বিয়ের স্ত্রী-আচার

অঘ্রান মাস পড়া মানেই বিয়ের ঢাকে কাঠি। বাড়িতে তেল, হলুদ, সিঁদুর ছোঁয়ানো ‘শ্রীশ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ’ লেখা কার্ড আসার শুরু। একটা বিয়ে জুড়ে থাকে নানান নিয়ম ও রীতি। আর থাকে স্ত্রী-আচার। বিয়ের স্ত্রী-আচারে ঘটেনি বদল। লিখছেন তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক

Must read

মঙ্গলে বসতবাটি গড়ার এই উত্তর আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে ভুবনায়নের জোয়ারে গা ভাসানোর সময়েও কিন্তু বিবাহ রীতিনীতি দিব্যি বহমান সব পরিবারেই। সে বিশ্ববিদ্যালয় পেরনো কনেই হোক বা স্কুল-কলেজের চৌকাঠে পা না দেওয়া পাত্রী। স্ত্রী-আচারের (Women’s Ritual) মান্যতা সবখানে। অঘ্রান মাস এল আর সেই সঙ্গে বেজে উঠল সানাইয়ের মধুর সুর।
বাড়িতে তেল, হলুদ, সিঁদুর ছোঁয়ানো ‘শ্রীশ্রী প্রজাপতয়ে নমঃ’ লেখা কার্ড আসার শুরু। সেই সঙ্গে শুরু হয়ে যায় হাসিমজা, হুল্লোড়। কিন্তু কেন?
আসলে স্ত্রী-আচারের মধ্যে লুকিয়ে থাকে যা কিছু শুভ সেই সব মঙ্গলময় ভাবনা। বাঙালি বিয়েতে আচার-অনুষ্ঠানের পরম্পরা তাই যুগবাহী। আর এতটাই সুগভীর বিশ্বাস যে, নিয়ম-নীতির ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলে বর-কনের অমঙ্গল ঘটবে বা শুভ অনুষ্ঠান-এর বিঘ্ন হবে। তাই এতে নিয়মের কিছু কড়াকড়ি থাকলেও প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নিয়ম-রীতির মধ্যে রয়েছে সমাজের সক্রিয় যোগদান। একটা বিয়ে মানে যেমন ডিজাইনার বেনারসি আর পাঞ্জাবি, কাস্টমাইজভ ব্লাউজ, গয়না, পার্লারে ছোটাছুটি পাশাপাশি তেমন থাকে এই সব স্ত্রী-আচার (Women’s Ritual)।
বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ার শুরুতেই শাঁখ, উলু, এরপর নিমন্ত্রণপত্রে হলুদ-সিঁদুর দেওয়া থেকে শুরু করে গঙ্গা নিমন্ত্রণ, পানখিল, বিয়ের দিনের ভোরের দধিমঙ্গল, গায়ে হলুদ, আইবুড়ো নাম খণ্ডন, বর বরণ, প্রদান, কনকাঞ্জলি সবকিছুই স্ত্রী-আচারের মধ্যেই পড়ে। এই আচার পালনের প্রথা মেনেই নবদম্পতির নতুন জীবনের পথচলা শুরু হয়।

গায়ে হলুদ
নিছক শুধু আচারই নয়, একটু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের পেছনে রয়েছে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিও। কাঁচা হলুদ প্রকৃতিগতভাবে জীবাণুনাশক। শরীরের সংক্রমণ ঠেকায়। শরীর ঠান্ডা রাখতেও সাহায্য করে। ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে তুলতে অথবা সমস্যা ঢেকে রাখতেও হলুদের জুড়ি মেলা ভার। প্রাকৃতিক উপাদান হিসেবে হলুদের ব্যবহার সুপ্রাচীন কাল থেকেই ছিল। চড়া মেকআপে ত্বকের কোনও ক্ষতি করতে দেয় না হলুদ। বিয়ের দিন বর-কনে যাতে কোনওভাবে ত্বকের সমস্যার সম্মুখীন না হয় সেই জন্য বহু যুগ ধরেই হলুদের ব্যবহার বিয়ের দিনে। এছাড়া হলুদকে খুব পবিত্র বা শুভ বলেও মানা হয়। রং হলুদ তাই বিয়ের মাঙ্গলিক হলুদ ছাড়া চলে না। মূলত এইসব কারণে যুগ যুগ ধরে হলুদকে বিয়ের অন্যতম উপকরণ হিসেবে মানা হয়। তাই বিয়ের দিনে বর এবং বরের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনেরা আগে বরের গায়ে হলুদ দিয়ে তারপর কনের গায়ে ছুঁয়ে মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের শুভ সূচনা করেন। বলা হয় এতে বর-কনের নজর লাগবে না। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানকে ঘিরে নির্ভেজাল আনন্দের অনুভূতি পরিবার- পরিজনের মধ্যে থাকে, এটাও এই সব স্ত্রী-আচারের (Women’s Ritual) আরও একটি কারণ। সম্ভবত এই বিশ্বাসই আজও এই স্ত্রী-আচার অনুষ্ঠানকে মান্যতা দিচ্ছে।

আরও পড়ুন-লাজে রাঙা হল কনে বউ গো

দধিমঙ্গল
দধিমঙ্গল। এটিও একটি স্ত্রী-আচার। পুরাণে এর উল্লেখ রয়েছে। পদ্মপুরাণে হর-পার্বতীর বিয়েতে হিমালয় পত্নী অর্থাৎ পার্বতীর মা মেনকা দধিমঙ্গল অনুষ্ঠান করেছেন এমন উল্লেখ আছে। বেহুলা-লখিন্দরের বিয়েতেও দধিমঙ্গলের কথা আছে। এছাড়া দইকে শুভ বলে মানা হয়। আর বিয়ের দিন বর-কনে সকালে খালি পেটে দই-চিঁড়ে, দই-খই খেলে তা শরীরকে ঠান্ডা ও সতেজ রাখে, এই বিশ্বাস থেকে দধিমঙ্গলের রীতি পালিত হয়ে আসছে।
স্ত্রী-আচার বিয়েবাড়িতে রাঙা ঠাম্মা, মিষ্টি দিদা, ফুল কাকিমা, বড়মারা নিজেরা ঠাট্টা-তামাশার জন্য যেমন করেন, তেমনই এর পিছনে জুড়ে থাকে বহুদিনের বিশ্বাস। কুলো সাজানো, পানখিল, চালগুঁড়ো আর রং দিয়ে শ্রী গড়া, শাঁখা পলা পরানো— সব স্ত্রী-আচারের নিয়মপালন যেমন আনন্দের এবং তেমনই দায়িত্বের।

গঙ্গা নিমন্ত্রণ
বাংলাদেশ নদীনালার দেশ। শুভ অনুষ্ঠানে কোনও কারণে যেন কোনও কোপ না পড়ে সেই মেনেই গঙ্গাকে নিমন্ত্রণ ও আশীর্বাদ নেওয়া যাতে শুভ অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে মিটে যায়। যদিও আজকের দিনে সব সময় গঙ্গায় যেতে না পারলেও স্থানীয় পুকুরে সেরে নেন এই নিয়ম। মিষ্টি দিয়ে আরতি করে অনুষ্ঠানের সুসম্পন্নতার প্রার্থনা জানান পরিবার-পরিজনেরা।
বিবাহ শব্দের অর্থ বি পূর্বক বহ্ ধাতু ঘ ঞ। বি উপসর্গের অর্থ বিশেষ, আর বহ্ ধাতুর অর্থ বহন করা। বধূ শব্দটির অর্থ যাকে বহন করে আনা হয়েছে। অর্থাৎ বিষয়টা নিয়ে দাঁড়াল এখন পুরুষের বিয়ে মানে একজন নারীকে বিশেষ রূপে বহন করার দায়বদ্ধতা স্বীকার করা।
এই বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে একজন নারীর তো প্রবল আপত্তি থাকার কথা এই বিবাহ প্রথার ওপর। কিন্তু সেরকম ঘটছে কই? ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। পাশাপাশি একথাও ঠিক যে, আমরা সমাজবদ্ধ জীব। সমাজ সংস্কারকে অস্বীকার করাও যথার্থ নয়। বিয়ের অনুষ্ঠানের আরও একটা রীতি হল সম্প্রদান। অর্থাৎ স্বত্বত্যাগপূর্বক দান। বিয়ের সম্প্রদানের একটা মন্ত্র হল— ‘‘তুয়ভ্যমহং সম্প্রদদে”
বরকে উদ্দেশ্য করে কন্যার পিতা বলছেন, ‘‘আমি আমার সালাম করা কন্যাকে দান করলাম।” এবার তাকে রক্ষণাবেক্ষণ ও ভরণপোষণের দায়িত্ব স্বামীর।
এখন কথা হল, আজকের এই উত্তর আধুনিক সময়ে দাঁড়িয়ে বেশিরভাগ নারীই কর্মরতা এবং স্ব-স্ব কর্মক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তবু বিয়ের অনুষ্ঠানে সম্প্রদানের রীতি চলছে। মেয়েরা মেনেও নিচ্ছে।
বিয়ের আরেকটি আচারের মধ্যে পড়ে কনকাঞ্জলি। এটিও স্ত্রী-আচার। কন্যা বিদায়ের সময়, বিয়ের আগে কন্যার মা-বাবার কাছে যত অন্ন ঋণ ছিল মায়ের পাতা আঁচলে একমুঠো চাল ছুঁড়ে দিয়ে ‘‘সব ঋণ শোধ করে দিলাম” বলে কনকাঞ্জলির নিয়ম পালন হয়। এটিই হল কনকাঞ্জলি। কেননা, শাস্ত্রে ঋণী ব্যক্তিকে দান নিষিদ্ধ।
যুগের প্রেক্ষিতে এই আচার বড্ড বেমানান। তবে আশার কথা এই যে, স্ত্রী-আচার বিয়েবাড়িতে মা, ঠাকুমা, জেঠিমা, দিদিমা, কাকিমারা নিজেও হা হা হি হি মজার জন্যই করেন। নির্মম আনন্দ উপভোগের মধ্যে থাকে নিয়ম-নীতির মধ্যে নৈতিকতা আর অকৃত্রিম মঙ্গলাকাঙ্ক্ষা। তখন সেখানে নারীর অবহেলা বা নারীকে কোণঠাসা বা পুরুষতান্ত্রিকতা এইসব বিষয় চোখে পড়ে না। দৈনন্দিনের একঘেয়েমির আবদ্ধ জীবনে বিয়েবাড়ির স্ত্রী-আচার এক ঝলক সুবাতাস বয়ে আনে— এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

Latest article