সন্তানহীনতার জন্য অল্পবয়সিনী সারদার মনে কিঞ্চিৎ অতৃপ্তির আঁচ পেয়ে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে বলেছিলেন, একদিন এত সন্তান মাতৃ সম্বোধন করবে… সারদা (Sarada Devi) মায়ের ১৭১তম জন্মদিনে পৌঁছে (জন্ম ২২ ডিসেম্বর ১৮৫৩) সেই আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বাণীর কথা মনে পড়ল। সত্যি, আজ তিনি লক্ষ লক্ষ মানুষের হৃদয়ে জন্মজন্মান্তরের মা। তিনি সতেরও মা, অসতেরও মা; তিনি শরতেরও মা, আমজাদেরও মা। সবার মা হিসেবেই তিনি পূজিতা। পূজা হয় তাঁর সেই আটপৌরে চেহারার স্নেহ ভরপুর দৃষ্টির ছবিটি।
আজ সেই ফটোটির কথাই স্মরণ করি। শুধু ঠাকুরঘরে আবদ্ধ নয়, আরও বৃহৎ বিশ্বের সঙ্গে তার প্রতীকী যোগ। সেই কথা শোনাই।
শ্রীমতী সারা বুল ছিলেন আমেরিকার এক প্রতিপত্তিশালিনী ধনী। স্বামী বিবেকানন্দের ‘ধীরামাতা’। স্বামীজি ভারতে ফেরার পর তিনি আমেরিকায় বেদান্ত প্রচারের মূল দায়িত্ব নেন। আবার তাঁর দেওয়া ১৫ হাজার ডলার সম্বল করে বেলুড়ে তখনকার শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির এবং সন্ন্যাসীদের আবাসগৃহ নির্মাণ হয়। সেই শ্রীমতী বুল ভারতে কিছুকাল কাটিয়ে দেশে ফেরার আগে ভাবলেন, সারদা (Sarada Devi) মায়ের একটা ফটো সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন। নিজের বাড়িতে পুজো করবেন।
কিন্তু মায়ের ছবি পাওয়া যাবে কোথায়? তখনও তাঁর কোনও ফটো ওঠেনি। আর অপরিচিত ফটোগ্রাফারের সামনে তাঁকে ছবি তোলাতে রাজি করানোও মুশকিল। তাঁর অন্তঃপুরের সঙ্গিনীরা বা শ্রীরামকৃষ্ণের সন্ন্যাসী সন্তানের দল— কারও পক্ষেই তখন এমন প্রস্তাব উত্থাপন করা সম্ভব নয়। সারা ভেবেচিন্তে তাঁর স্নেহের নিবেদিতাকে ধরলেন— মায়ের আদরের খুকি। তিনিই পারবেন মা-কে রাজি করাতে। ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও এর মধ্যে নিবেদিতার সঙ্গে মায়ের এক সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। তিনি নিজে হাতে পশমের পাখা তৈরি করে নিবেদিতাকে দিয়েছেন। নিবেদিতার স্কুল উদ্বোধন করেছেন। খুকির আবদার তিনি ফেলতে পারলেন না। ‘সারা মেম’ আমেরিকায় নিয়ে গিয়ে পুজো করবেন বলে তিনি ফটো তুলতে রাজি হলেন। ১৮৯৮-এর নভেম্বরে একদিন মা এলেন বাগবাজারে নিবেদিতার ১০/২, বোসপাড়া লেনের বাড়ি।
ফটোগ্রাফার হ্যারিংটন সাহেব এলেন তাঁর যন্ত্রপাতি নিয়ে। বাঘের চামড়ার আসনে সারদামাকে (Sarada Devi) বসানো হল, দু’পাশে কয়েকটি ফুলদানি রাখা হল। নিবেদিতা মায়ের চুল, কাপড় সব ঠিকঠাক করে দিলেন যাতে তাঁর ডান হাতটি স্পষ্ট দেখা যায়, যে হাতে তিনি আশীর্বাদ করেন। সারদা মায়ের প্রথম ফটো তোলার প্রস্তুতি সারা। সাহেব ফটোগ্রাফার দেখে মা আড়ষ্ট বোধ করতে থাকেন। ক্যামেরার দিকে তাকাতে চাইছিলেন না কিছুতেই। নিচের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে তিনি ভাবস্থ হয়ে পড়েন। হ্যারিংটন আর কী করেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও, ওই অবস্থাতেই তিনি শাটার টেপেন। ছবি তোলা হয়ে গেছে বুঝতে পেরে যেন কিছুটা স্বস্তিতে মা এক পলক সামনের দিকে তাকান। আর ওস্তাদ ফটোগ্রাফার হ্যারিংটন তৎক্ষণাৎ দ্বিতীয় ছবিটি নেন।
এই দ্বিতীয় ফটোটিই সারদা মায়ের সবচেয়ে পরিচিত ছবি, যেটি আজ ঘরে ঘরে পূজিত। তাঁর বয়স তখন ৪৫। তার ১২ বছর আগে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেহান্ত ঘটেছে। আশ্চর্য সমাপতন, রামকৃষ্ণের উপবিষ্ট অবস্থার পরিচিত, পূজিত ছবিটিও ঠাকুরের ৪৫ বছর বয়সে তোলা। সারদা মায়ের এই ছবিটি প্রসঙ্গে তাঁর সেবক রাসবিহারী মহারাজ (স্বামী অরূপানন্দ) বলেছিলেন, ‘ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, যদিও তাঁর মুখ ক্যামেরার দিকেই ফেরানো, চোখদুটি যদিও খোলা, মন যেন কোথায় উধাও হয়ে গেছে।’ তাঁর কাছ থেকেই জানতে পারা যায়, শ্রীমায়ের শরীর-স্বাস্থ্য আগে আরও ভাল ছিল; কিন্তু, মায়ের কথা অনুসারে, ‘যখন ছবি ওঠায় তখন যোগীনের (স্বামী যোগানন্দ) খুব অসুখ। তার জন্য ভেবে ভেবে শরীর শুকিয়ে গিছল।’
আরও পড়ুন-ডাঙ্কি
কোনও কোনও গবেষক এই দুই ছবির ক্রম নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন। অর্থাৎ, সামনে তাকানো ছবিটিই আগে তোলা, এমন বলতে চান। সে বিতর্কে না গিয়ে সেদিন নিবেদিতার বাড়িতে আরও যে একটি ছবি তোলা হয় তার কথা বলি। সেখানে নিবেদিতা এবং শ্রীমা মুখোমুখি বসে। মা স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তাঁর ‘খুকি’র দিকে। নিবেদিতার চোখে এক তৃপ্ত, বিনীত হাসি। ৫ জানুয়ারি ১৮৯৯ উৎফুল্ল নিবেদিতা এই ফটো তোলার বৃত্তান্তের কথা মিস ম্যাকলাইডকে লিখে জানান। তাঁর সেই চিঠি থেকেই জানা যায়, এই তৃতীয় ছবিটি তুলতে বা তার নেগেটিভ বানাতে হ্যারিংটন কোনও পারিশ্রমিক নেননি।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, দীর্ঘদিন যাবৎ গবেষক মহলে ধারণা ছিল যে শ্রীমা-নিবেদিতার এই যুগ্ম ফটোটি আসল ছবি নয়, দুটি আলাদা ছবি জুড়ে বানানো। কিন্তু বিশিষ্ট আমেরিকান সাংবাদিক ও সাহিত্যিক জন ইয়েল (পরে স্বামী বিদ্যাত্মানন্দ) ১৯৫২ সালে ইংলন্ডে লর্ড আর্ল স্যান্ডউইচের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে এই ফটোটির একটি মূল কপি উদ্ধার করায় সব সংশয়ের অবসান হয়। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে বিজ্ঞান-প্রযুক্তি, প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্য, ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতা— এক বহু বিস্তৃত মেলবন্ধনের ইশারা রয়েছে এই যে ছবিতে, তার নিশ্চিত প্রামাণিকতা প্রতিষ্ঠিত হল।