চক্ষুদান পক্ষ

অন্ধত্বের চেয়ে অভিশাপ আর কিছু নেই। পরিসংখ্যান বলছে এই বিশ্বের প্রতি তিনজন অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে একজন ভারতীয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই দেশে চক্ষুদান নিয়ে যথেষ্ট সচেতনতার অভাব রয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে অনেকেই ওয়াকিবহাল নন। মানুষের মনের অন্ধ কুসংস্কার সরিয়ে চক্ষুদান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতেই প্রতিবছর ২৫ অগাস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পালিত হয় জাতীয় চক্ষুদান পক্ষ। লিখছেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের প্রতি তিনজন অন্ধ ব্যক্তির মধ্যে একজন ভারতীয় অর্থাৎ আনুমানিক ১৫ মিলিয়ন অন্ধ মানুষ বাস করেন ভারতবর্ষে এবং প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ অন্ধত্বের সঙ্গে লড়ছেন। কর্নিয়াল অন্ধত্ব চক্ষুদানের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ঠিক হওয়া সম্ভব। ১৯৪৮ সালে ডাঃ আর ই এস মুথিয়া ভারতে প্রথম কর্নিয়া ট্রান্সপ্লান্ট করেন এবং দেশে প্রথম চক্ষুব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের কাজ হয়। কর্নিয়া-সংক্রান্ত দৃষ্টিহীনতার সমস্যা পুরোপুরি দূর করতে প্রতি বছর কমপক্ষে ১ লক্ষ করে কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করতে হবে। কিন্তু সচেতনতার অভাব, সামাজিক বা ধর্মীয় সংরক্ষণ, ধর্মীয় কুসংস্কার ইত্যাদির নানা কারণে চক্ষুদান বিষয়টার অগ্রগতি খুবই কম। এটা নিয়ে অনেক ভুল ধারণাও রয়েছে। তাই চক্ষুদান নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২৫ অগাস্ট থেকে ৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত জাতীয় চক্ষুদান পক্ষ বা সপ্তাহ পালিত হয়। আই ব্যাঙ্ক অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া (ইবিএআই) এখন ভারতে চক্ষুদানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করে।

আরও পড়ুন-আজ বাতিল লিগের ম্যাচ

চক্ষুদান কী
অনেকেই মৃত্যুর আগেই চোখ দানের অঙ্গীকার করে রাখেন। চক্ষুদান হল কোনও মৃত মানুষের শরীর থেকে কর্নিয়া পুনরুদ্ধারের পদ্ধতি। তাহলে এখন প্রশ্ন আসতে পারে কর্নিয়া কী? বা কোন ক্ষেত্রে চক্ষুদান হয়। কর্নিয়া হল চোখের একেবারে উপরিভাগের স্বচ্ছ স্তর। এই অংশটা ঠিক ক্যামেরার লেন্সের মতো কাজ করে। ক্যামেরার লেন্সের মধ্যে দিয়ে যেভাবে আলো প্রবেশ করে, ঠিক সেভাবেই কর্নিয়ার মধ্যে দিয়ে চোখের ভিতরে আলো প্রবেশ করে। আর কোনও দুর্ঘটনা কিংবা সংক্রমণের জেরে কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাইরের আলো চোখে প্রবেশ করতে পারে না। এই অবস্থাকে ‘কর্নিয়াল ওপাসিটি’ বলা হয়। এমতাবস্থায় যদি চোখের অন্যান্য অংশ অক্ষত থাকে যেমন হয়তো দেখা গেল রেটিনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, তাহলেও কিন্তু অন্ধ হয়ে যেতে পারেন সেই ব্যক্তি। কিডনি, লিভার, হৃদযন্ত্র ইত্যাদি অঙ্গগুলো রোগীর মৃত্যুর আগেই পুনরুদ্ধার করতে হয়। কিন্তু কর্নিয়ার ক্ষেত্রে বিষয়টা তেমন নয়। কারণ রোগীর মৃত্যুর ৬ ঘণ্টা পর্যন্ত জীবিত থাকে কর্নিয়ার এন্ডোথেলিয়াম কোষগুলি। ফলে ওই সময়ের মধ্যে তা পুনরুদ্ধার করতে হয় তবে তা সহজেই ট্রান্সপ্লান্ট বা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
অন্ধত্বের বিভিন্ন কারণ
অন্ধত্বের নানা কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল রেটিনার বিচ্যুতি, টিউমার, চোখের কোনও সংক্রমণ বা প্রদাহ, ছানি, গ্লুকোমা, মাথায় আঘাত ইত্যাদি। দৃষ্টিহীন মানুষদের মধ্যে শুধু ৮-১০ শতাংশের কর্নিয়াল ওপাসিটি দেখা যায়। তাঁদেরই দৃষ্টি ফিরিয়ে আনতে দান করা চোখ ব্যবহার করা যেতে পারে। আজ অবধি, কর্নিয়া প্রতিস্থাপন ছাড়া কর্নিয়ার অন্ধত্বের অন্য কোনও সমাধান নেই।

আরও পড়ুন-ষড়যন্ত্র রুখে আজ পাল্টা লড়াইয়ের ডাক নেত্রীর

কেরাটোপ্লাস্টি
কর্নিয়া প্রতিস্থাপনকে কেরাটোপ্লাস্টি বলে। যে অপারেশনের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত কর্নিয়ার সবটা অথবা অংশবিশেষ অপসারণ করে সুস্থ দাতার কর্নিয়া টিস্যু দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়।
চোখের কোন অংশ দান করা হয়
কর্নিয়া ছাড়া চোখের যে অংশগুলো দান করা যায় সেগুলো হল—
চোখের পাতা
টিয়ারডাক্ট
আমিনিওটিক মেমব্রেন বা ঝিল্লি
চক্ষুদানের গুরুত্ব
মৃত্যুর পর চোখ পুড়িয়ে নষ্ট করা উচিত নয়। একজন ব্যক্তি চোখদান করলে দু’জন অন্ধ দৃষ্টিশক্তি পান। চক্ষুদান কর্নিয়ার অন্ধত্বে ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের তাঁদের দৃষ্টি ফিরে পেতে সাহায্য করতে পারে।
চক্ষুদান নিয়ে মিথ
অনেকেই মনে করেন যিনি চক্ষুদান করেছেন সেই ব্যক্তি মারা যাবার পর তাঁর পুরো চোখ উপড়ে বের করে ফেলা হয় কিন্তু একেবারেই তা নয় শুধুমাত্র চোখের সবচেয়ে উপরের স্তর অর্থাৎ কর্নিয়াটি মৃদুভাবে বের করে নেওয়া হয়।
চক্ষুদানের পর দাতার মুখে কোনও দাগ বা বিকৃতি থাকে না।
কারা পারবেন চক্ষুদান করতে
বয়স, লিঙ্গ, রক্তের গ্রুপ বা ধর্ম নির্বিশেষে যে কেউ
দাতা হতে পারেন।
ছানি, দীর্ঘ বা অল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি, অপারেশন করা চোখ বা সাধারণ রোগে আক্রান্ত যে-কেউ চোখ দান করতে পারেন।
উচ্চরক্তচাপ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস রয়েছে এমন ব্যক্তিও চক্ষুদান করতে পারেন।
সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এনজিওগুলিতে বিনামূল্যে চোখদানের সমস্ত সুবিধা প্রদান করা হয়।
চক্ষুদানে ইচ্ছুক ব্যক্তি আইব্যাঙ্কে নিজেদের নাম নথিভুক্ত করতে পারেন নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে।
কারা চক্ষুদানে অসমর্থ
এইচআইভি এডস, হেপাটাইটিস সি, বি, জলাতঙ্ক, টিটেনাস সেপ্টিসেমিয়া, কলেরা, লিউকেমিয়া, এনসেফেলাইটিস, মেনিনজাইটিসের মতো সংক্রামক রোগ থাকলে সেই ব্যক্তি চক্ষুদান করতে পারবেন না।
মনে রাখা জরুরি
অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে দাতা এবং গ্রহীতার ব্লাড গ্রুপ ম্যাচ করা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু কর্নিয়ার ক্ষেত্রে তার প্রয়োজন হয় না।
শুধুমাত্র কর্নিয়া অস্বচ্ছ ব্যক্তিরাই চক্ষুদানে উপকৃত হতে পারেন। রেটিনা বা অপটিক নার্ভের জন্য অন্ধত্ব এলে তাঁরা চোখদানে উপকৃত হবেন না।
ব্যক্তির মৃত্যুর ছয় ঘণ্টার মধ্যে শরীর থেকে কর্নিয়া অপসারণ করা অপরিহার্য।
মৃত্যুর পর চক্ষুদাতার দেহকে শীতল পরিবেশে রাখতে হবে। চোখ বন্ধ করা থাকবে, একটা ভিজে সুতির কাপড় চোখের উপরে রেখে, মাথার নিচে দুটি বালিশ রাখতে হবে। চোখ সংগ্রহ করতে আসার আগে এই পদ্ধতিতে রাখলে চোখ ভাল থাকবে।
দাতার শরীর থেকে অন্যান্য অঙ্গ সংগ্রহ করার জন্য অস্ত্রোপচার করতে হয়। কিন্তু কর্নিয়া সংগ্রহ করতে পারেন যে কোনও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টেকনিশিয়ান ১০ থেকে ১৫ মিনিটেই।

Latest article