সিনেমায় সফল কথা বলেছে তেমনই রিয়েলিস্টিক থ্রিলারও যে দর্শকের মন জয় করবে সে-বিষয়ে আশাবাদী হওয়াই যায়। ছবির সময়কাল অরিন্দম দু’ভাগে ভাগ করতে চলেছেন। ১৯৯৭ ও ২০১৯। রাজ্য-রাজনীতির পালা-বদলের কথা থাকলেও রাজনীতি নাকি শুধু কাহিনির দাবি মেনেই আসবে! জীবিত, মৃত, অন্তর্হিত কারও সঙ্গে মিল খোঁজা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি চাইছি টানটান এক থ্রিলার তৈরি করতে যার পরতে পরতে রহস্য লুকিয়ে আর সেই রহস্য উন্মোচনে উদ্যোগী এক সাংবাদিক (অর্পণ ঘোষাল) ও এক ইন্টার্ন (লহমা ভট্টাচার্য)। দীপান্বিতা নিজের পেশাদারি অভিজ্ঞতা দিয়ে যে চরিত্রগুলি রক্ত-মাংসের করে গড়েছেন। থাকছেন একজন দুঁদে হোমিসাইড অফিসারের চরিত্র যে ভূমিকায় অভিনয় করবেন মন্ত্রী-নাট্যকার ব্রাত্য বসু। থাকছে ঝকঝকে এক রাজনীতিক, সাহেব চট্টোপাধ্যায় যে চরিত্রে আর আছে তাঁর পার্টির রাজ্য সম্পাদক। এইখানে রয়েছে এক বিশেষ চমক। এই চরিত্রটিতে প্রথমবার সিনেমায় অভিনয় করতে চলেছেন সাংবাদিক-রাজনীতিক কুণাল ঘোষ। অরিন্দম আশাবাদী মাল্টি-ট্যালেন্টেড কুণাল নতুন ভূমিকাতেও সফল হবেন কারণ কুণাল নিজেই ভীষণ উৎসাহী চরিত্রটিতে রূপদান করতে৷ নিয়মিত ওয়ার্কশপও করছেন। সংবাদপত্রের এডিটরের ভূমিকায় আছেন কাউন্সিলর অনন্যা বন্দ্যোপাধ্যায়। মৌসুমির স্বামীর চরিত্রে অরিন্দম স্বয়ং।
ছবিতে আর যাঁরা অভিনয় করবেন, তাঁরা হলেন, রুমকি চট্টোপাধ্যায়, কণাদ মৈত্র, সঞ্জীব সরকার, সন্দীপ ভট্টাচার্য, প্রদীপ্ত রায়, অভিষেক বিশ্বাস, পায়েল রায়, তপস্যা দাশগুপ্ত। ছবির ডিওপি অনির্বাণ চ্যাটার্জি। চিত্রনাট্য লিখেছেন শুভাশিস গুহ। সম্পাদনা করবেন সংলাপ ভৌমিক। মিউজিক রথীজিৎ ভট্টাচার্য আর কার্যনির্বাহী প্রযোজকের দায়িত্ব পালন করবেন দীপক বাজাজ। ছবির শ্যুটিং শুরু হবে জুলাই মাসে। মূলত কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চল জুড়েই চলবে ‘কর্পূর’-এর (Karpoor) শ্যুটিং। অরিন্দম নিশ্চিত মানুষের মনে ‘কর্পূর’ স্থায়িত্ব পাবে!