ফুচকাওয়ালা ও একটি আরব্য রজনী

ফুচকা তো সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। বাংলাময় ফুচকার সাম্রাজ্য। এমনকী বাংলার বাইরেও ফুচকার অভাব নেই।

Must read

পার্থপ্রতিম পাঁজা : ফুচকা তো সব জায়গাতেই পাওয়া যায়। বাংলাময় ফুচকার সাম্রাজ্য। এমনকী বাংলার বাইরেও ফুচকার অভাব নেই। তবে অবশ্য অন্য নামে, অন্য স্বাদে— পানিপুরি, গোলগাপ্পা আরও কত কী! কিন্তু জহুরা বাজারের ছক্কুলালের মতো ফুচকা কারও নয়। এমন অপূর্ব স্বাদ ভূ-ভারতে আর কারও নেই। নাম করলেই জিভে জল এসে যায়। এমনটাই মনে করে ঋ, মানে ঋতমা সেন, সাউথ পয়েন্টের ক্লাস নাইনের ছাত্রী। থাকে ওই জহুরা বাজারেরই রাজবাড়ির তিনতলায়। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রাণভরে ফুচকা না খেলে তার চলে না। দিনটাই কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে, মাকে ম্যানেজ করে প্রতিদিনের জন্য সে ফুচকার টাকার ঠিক জোগাড় করে রাখে। ছক্কুলালের ফুচকার জন্যে সে ফিদা! ছক্কুলালের জন্যেও কি? সেটা বললে একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে হয়তো। তবে একথা ঠিক যে ছক্কুর সঙ্গে কথা বলতে তার ভাল লাগে। স্কুলের বন্ধুদের মতো কথার মারপ্যাঁচ নেই। নিতান্তই সহজ-সরল লোকটাকে বিশ্বাস করে অকপটে সবকিছু বলে ফেলা যায়। এমনকী বাবা-মাকেও যে কথা বলা যায় না অনায়াসে সেসব কথা সে ছক্কুলালকে বলে। অন্যপক্ষ কী ভাবে সে তা জানে না, তবে সে কিন্তু ছক্কুলালকে বন্ধু বলেই বিশ্বাস করে। এই তো সেদিন ক্লাসের বন্ধু তৃণাকে বাঁচাতে গিয়ে ক্লাস-টিচার স্বাগতা ম্যামের কাছে রীতিমতো পানিশমেন্ট খেল ঋ, সে কথা কি আর সে বাড়িতে বাবা-মার কাছে বলেছে? ছক্কুলালের কাছে কিন্তু সবটা বলেছে। না বলে সে থাকতে পারে না যে! সব কথা শুনে ছক্কুলাল বলেছে, ‘দোস্তের জন্যে দোস্ত-ই তো ভাববে, তা না হলে কীসের দোস্তি!’
ঋ তো অবাক। ছক্কুলাল তাকে সমর্থন করছে! এ লোকটা সত্যিই তার বন্ধু। অন্য কেউ হলে অবশ্যই অন্য কথা বলতো, বাবা-মা হলে তো বটেই। তাই সে বলে, ‘তুমি কত সহজে কথাটা বললে ছক্কুলাল। বাবা-মা হলে এখনই কত রকম জ্ঞান দিতে থাকত— বন্ধুকে বাঁচাতে গিয়ে তোমার যদি ক্ষতি হয়! কেন তুমি নিজের ক্ষতি করবে?…’
‘ওনাদের ভাবনা ওনারা করবেন, কিন্তু তোমার যেটা উচিত কাজ সেটা তো তোমাকে করতেই হবে— না?’
‘এই জন্যেই তোমাকে এত ভালবাসি ছক্কুলাল। তোমার ফুচকার মতোই তোমার জবাব নেই বস।’
‘এত কথা বলবে না ফুচকা খাবে? এবার ফুচকা নরম হয়ে যাবে কিন্তু!’
‘না না, আর কথা নয়। আগে ফুচকা পরে কথা। দাও দাও ফুচকা দাও ফটাফট।’
ঋ আর কথা বাড়ায় না। ছক্কুলাল শালপাতার ঠোঙায় একটা পর একটা  ফুচকা দিতে থাকে, আর সে টপাটপ গালে পুরতে থাকে। ফুচকা তো নয় যেন অমৃত!
পরীক্ষা শেষ। এখন স্কুলে বেশ কয়েকদিনের ছুটি। একেবারে রেজাল্ট আউটের দিনই শুধু স্কুলে যেতে হবে। অধিকাংশ টিউশনি বন্ধ। যে কয়েকটা চলছে সবগুলো নিজের বাড়িতেই। সুতরাং বাইরে বেরবার কোনও অজুহাত হাতে নেই। ফলে ঋ-র হয়েছে বিপদ। বাইরে না বেরোতে পারলে সে ছক্কুলালের ফুচকা খাবে কী করে! আর ছক্কুলালের ফুচকা না খেয়েই বা সে থাকবে কী করে! এ তো মহা সমস্যা! এবার বড়ই বেকায়দায় পড়েছে ঋ।
ঋ-র বাবা কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী, অত্যন্ত  রাশভারী লোক। সমাজে যথেষ্ট মান-মর্যাদা আছে তাঁর। লোকে মান্যগণ্যও করে। শুধু পাড়াতে নয়, পুরো এলাকায়। ঋ-র মা-ও রীতিমতো কলকাতার নামী একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষিকা। অত্যন্ত আধুনিকা এবং ফ্যাশন সচেতন তিনি। তাঁদের এইসব আন-হাইজিনিক ব্যাপারস্যাপার পছন্দ করার প্রশ্নই ওঠে না। তাই কোনও অনুরোধ-উপরোধও যে চলবে না তা ভালমতোই জানে ঋ। কিন্তু সে কী করবে? ফুচকা আর ফুচকাওয়ালার জন্যে যে সে পাগল!
সেদিন রাতে একটা অনুষ্ঠান বাড়ি ছিল। ঋ, সঙ্গে তার বাবা ও মা তিনজন মিলে গিয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। বাবার বন্ধুর ছেলের বিয়ে। দারুণ করে সাজানো-গোছানো বিয়ে বাড়িতে ঢুকেই একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল ঋ-র। একটা স্টল। সেখানে স্টার্টার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে— কী আশ্চর্য ফুচকা! বাবা-মাকে ফেলে দৌড়ে গেল সে সেখানে। একজন বেশ সাজুগুজু করা লোক দক্ষ হাতে কায়দা করে একটার পর একটা ফুচকা পরিবেশন করছে। অনেকের মাঝখানে ঋ-ও থার্মোকলের বাটি হাতে ফুচকার জন্যে হাত বাড়াল। বাটিতে ফুচকা পড়তেই সে সটান মুখে পুরে দিল সেটা। তারপরেই বিপত্তি।
‘অ্যাহ্, কী বিশ্রী স্বাদ! একে ফুচকা বলে?’
ফুচকাওয়ালা তো অবাক। এই পুঁচকে মেয়েটা বলে কী! এতক্ষণে এমনটা তো কেউ তাকে বলেনি। তাই সে প্রতিবাদ করে বলে,
  ‘কী বলছ মাইজি! সোবাই তো ফুর্তি করে খাচ্ছে, মোজা পাচ্ছে। তোমার খারাপ লাগবে কেনো?’
‘আরে আসল ফুচকা এরা খেয়েছে নাকি? খেলে বুঝত ফুচকার কী স্বাদ!’
‘কী বলছো মাইজি! এতো বছর ধরে আমি ফুচকা বানাচ্ছি, বিক্রি ভি করছি, আমার ফুচকা খারাপ আছে!’
‘আছে আছে, ছক্কুলালের ফুচকা তো খাওনি, তা হলেই বুঝতে। এরাও তো খায়নি, তাই বুঝতে পারছে না। ভাবছে ফুচকার স্বাদ বুঝি এইরকমই হয়। মোটেই না।’
ফুচকাওয়ালা তো আরও অবাক। তার ফুচকাকে মেয়েটা বলছে কিনা বিশ্রী স্বাদের, আসল ফুচকা নয়! এটা একেবারে মান-সম্মানের প্রশ্ন। তাই আবার নতুন করে বেশি বেশি মশলাপাতি দিয়ে ঋ-কে ফুচকা তৈরি করে দেয় সে। কিন্তু ঋ-র তাতেও মন ভরে না। তাই সেখানেই ফুচকা পর্বের ইতি টেনে তিনতলায় বিয়ের আসরে চলে যায় সে।
ফিরতে অনেক রাত হয়। অনেকটা ক্লান্তি শরীরে। বিছানায় শুয়েই তাই ঘুমে কাদা হয়ে যায় ঋ। তারপর কখন জানি সে ঘুমের মধ্যেই বিড়বিড় করতে থাকে—
 ‘আরে লঙ্কাটা একটু বেশি করে মাখাও। আমি যে বেশি লঙ্কা পছন্দ করি সে কি ভুলে গেলে? আরেকটু বেশি করে নুন মাখাও। হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক। ঠিক করে এবার লেবুর রস মেশাও। বাহ্! এই না হলে ছক্কুলালের ফুচকা! আহাহাহা কী স্বাদ! একি, এবার ফাউ দাও। আলাদা করে তেঁতুলজল দেওয়ার কথা কি বলে দিতে হবে?’
এসব কথা শুনতে শুনতে ছক্কুলাল হেসে ফেলে। তা দেখে কপট রাগ দেখিয়ে ঋ বলে, ‘একি, তুমি মিচকে মিচকে হাসছ কেন? দেখো আমি ঠিক করে নিয়েছি, আমি তোমাকেই বিয়ে করব। লোকে ফুচকাওয়ালার বউ বলবে। তাতে কী? বিকেল হলেই তো মনের সুখে ফুচকা খেতে পারব। বাবা-মা বা অন্য কেউ কিচ্ছু বলতে পারবে না। কী মজা, না!’
পাশে শোয়া ঋ-র মা প্রথমে তো কথাগুলোর মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতে পারেন না। কিন্তু বারবার ফুচকা কথাটা আসায় একটা কিছু আন্দাজ করতে পারেন। বেশ বিরক্তি মেশানো ঝাঁঝালো গলায় তিনি বলে ওঠেন, ‘এই  ঋ, ঘুমের ঘোরে কী ফুচকা ফুচকা করছিস? তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেল?’
  ‘তুমি রাজি তো?’
‘কীসে রাজি! কী যা তা বলছিস! ঘুম থেকে ওঠ। যত্তোসব!’
এবার মেয়ের মাথাটা ভাল করে ঝাঁকিয়ে দেন ঋ-এর মা। ফলে ঋ-এর স্বপ্নের আকাশ থেকে একেবারে কাটখোট্টা কঠিন বাস্তবে অবতরণ!
রীতিমতো অনিচ্ছায় ঘুম ভেঙে উঠে ঋ ভাবে— ‘ইস, যদি সত্যিই এমনটা হত!’
অঙ্কন : শংকর বসাক

Latest article