পারিবারিক অশান্তির জের। একজন বয়স্ক মহিলাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন তাঁর ছেলে-বৌমা। অসহায় সেই মহিলা কী করবেন, কোথায় যাবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। সেই সময় তাঁকে আশ্রয় দিয়েছিলেন সাঁতরাগাছি এলাকার সহৃদয় মহিলা লিলি দত্ত। যাঁর পরিচিতি লিলিদি নামে। তখন তিনি রেলে চাকরি করতেন। পাশাপাশি স্থানীয় মেয়েদের নিয়ে চালাতেন সূচিশিল্পের স্কুল।
আরও পড়ুন: বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামোকে দরাজ সার্টিফিকেট এবার রিজার্ভ ব্যাঙ্কের
সেই বয়স্ক মহিলাকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে লিলিদেবীর মনে হয়েছিল, আশেপাশে এইরকম আরও অনেক অসহায় মহিলা আছেন। তাঁদের জন্য একটি বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করলে বেশ হয়। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে সময় লাগেনি। তাঁর একক উদ্যোগে হাওড়ার সাঁতরাগাছি জগাছা সুলতানপুরে জন্ম নেয় মহিলাদের বৃদ্ধাশ্রম ‘সুলতানপুর সংগতি সমিতি’। অনেকেই বলেন, লিলিদির বৃদ্ধাশ্রম। দিনটি ছিল ১৯৮৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর। দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে তিনটি দশক। সেই বৃদ্ধাশ্রম আজও চলছে। এই মুহূর্তে আবাসিক প্রায় ১৪ জন অসহায় বৃদ্ধা। যাঁদের বয়স আশির বেশি।
কথা হল লিলিদেবীর সঙ্গে। জানতে চাইলাম, কীভাবে চলছে এই বৃদ্ধাশ্রম? তিনি জানালেন, ‘গোড়ার কথা একটু বলি। ১৯৮৮ সালে চালু হলেও রেজিস্ট্রেশন হয় চার বছর পর, ১৯৯২ সালে। ততদিনে আশ্রমে এসে গেছেন বেশ কয়েকজন অসহায় মহিলা। তখন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে চাঁদা তুলতাম। একটাকা, দু-টাকা, যিনি যা দিতেন, হাসি মুখে নিতাম। বাকিটা দিতাম আমি একাই। ২০০৮ সালে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর যা টাকা পেয়েছিলাম, পুরোটাই দিয়েছিলাম এই বৃদ্ধাশ্রমে। তৈরি করেছিলাম ভবন।’
ব্যক্তিজীবনে লিলিদেবী দারুণ লড়াকু। কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল। পুত্রের বয়স যখন সাড়ে চার, তখন তাঁর স্বামী মারা যান। শুরু হয় একক লড়াই। তিনি জানালেন, ‘খুব কষ্ট করে মানুষ করেছি ছেলেকে। আজ সে দাঁড়িয়ে গেছে। চাকরি করছে, সংসার করছে। ওদের নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। ছেলের সমর্থন আমি সবসময় পেয়ে এসেছি।’
শুধু কি হাওড়া জেলার মহিলারাই থাকেন এই বৃদ্ধাশ্রমে? লিলিদেবী বললেন, ‘বেশিরভাগ মহিলাই হাওড়ার বিভিন্ন অঞ্চলের। তবে ঝাড়গ্রাম, কলকাতা থেকেও কেউ কেউ এসেছেন। একসময় আবাসিকের সংখ্যা ২৫ হয়ে গিয়েছিল। এখন ১৪। পাশাপাশি আছেন আরও কয়েকজন, যারা তাঁদের দেখাশোনা করেন। সবমিলিয়ে মোট ২০ জন থাকেন।’
একটা সময় লিলিদেবী নিজে রাঁধতেন, বাড়তেন। এখন আছে কাজের লোক। লিলিদেবী জানালেন, ‘আমার বয়স হয়েছে। শরীরে আছে প্রতিবন্ধকতা। ভালোভাবে হাঁটাচলা করতে পারি না। তাই রাঁধাবাড়ার দায়িত্ব দিয়েছি অন্যদের। তবে আমি সামনে দাঁড়িয়ে সমস্তকিছু দেখাশোনা করি। চার বেলা খাবার দেওয়া হয়। সকাল সাতটায় চা, নটায় জলখাবার, দুপুর সাড়ে বারোটায় লাঞ্চ, বিকেলে চা, রাতে ডিনার। সবকিছু হয় সময় মেপে। বিভিন্ন দিন বিভিন্ন পদ রান্না হয়। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। আমিষ, নিরামিষ আলাদা। যা খেতে দেওয়া হয়, সবাই হাসি মুখে খান। এটা দেখে খুব ভালো লাগে। আমাদের এখানে কারো কোনো জ্বালা নেই। ঝগড়াবিবাদ নেই। সবাই মিলেমিশে থাকেন। বয়স হয়েছে সবার। শরীর খারাপ লেগেই আছে। অসুস্থ হলে ডাক্তার দেখানো হয়। যতটা সম্ভব করার চেষ্টা করি। আসলে মায়া পড়ে গেছে মানুষগুলোর প্রতি।’
আরও পড়ুন: পৃথিবীর কক্ষপথে হাজির ওঁরা চারজন
খরচ তো কম নয়। চালান কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে লিলিদেবী জানালেন, ‘মূলত আমি একাই খরচখরচা বহন করি। যে সমস্ত মহিলা থাকেন, তাঁদের মধ্যে দু-চারজনের পরিবার সামান্য টাকা-পয়সা দেয়। বাকিরা এমনিই থাকেন। পরিবারের কেউ খোঁজ নিতেও আসেন না। টাকা দিতে পারেন না বলে আমি তো আর তাঁদের তাড়িয়ে দিতে পারি না। তবে বাইরের কিছু মানুষ সাহায্য করেন। দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। কেউ অর্থ সাহায্য করেন, কেউ বিভিন্ন জিনিসপত্র দিয়ে। তবে সেটা যথেষ্ট নয়। বৃদ্ধাশ্রমের মহিলারা কেউ বাড়ি যেতে চান না। লকডাউনের সময় কয়েকজন বাদে বেশিরভাগ মহিলা এখানেই ছিলেন। একাই তাঁদের দেখাশোনা করেছি। আমি এঁদের বলি, ভালো কোনো জায়গার সন্ধান পেলে চলে যেতে। কিন্তু কেউ আমাকে ছেড়ে যেতে চান না। আসলে অতীত ভুলে সবাই আনন্দেই আছেন। লক্ষ্মীপুজোর পাশাপাশি এখানে বিভিন্ন পুজো হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। রবীন্দ্র জয়ন্তী এবং প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎসব পালন করা হয় সাড়ম্বরে। বাইরের অনেকেই আসেন। এখানে অনেকের জন্মদিন পালন করা হয়। কাটা হয় কেক। সবাই মেতে ওঠেন। দুর্গাপুজোয় আগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে বৃদ্ধাশ্রমের মহিলাদের ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাওয়া হতো। করোনার কারণে গতবছর থেকে সে-সব বন্ধ।’
লিলিদেবী হাসিমুখে মেটান সবার আবদার। তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে কেউ ডাকেন দিদি, কেউ বলেন মা। আসলে তিনি ভালোবাসা দিয়ে আগলে রেখেছেন সবাইকে। জড়িয়ে গেছেন মায়ার বাঁধনে। বললেন, ‘আমারও তো বয়স হচ্ছে। সত্তর পেরিয়ে গেছে কবেই। শরীর সবসময় ঠিক থাকে না। জানি না কতদিন চালাতে পারব। আমার সঙ্গে আছে ঈশ্বরের আশীর্বাদ। কিছু মানুষও আছেন আমার পাশে। চাই আরও বেশি মানুষের সহযোগিতা। নিজের জন্য নয়, এই সাহায্য চাই বৃদ্ধাশ্রমের অসহায় মহিলাদের জন্য।’
কথা শেষ করেই লিলিদেবী পা বাড়ালেন রান্নাঘরের দিকে। বৃদ্ধাশ্রমের মহিলাদের খাবার সময় হয়েছে। তাঁর সঙ্গে কিছুটা সময় কাটিয়ে মনে হলো, আকাশ-হৃদয় নিয়ে লিলিদেবীদের মতো মানুষরা আছেন বলেই স্বার্থপর সমাজটা আজও পুরোপুরি অন্ধকারে তলিয়ে যায়নি।