নিউ ইয়র্কের এনওয়াইইউর টিশ স্কুল অফ দ্য আর্টসে পড়াশোনা করেছেন অন্বিতা ব্রহ্মভট্ট। ঘরোয়া চায়ের আসরকে সামনে রেখে তিনি তৈরি করেছেন ১৭ মিনিটের স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘ওভার আ কাপ অফ চা’ (Over a cup of chai)। ২০ জুন শুরু হবে নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২৫। সেই উৎসবে প্রদর্শিত হবে ছবিটি। তার আগে ২৩ মে, তাঁর নিজের শহর আমেদাবাদে দ্য কানোরিয়া সেন্টার ফর আর্টসে ছবির প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলেন অন্বিতা ব্রহ্মভট্ট। উপস্থিত ছিলেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশিষ্টরা। প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছেন প্রায় প্রত্যেকেই।
ছবির কেন্দ্রে রয়েছেন মা সায়রা এবং তাঁর প্রাপ্তবয়স্কা মেয়ে নিত্য। পরিচালক তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, স্মৃতির উপর নির্ভর করে তৈরি করেছেন ছবিটি। সেইসঙ্গে কাজে লাগিয়েছেন কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা। দেশ-বিদেশের নানা কবির ভাবনা থেকে প্রাণিত হয়েছেন। অন্বিতা ব্রহ্মভট্ট জানিয়েছেন, আমার মনে হয়েছিল হিন্দি সিনেমায় মা-মেয়ের গল্প খুব একটা দেখানো হয়নি। সেই কারণেই এই ছবিটা তৈরির কথা আমার মাথায় আসে। মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছবি তৈরিতে আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে। ছোট ছোট অনুভূতিগুলো আন্তরিকভাবে প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।
পুষণ কৃপলানি পরিচালিত ২০২৩-এর ছবি ‘গোল্ডফিশ’ তাঁকে বিশেষভাবে ভাবিয়েছে। এই ছবিও বলেছে নারী-জীবনের কথা। অন্বিতা ব্রহ্মভট্ট আরও বলেছেন, ‘আমিও বিভিন্ন ভূমিকায় নারীদের কীভাবে চিহ্নিত করা হয় তা খুঁজতে চেয়েছি।’
মা সায়রার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন রত্না পাঠক শাহ। মেয়ে নিত্যার চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন দালাই। দুজনেই অনবদ্য। বোনা হয়েছে একটি রবিবারের অলস বিকেলের গল্প। ছবির শুরুতেই নিত্যাকে দোলনায় বসে আপেল খেতে দেখা যায়। সেখানেই তিনি মুখোমুখি হন মায়ের। দুজনের মধ্যে শুরু হয় কথোপকথন। তাঁদের মধ্যে ভালবাসা আছে। দ্বন্দ্বও আছে। আরিয়ান নামে এক যুবকের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন নিত্যা। সেই নিয়েও মা এবং মেয়ের মধ্যে রয়েছে মৃদু সমস্যা। সায়রার সংযত এবং ঠান্ডা আচরণ উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দেয়। তিনি সংবেদনশীল কিন্তু একগুঁয়ে নিত্যার বিপরীত। আরিয়ানের চরিত্রে অভিনয় করেছেন দানেশ রাজভি। তিনি নিত্যার মা সায়রার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে আসেন। গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে চলতে থাকে তাঁদের কথাবার্তা। ছবির বেশিরভাগ অংশই রান্নাঘরে অথবা বাগানে বিকেলবেলায় ঘটে। শেষের দিকে, চা পান করার সময় সম্পর্কের ভাঁজগুলো পরিষ্কার হয়ে যায়।
অন্বিতা ব্রহ্মভট্টের ছবির অনুপ্রেরণার অন্যতম উৎস সাংবাদিক ও লেখিকা নীলাঞ্জনা ভৌমিকের বই, ‘লাইস আওয়ার মাদার্স টোল্ড আস : দ্য ইন্ডিয়ান ওম্যানস বার্ডেন’। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল বইটি। নীলাঞ্জনা ভৌমিকের ২০২৪ সালের বই ‘হাউ নট টু বি আ সুপারওম্যান’ পড়েও বিস্মিত হয়েছিলেন পরিচালক। তিনি বলেছেন, ‘এই বই দুটি আমার চোখ খুলে দিয়েছে। আমার চিন্তাভাবনাকে আরও পরিমার্জিত করতে সাহায্য করেছে। দেখেছি প্রজন্মের পর প্রজন্ম নারীরা মানসিক আঘাতের মধ্য দিয়ে গেছেন। বই দুটি আমাকে সেটা দারুণভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। আসলে আমরা প্রায়শই আমাদের মায়েদের বোঝার চেষ্টা করি না। তাঁর চাওয়া-পাওয়ার খোঁজ রাখি না। সময় এসেছে নিজেদের ভুল শুধরে নেওয়ার।’
ছবিটি দেখেছেন লেখিকা নীলাঞ্জনা ভৌমিক। তিনি জানিয়েছেন, ‘ছবিটি দেখার সময় আমার মায়ের সঙ্গে আমার নিজের সম্পর্কের কথা বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল, যা আমি আমার প্রথম বইয়ে লিখেছিলাম। আমি সবসময় তাঁকে খুশি করার চেষ্টা করেছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সফল হওয়ার চেষ্টা করা একজন মহিলা হিসাবে তাঁর সংগ্রামগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি। সেইসঙ্গে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি জোয়ারের বিরুদ্ধে তাঁর সাঁতারকাটা এবং নিজের মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়া নিয়ে তাঁর বিচিত্র উদ্যোগকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মায়েরা যে দেওয়ালগুলো নিজেদের চারপাশে তুলেছিলেন, সেগুলো ভেঙে ফেলতে হবে। এটা ঠিক, দেওয়ালগুলো তাঁদের বাঁচতে সাহায্য করেছিল। তবু ভাঙতে হবে দেয়ালগুলো। তাঁদের সঙ্গে আরও সহজ করতে হবে আমাদের সম্পর্ক।’
অন্বিতা ব্রহ্মভট্ট গত বছরের এপ্রিল মাসে এই ছবির স্ক্রিপ্ট লেখা শুরু করেছিলেন। ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করেছিলেন কাজটি। অভিনেতা এবং কলাকুশলী নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি কয়েক মাস সময় নিয়েছিল। আর্থিক সহযোগিতা করেছেন তাঁর বাবা। তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী। জানেন যে, এটা ঠিক কোনও লাভজনক উদ্যোগ নয়, যদি না কোনও ওটিটি ছবিটি কিনে নেয়।
অন্বিতা ব্রহ্মভট্টের প্রথম স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি ‘দ্য ডকুমেন্টেড ইন্ডিয়ান’ মুক্তি পেয়েছিল ২০২১ সালে। ১৫ মিনিটের ছবিটি দুই ভাইবোনের গল্প নিয়ে তৈরি। ছবিতে তিনি ২০০২ সালের গুজরাত দাঙ্গা এবং ২০১৯ সালে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের বিরুদ্ধে সংঘটিত বিক্ষোভের গল্প একত্রিত করেছিলেন।
আপাতত, এই পরিচালকের পাখির চোখ নিউ ইয়র্ক ইন্ডিয়ান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। তিনি আশাবাদী— ছবিটি তাঁকে তাঁর পরবর্তী প্রকল্পের জন্য আরও বৃহত্তর দর্শক এবং সম্ভাব্য অর্থানয়নকারী খুঁজে পেতে সাহায্য করবে।