ষষ্ঠী থেকে যষ্ঠী। যাত্রার মরশুম। রথের দিন শুরু হয়েছে নতুন পালার বুকিং। দুর্গাপুজো থেকেই শুরু হয়ে যাবে শো। গ্রামেগঞ্জে। রাতের পর রাত। শো হবে শহরেও। বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য রাজ্যেও। এই মুহূর্তে জোরকদমে চলছে মহরৎ এবং রিহার্সাল। মহরৎ অনুষ্ঠানে চলছে পুজো, নাটক পাঠ, গানবাজনা, নাচ। সেইসঙ্গে সংবর্ধনা প্রদান, আড্ডা, খাওয়াদাওয়া।
নন্দী কোম্পানির এবারের নতুন পালা ‘আমি রাজপথের রাজকন্যা’। সম্প্রতি দমদম পার্ক লোকনাথ মহলে হয়েছে মহরৎ। চলছে রিহার্সাল। অভিনয়ে পূবালী বসু। তিনি জানালেন, প্রায় দশ বছর যাত্রায় অভিনয় করছি। দারুণ অভিজ্ঞতা। এবার এক মানবিক গল্প নিয়ে পৌঁছব মানুষের দরবারে।
রিহার্সালের ফাঁকে কথা হল পালাকার উৎপল রায়ের সঙ্গে। জানালেন, থিয়েটার করতাম। ছবির জগতেও স্ক্রিপ্ট লিখেছি। যাত্রায় আছি ৩৫ বছর। বছরে দু-তিনটি পালা লিখি। মাঝখানে যাত্রায় শিল্পীর অভাব দেখা দিয়েছিল। এখন প্রচুর নতুন মুখ। এঁদের ভবিষ্যৎ যথেষ্ট উজ্জ্বল।
আরও পড়ুন-মাতৃত্বের কবি
তিন নতুন মুখ রাহুল ঘোষ, অভ্র চক্রবর্তী এবং রাত্রি। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই এসেছেন যাত্রাশিল্পে। রিহার্সালে তাঁরা নজর কাড়লেন। প্রচলিত গানের পাশাপাশি এবার বেশকিছু যাত্রাপালায় শোনা যাবে নতুন গান। সুরকার সুবীর চট্টোপাধ্যায় জানালেন, নিজের দলের পাশাপাশি আরও কয়েকটি দলের জন্য গান বাঁধছি। ভালই লাগছে।
কিছুদিন আগেই গালিফ স্ট্রিটের অন্নপূর্ণা ভবনে হয়েছে স্বর্ণদীপ অপেরার ‘নারী আমি খেলনা নই’ পালার মহরৎ। অভিনয়ে মিতালী চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, সব শিল্পের মতো পরিবর্তন হয়েছে যাত্রা শিল্পেও। একঝাঁক নতুন মুখ এসেছে। নিজেদের ধরে রাখতে পারলে এঁরা সাফল্য পাবেন।
এইবছর প্রায় ৯টি পালা রচনা করছেন মঞ্জিল বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি জানালেন, বর্তমানে যাত্রা দারুণ জায়গায় দাঁড়িয়ে। ব্যবসায়িক সাফল্য প্রচুর। নতুন মরশুমে ব্যবসায়িক সাফল্য যে আরও ভাল হবে, তার পূর্বাভাস এখন থেকেই পাচ্ছি। বর্তমান রাজ্য সরকার যাত্রা শিল্পের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত।
দি নিউ অগ্রগামী যাত্রা কোম্পানির এবারের পালা ‘সেই হারানো সুর’। অভিনয়ে যাত্রার হিট জুটি কাকলি চৌধুরী এবং অনল চক্রবর্তী। ২৯ বছর তাঁরা একসঙ্গে অভিনয় করছেন। অন্যান্য বছরের মতো এই বছরও তাঁদের পালার বুকিং ভালই। ২৭ অগাস্ট মহরৎ। অনল চক্রবর্তী জানালেন, এবার আমার অভিনয় জীবনের চল্লিশ বছর। নাটক লেখার কাজ চলছে। দর্শকদের উপহার দেব সম্পূর্ণ মৌলিক পালা। বিচ্ছেদ থেকে মিলন। বর্তমানে যাত্রায় যথেষ্ট ভাল কাজ হচ্ছে। আগে শো হত তুলনায় কম। এখন বেশকিছু দল বছরে ১৫০-র বেশি শো করছে। গতবার আমরাই ১৪৭টা শো করেছি। ওভার অল একটা ভাল মার্কেট তৈরি হয়েছে। এবার কয়েকটি মহরতে উপস্থিত থেকেছি। নতুন প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের যাত্রাশিল্পের প্রতি আগ্রহ দেখে ভাল লেগেছে। কয়েকজনের মধ্যে সম্ভাবনা রয়েছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ পেলে সাফল্য পাবে। যাত্রা আকাদেমির কর্মশালা থেকেও কয়েকজন নবীন শিল্পী এবার বিভিন্ন দলে যুক্ত হয়েছেন। এসেছেন আমাদের দলেও। এঁদের প্রয়োজনমতো তৈরি করে নিতে হবে।
কথা হল কাকলি চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি জানালেন, আমি এবং অনল দুজনেই এসেছি থিয়েটার থেকে। আমাদের অভিনয়ের ধারাটা অনেকটা একই রকম। মঞ্চে নাচ-গানের পাশাপাশি আবৃত্তি শোনাই। নাটকের প্রয়োজনেই কবিতা আসে। দর্শকেরা পছন্দ করেন। এই ধারাটা গ্রহণ করছেন অন্য শিল্পীরাও। এই মুহূর্তে যাত্রাশিল্পে চরম ব্যস্ততা। সময়ের মধ্যে পালা রেডি করতে হবে। আমাদের নতুন পালা নিয়ে আমরা যথেষ্ট আশাবাদী।
আরও পড়ুন-কাচের ঘরে বসেই ঢিল প্রধানমন্ত্রীর, কড়া ভাষায় তোপ তৃণমূলের
শ্রীচৈতন্য অপেরার রিহার্সাল শেষ হয়েছে কিছুদিন আগেই। এবারের নতুন পালা ‘ঘুম কেড়েছে ফুলকুমারী’। অভিনয়ে রুমা দাশগুপ্ত। তিনি জানালেন, ‘আমাদের সামাজিক পালা মানুষের মন জয় করবে। আমাকে দেখা যাবে দিদিমণির চরিত্রে। পুরোনোদের পাশাপাশি এবার দলে আছে কয়েকটি নতুন মুখ।’
এই পালার অন্যতম অভিনেতা অমিতকান্তি ঘোষ জানালেন, রিহার্সাল শেষ হয়েছে। নিজেদের মধ্যে চমৎকার বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে। আশা করি আমরা সাফল্য পাব।
ভৈরব অপেরার ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’, সন্ধ্যাদীপ অপেরার ‘সুখের ঠিকানা আজও অজানা’, রত্নদীপ অপেরার ‘একালের মহাভারত’, প্রভাস অপেরার ‘আমি ভিনদেশী বহুরূপী’, স্বর্ণাঞ্জলি অপেরার ‘এবার প্রলয় আসছে’ প্রভৃতি পালা নিয়েও তৈরি হয়েছে আগ্রহ, উন্মাদনা।
পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের সভাপতি গৌতম নন্দী জানালেন, আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ৬৫টি দল। সবই কলকাতার চিৎপুরের। নন্দকুমারে আছে প্রায় ৮০টা দল। এর বাইরে গোটা রাজ্যে আরও প্রায় ৭০টা দল আছে। এবার প্রতিটি দলেরই বুকিং খুব ভাল হয়েছে। যা ট্রেন্ড দেখছি, বেশিরভাগ দল কমপক্ষে ১৫০ শো মঞ্চস্থ করবে। কলকাতার বহু শিল্পী এখন জেলার দলে কাজ করছেন। জেলার দল থেকে উঠে আসা প্রচুর শিল্পী কাজ করছেন কলকাতায়। এই ভাবেই ঘটছে মেলবন্ধন।
পশ্চিমবঙ্গ যাত্রা সম্মেলনের সম্পাদক কনক ভট্টাচার্যর ছোট্ট বার্তা, ‘যাত্রা দেখুন। যাত্রার পাশে থাকুন।’
আর কিছুদিন পরেই গ্রামেগঞ্জে বেজে উঠবে কনসার্ট। আলো-ঝলমলে মঞ্চে নেমে পড়বেন সুসজ্জিত শিল্পীরা। দর্শকদের উপচে পড়া ভিড়ে প্রাণ পাবে যাত্রাপালা। এইভাবেই অব্যাহত থাকবে পাঁচশো বছরের প্রাচীন এই শিল্পমাধ্যমের জয়যাত্রা।