শেক্সপিয়র। তার ঠিক পাশেই বঙ্কিম। বঙ্কিমের নীচেই রবীন্দ্রনাথ। খানিকটা দূরে উঁকি মারছেন শরৎচন্দ্র, জীবনানন্দ, বনফুল, সুকুমার, তারাশঙ্কর, মাণিক, বিভূতি। আছেন শরদিন্দু, সত্যজিৎ, শক্তি, সুনীল, শঙ্খ থেকে শুরু করে হাল আমলের লেখকরাও। অতীত এবং বর্তমান। দলবেঁধে আলো ছড়াচ্ছেন কলেজস্ট্রিট বইপাড়ার পুরোনো বইয়ের দোকানে। ঠিক তাঁরা নন, তাঁদের বই।
আরও পড়ুন: রাহুল গান্ধী পারেননি, মমতাই বিকল্প মুখ
উপন্যাস, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, ছড়া। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের পাশাপাশি আছে পাঠ্য বই, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা। বিবর্ণ তার মলাট। কোনোটার আবার মলাট নেই। মুড়ে রাখা হয়েছে একরঙা মোটা কাগজে। হাতে লেখা হয়েছে নাম। বইয়ের এবং লেখকের। হলুদ হয়ে গেছে পৃষ্ঠা। অথচ কদর বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং বেড়েছে। দুষ্প্রাপ্য বই তো রীতিমতো অ-মূল্য। সিরিয়াস পাঠক সসম্মানে সংগ্রহ করে নিয়ে যান।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাগোয়া ফুটপাথ ধরে হাঁটলে দেখা মেলে বেশ কয়েকটি পুরোনো বইয়ের দোকানের। কিছু গুমটি দোকান, কিছু আড়ম্বড়হীন, ফুটপাথে এমনিই সাজিয়ে বসা। দোকানগুলো ঘুরে দেখলে মনে হয় এ যেন একটা অন্য জগৎ। নেই চাকচিক্য। রঙের বাহার। আছে ঐতিহ্য। বৈচিত্র্য। এই দোকানগুলিতে দেখা মেলে এমন কিছু বইয়ের, যেগুলো হাজার চেষ্টা করেও পাওয়া যায় না নতুন বইয়ের দোকানে। পাঠকের সেসব জানা। তাই তো তাঁরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন। কেউ কেউ আনমনে ঘুরতে ঘুরতে পেয়ে যান মণিমাণিক্যের সন্ধান।
পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোয় দেখা মেলে বিভিন্ন বয়সী পাঠকের। কেউ স্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, কেউ শিক্ষক। কেউ লেখক। কেউ সাধারণ পাঠক। সিলেবাসের পাশাপাশি কেনা চলে সিলেবাসের বাইরের বই। নির্দিষ্ট একটি বই কিনতে এসে অনেকেই এমন কোনো বইয়ের দেখা পেয়ে যান, যেটা তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে খুঁজছিলেন। তুলনায় কম দামে পেয়ে যান। কিছু কিছু মানুষ আছেন, পুরোনো বইয়ের দোকান ঘুরে দেখা যাঁদের নেশা। সবসময় যে কেনেন, তা নয়। এমনিই ঘুরে দেখেন। ছুঁয়ে দেখেন। প্রকৃত পাঠক কারা, দেখেই বুঝতে পারেন বই বিক্রেতারা। পাঠকদের চাহিদা পূরণ করতে পেরে খুশি হন। বহু কষ্ট করে তাঁরা সংগ্রহ করেন পুরোনো বই। কেউ কেউ ব্যাগ বোঝাই করে দিয়ে যান। অনেক সময় গিয়ে নিয়েও আসতে হয়। কোনটা দুষ্প্রাপ্য, কোনটা সহজলভ্য, বই হাতে নিয়েই তাঁরা বুঝতে পারেন। ব্যবসা তো বটেই, কেউ কেউ হাজার কষ্ট সহ্য করেও শুধুমাত্র ভালোবেসে থেকে গেছেন এই জগতে। পুরোনো বইয়ের গন্ধ শরীরে, মনে মেখে।
ঐতিহ্যবাহী ফুটপাথে হাঁটতে হাঁটতে, পুরোনো বই ঘাঁটতে ঘাঁটতে কথা হল কয়েকজন বই বিক্রেতার সঙ্গে।
প্রায় ৫০ বছর এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন বুলগানিন সরদার। তিনি জানালেন, ‘বাবার হাত ধরে এসেছি এই জগতে। আর বেরোতে পারিনি। আসলে বেরোতেও চাইনি। ভালোবেসে ফেলেছি পুরোনো বইয়ের এই জগৎটাকে। যা উপার্জন হয় তাতে ডালভাত জুটে যায়।’
কোথা থেকে বই সংগ্রহ করেন? তিনি জানালেন, ‘আমি সবরকমের বই রাখি। বাংলা, ইংরেজি। সাহিত্যের পাশাপাশি স্কুল কলেজের বই। ফেরিওয়ালারা দিয়ে যান। কিছু বই নিজেরাও জোগাড় করি। এখানে বইয়ের দাম নির্দিষ্ট কিছু থাকে না। সাধারণ গল্প, উপন্যাস কম দামে বিক্রি হলেও, দুষ্প্রাপ্য বই বেশি দামে বিক্রি হয়। কেউ কেউ দরাদরি করেন, তবে বইটি যাঁর প্রয়োজন, তিনি ঠিক নেবেন। দাম নিয়ে চিন্তা করবেন না। বিতর্কিত বইয়ের দারুণ চাহিদা। বিক্রি হয় বিখ্যাতদের বই।’
আশার কথা শোনালেন তিনি। বললেন, ‘নতুন ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এখন পুরোনো বাংলা বই কিনতে আসছে। গত কয়েক বছরে সংখ্যাটা উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়েছে। স্কুল-কলেজের বই ছাড়াও তারা কিনছে অন্যান্য বই। পাশাপাশি বয়স্ক পাঠকরা তো আছেনই। তাঁরাও কেনেন।’
সোনারপুরের বঙ্কিমনারায়ণ রায়। কলেজস্ট্রিটের ফুটপাথে পুরোনো বই বিক্রি করছেন প্রায় ৪০ বছর ধরে। কলেজে পড়তে পড়তেই মামার হাত ধরে তিনি এসেছিলেন এই জগতে। কথায় কথায় জানালেন, ‘দুই প্যাকেট পুরোনো গল্পের বই নিয়ে আমি ব্যবসা শুরু করেছিলাম। পরে প্যাকেটের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দিনে দিনে বিক্রিও হয়ে যেত। এইভাবেই শুরু। বিভিন্ন ধরনের বই আমি বিক্রি করেছি। যেমন দেশ-বিদেশের সাহিত্য, ভূত-গোয়েন্দা, কবিরাজি, জ্যোতিষ ইত্যাদি। তবে এখন পুরোনো বইয়ের বাজার আগের মতো নেই। তাই বেশি বই রাখি না। দোকান বন্ধের পর ফুটপাথেই প্যাকেটে মুড়ে রেখে যাই। ঝড়বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায় প্রচুর বই। তবু আছি এই জগতে। ভালোবেসেই আছি। রোজ আসি। বই সাজিয়ে বসি। পুরোনো বই বিক্রি করেই সংসার চালাচ্ছি, জায়গা কিনে বাড়ি করেছি, ছেলে মানুষ করেছি। আমার ছেলে ম্যাথ অনার্স। সে এই কাজ করতে চায় না। তবে আমি যতদিন পারবো, এই কাজই করবো।’
প্রায় ৮ বছর এই ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত সৌমেন সাহা। তাঁকে এই জগতে এনেছেন জ্যাঠতুতো দাদা। তিনি বিক্রি করেন মূলত বাংলা গল্প-উপন্যাস। জানালেন, ‘সব বয়সী পাঠকদের ভিড় দেখা যায় এখানে। কমবয়সী ছেলে-মেয়েদের সংখ্যা যথেষ্ট ভালো। তারা আসে, দেখে, কেনে। আমরা সকাল ১১টায় দোকান খুলি। থাকি সন্ধে ৬টা পর্যন্ত। পিছনে একটা গোডাউনে বই রেখে যাই। ভালোবাসে আমি এই কাজের সঙ্গে জড়িয়ে গেছি। শুধু বিক্রি নয়, আমি নিজে বই পড়তেও ভালোবাসি। মূলত রোমান্টিক লেখা আমার পছন্দ। বুদ্ধদেব গুহ, নিমাই ভট্টাচার্য, সুচিত্রা ভট্টাচার্যর লেখা আমার খুব ভালোলাগে। এখানে বিভিন্ন সাহিত্যিক আসেন। পুরোনো বই দেখেন, কেনেন। আমি কয়েকজনের সঙ্গে ছবিও তুলেছি। করোনার কারণে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। তবে সবাই মিলে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
বিক্রেতাদের পাশাপাশি কথা হল কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গেও। বৌবাজারের পায়েল দে পাস করেছেন এমএসসসি। নিয়মিত তিনি পুরোনো বইয়ের দোকান ঘুরে বই কেনেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি বইয়ের পাতা ওল্টাতে ওল্টাতে বললেন, ‘সবরকমের বই এখানে পাওয়া যায়। দাম তুলনামূলকভাবে অনেক কম। যে বইগুলো আউট অফ প্রিন্ট, সেই বইগুলোও এখানে পাই। দাম কিন্তু বেশি নয়। আমি দীর্ঘদিন ধরেই কিনছি। শুরু ছোটোবেলায় বাবার হাত ধরে। আজও চলছে।’
সাঁতরাগাছির সৌম্যজ্যোতি লাহিড়ী। সিটি কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-এর ছাত্র। নিয়মিত বই কেনেন পুরোনো বইয়ের দোকান ঘুরে। জানালেন, ‘পড়াশোনার বেশকিছু বই আমি এখান থেকে কিনেছি। দাম অনেক কম। এর বাইরে কিনেছি মোতি নন্দীর বই। কলেজস্ট্রিটে এলে আমি পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে যাই। ভালো লাগে।’
আরও পড়ুন: অভিষেকের বিরুদ্ধে আরও কুৎসার চক্রান্ত
অধ্যাপক সুরঞ্জন মিদ্দে। বেশকিছু বই তিনি লিখেছেন এবং সম্পাদনা করেছেন। জানালেন, ‘পুরোনো বইয়ের দোকানগুলোয় আমি বহু বছর ধরেই আসা-যাওয়া করছি। প্রচুর দুষ্প্রাপ্য বই কিনেছি। অভিজ্ঞতা ভালোই।’
বরাহনগরের শিবাজী পন্ডিত। সাহিত্যচর্চা ও পত্রিকা সম্পাদনা করেন। জানালেন, ‘আমি পুরোনো বইয়ের দোকান ঘুরে কিনি মূলত বিখ্যাত পত্র-পত্রিকার শারদীয়া সংখ্যাগুলো। ধরা যাক, বছর পাঁচেক আগে যে পত্রিকার দাম ছিল ১০০ টাকা, সেটা আমি ২০ টাকায় পেয়ে যাই। এর পাশাপাশি কিছু দুষ্প্রাপ্য বই কিনেছি। এই জগতে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা পুরোনো ৫টাকার বই দামটা মুছে ২০০টাকায় বিক্রি করেন। যাই হোক, একটু ঘুরে কিনতে পারলে কম দামে প্রচুর ভালো বই কেনা যায়।’
কলেজস্ট্রিট বইপাড়ার পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় আছে বইয়ের দোকান। বইয়ের দোকান চোখে পড়ছে অত্যাধুনিক শপিংমলগুলোতেও। সেখানে মেলে গরম কফিতে চুমুক দিয়ে বই পড়ার এবং কেনার সুযোগ। তবু রোজ জল বৃষ্টি উপেক্ষা করে সেজে ওঠে কলেজস্ট্রিট পুরোনো বইয়ের দোকানগুলো। কারণ সেখানে ঠিক এসে হাজির হন প্রকৃত বইপ্রেমীরা। চলে বেচাকেনা, ভাববিনিময়। আসলে চাল হোক বা বই, পুরোনো-র সেই বিখ্যাত প্রবাদটা তো আর মিথ্যে নয়!