বিয়ের পোশাকের স্বকীয়তায়

বিয়ের কনে মানেই পোশাক থেকে গয়না, সবটাই এক্সক্লুসিভ। তাই দিন যতই আধুনিক হোক না বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কনেরা বিয়ের দিনে সেরা সাজটা সাজতে তাঁদের নিজস্ব ট্রাডিশনাল পোশাককেই বেছে নেন। বিভিন্ন রাজ্যের কনেদের সেই স্বকীয় সাজ পোশাক নিয়ে লিখলেন শর্মিষ্ঠা ঘোষ চক্রবর্তী

Must read

কুহুর বিয়ে সামনের মাসের ১৮তে আর রিঙ্কির বিয়ে ওই মাসেরই ২৫ তারিখে। দুই প্রিয় বন্ধু একে অন্যের বিয়েতে থাকবে না তাই আবার হয় নাকি! তাই ওরা প্ল্যান করেই বিয়ের ডেট ফেলেছে। এমনকী বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যানটাও রয়েছে একই জায়গায় দু’দিন আগে-পরে। বিয়ের সাজগোজটাও দু’জনে একসঙ্গে বসে ঠিক করে রেখেছিল। কী পরবে, কেমন সাজবে। বেনারসি না লেহেঙ্গা, সব রেডি। আসলে কুহু আর রিঙ্কি দু’জনেই কনটেম্পরারি এবং ট্রাডিশনাল দু’রকম সাজই সাজতে চেয়েছিল বিয়েতে। তাই রিসেপশনে একটু কনটেম্পরারি ট্রেন্ডি লুকের জন্য লেহেঙ্গা আর বিয়ের দিনে ট্রাডিশনাল লুকটাকে মেন্টেন করে লাল বা লালের প্যালেটের বেনারসি আর পিওর গোল্ড জুয়েলারিতে সাজবে ওরা। বাড়ির লোকেরাও আপত্তি করেনি তাতে। প্রথমে ওরা অবশ্য ভেবেছিল অন্য রাজ্যের কনেদের (wedding dresses) মতো করে সাজবে। কিন্তু বিয়ে তো শুধু অনুষ্ঠান নয়, বিয়ের একটি জাতির সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। তাই ট্রাডিশনাল শাড়ি, গয়নার কদরটাই আলাদা। তাই আর বিয়ের দিনটা এক্কেবার বাঙালি কনেই সাজবে তারা এটাই ফাইনাল।
সত্যিই তাই বিয়ের কনে যতই অন্যরকম এক্সপেরিমেন্টাল সাজ করুক না কেন, নিজস্ব সংস্কৃতির স্বকীয় সাজ, শাড়ি-গয়নার একটা অন্য মাহাত্ম্য রয়েছে, বলা যেতে পারে আলাদা সৌন্দর্য রয়েছে। যে প্রদেশের যেটা ট্রাডিশনাল ব্রাইডাল ওয়্যার বা বিয়ের পোশাক তার গুরুত্ব এবং আভিজাত্যই আলাদা। এতে কনেকে দেখতে যেমন অপরূপ লাগে তেমনই তার শিকড়, পারিবারিক সংস্কার, রুচিবোধ সবকিছু ফুটে ওঠে সুচারু ভাবে।

নাউওয়ারি ও পৈঠানি শাড়ি (মহারাষ্ট্র)
মারাঠি কনে মানেই গাঢ় রঙের মার্জিত অথচ জমকালো বিয়ের সাজ। মারাঠাদের ঐতিহ্যবাহী বিয়ের পোশাকে থাকে রাজ্যের ইতিহাস আর সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। মারাঠি কনে তার বিয়েতে ন’গজের একটি বিশেষ কাজের শাড়ি পরেন যার নাম নাউওয়ারি শাড়ি। নাউওয়ারি শাড়ি পরার রীতি এমন যে প্রাচীন মারাঠা রানিরা যখন যুদ্ধে যেতেন তখন অনায়াসে এই শাড়ি পরেই ঘোড়ায় চড়তে পারতেন। সিল্ক আর সুতির মিশ্রণে তৈরি এই শাড়ির কালার কম্বিনেশন খুব ভাইব্রান্ট হয়। গাঢ় সবুজ, লাল, হলুদ, নীল— সব রঙের হয়। তার মধ্যে থাকে ফুলেল নকশা। মহারাষ্ট্রীয়ান বিয়ের আর একটি ট্রাডিশনাল শাড়ি হল পৈঠানি। ওই রাজ্যে পৈঠানি থেকে আসা এই শাড়িতে রাজারাজড়ারা সোনা, রুপোর সুতোও ব্যবহার করতেন। শালু শাড়িও বিয়েতে পরেন মারাঠি কনে। হালকা শালু শাড়ির ওপর খুব ভারী জমাট কাজ করা থাকে। এর সঙ্গে মারাঠি কনেকে পরতেই হয় নাথ আর সবুজ কাঁচের চুড়ি যাকে পাটলিয়া বা চুড়া বলা হয়।

পানেতর ও ঘাটচোলা শাড়ি (গুজরাত)
দেশের অন্যতম শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির স্ত্রী নীতা আম্বানি ছেলের বিয়েতে গুজরাতের ট্রাডিশনাল লাল ঘাটচোলা শাড়ি (wedding dresses) পরে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু নীতা নন, আম্বানি পরিবারে স্ত্রীরা সকলেই ঘাটচোলা পরেছিলেন। আম্বানি-বধূ রাধিকা তাঁর বিয়ের দিন পরেছিলেন গুজরাতের ট্রাডিশনাল বিয়ের কনের পোশাক পানেতর। তার সেই জারদৌসি কাজ করা জমকালো পানেতর লেহেঙ্গা চোলি ছিল আবু জানি সন্দীপ খোসলার ডিজাইন করা। পানেতর শাড়িও যেমন হয় শাড়ি স্টাইল লেহেঙ্গাও হয়। সাধারণত অফ হোয়াইট আর লালের কম্বিনেশনে হয় এই পানেতর শাড়ি। অন্যদিকে ঘাটচোলারও মূল জমিটা সাদা বা অফহোয়াইট হয় কম্বিনেশনে থাকে গাঢ় রঙের কনট্রাস্ট। ইদানীং গাঢ়রঙা ঘাটচোলাও দেখতে পাওয়া যায়।
এর সঙ্গে গুজরাতি কনে পরেন ট্রাডিশনাল কাকা মোতি নেকলেস, চোকার, চন্দন হার, বোরলা বা রাখদি (মাং টিকা), কান্দোরা (সোনার কোমরবন্ধ), হাতফুল (ব্রেসলেট) ইত্যাদি।

মেখলা চাদর (অসম)
অসমিয়ারা সিল্কের খুব ভক্ত। বিশেষ করে অহমিয়া কনেরা (wedding dresses)। পিওর অসম সিল্কের কদর সারা ভারতে রয়েছে। অসমিয়া কনে বিয়ের দিন পরেন তাঁদের বিশেষ ট্রাডিশনাল ব্রাইডাল ওয়্যার মেখলা চাদর। অসমিয়া ভাষায় মেখেলা বলা হয়। দুটো আলাদা আলাদা বস্ত্রখণ্ড যা শাড়ির মতো করে পরেন তাঁরা। ওপরের অংশকে বলে সাদর আর নিচেরটা রিহা। সেই মেখলা চাদর জুড়ে থাকে তাঁদের ট্রাডিশনাল মুগার কাজ। বিয়ের কনের মেখলার অফহোয়াইট আর গোল্ডেন কম্বিনেশনেই হয়। পিওর মুগার কাজের সেই বিয়ের শাড়ি দেখলে মন ভরে যায়। এর সঙ্গে কনের গলায় থাকে হার্ট শেপের ট্রাডিশনাল পেনডেন্ট যাকে বলে ডুগ-ডুগি, ঢোলবিরি নেকলেস এবং থুরিয়া (কানের গয়না) হাতে পরে খারু।

লেহেঙ্গা, চোলি (রাজস্থান)
রাজস্থানি বিয়ের কনের ঐতিহ্যবাহী পোশাক হল লেহেঙ্গা বা ঘাগরা চোলি। রাজস্থানি বিয়ের এই ট্রাডিশনাল পোশাক এখন সমস্ত রাজ্যের কনেদের প্রিয় পোশাক হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বাঙালি কনেরা প্রায় প্রত্যেকেই বিয়ের একটা দিন লেহেঙ্গা পরবেনই। এটাই ট্রেন্ড। শুধু বিয়ের কনে নয়, যে কোনও উৎসব অনুষ্ঠানে লেহেঙ্গা, চোলি আধুনিক নারী পছন্দের তালিকার এক নম্বরে। খুব ভারী কাজের হয় বিয়ের লেহেঙ্গা, চোলি। জারদৌসি থেকে মিরর ওয়র্ক, এমব্রয়ডারি, জাকার্ড, জামেভার— কী কাজ থাকে না লেহেঙ্গায়। সোনার এবং রুপোর সুতো দিয়ে কাজ করার রীতি রয়েছে রাজস্থানি ট্র্যাডিশনাল ব্রাইডাল ওয়্যারে। এর সঙ্গে কনে পরেন ট্র্যাডিশনাল রাজস্থানি পোলকি, থেওয়া, কুন্দনের নেকপিস বা আধ, রানিহার বাজুবন্ধ, নাথনি, পঞ্চা (ব্রেসলেট) মাথাপট্টি, শিসফুল-সহ আরও অনেক গয়না।

আরও পড়ুন-খাকি : দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার

কাঞ্চিপুরম সিল্ক (কেরল )
দক্ষিণ ভারতীয় কনে মানেই হেভি মেটিরিয়াল, রিচ সিল্ক সঙ্গে ঠাস জরির এবং সুতোর কাজ। জাকার্ড, গোটাপট্টি, জারদৌসি কাজ করা বা টিপিক্যাল সাউথ ইন্ডিয়ান ট্রাডিশনাল মোটিফের ভারী জরির কিজের কাঞ্জিপুরম সিল্ক শাড়ি। সাধারণ ঐতিহ্য অনুসারে এই শাড়ি ৬-৯ গজ লম্বা হয়। কখনও উজ্জ্বল রঙে কম্বিনেশনের পরেন কনে আবার কখনও সোনালি, অফহোয়াইটের কম্বিনেশনেও দক্ষিণ ভারতীয় কনেকে দেখতে পাওয়া যায়। অনেক কাঞ্চিপুরম সিল্কের আসল সোনার সুতোর কাজের পাড়ও বসানো থাকে। কনে বংশপরম্পরায় সোনা এবং পাথরের গয়না পরেন। যার মধ্যে অন্যতম হল ভানকি (বাজু) ওড্ডিয়ানাম (কোমরবন্ধ), ঝুমকা, কাসু মালা (সোনার কয়েনের লম্বাহার), পুথালি (নাকফুল), এছাড়া টেম্পল জুয়েলারিও পরেন দক্ষিণের বিয়ের কনেরা। দক্ষিণ ভারতীয়দের মধ্যে বাঙালিদের মতোই পিওর গোল্ড অর্নামেন্ট বিয়েতে পরার চল রয়েছে।

সালোয়ার, কামিজ ও শরারা (পাঞ্জাব)
পাঞ্জাবি কনের ট্র্যাডিশনাল বিয়ের পোশাক ঢোলা সালোয়ার, শর্ট কামিজ এবং সঙ্গে খুব ভারী কাজের চুন্নি বা ওড়না। পুরো পোশাকটিই ভাইব্রান্ট লুকের হয় জমকালো এবং ঘন স্টোন, মিরর, জারদৌসি কাজের বা ফুলকারি কাজের এমব্রয়ডারি করা থাকে। ফুলকারি পাঞ্জাবিদের ট্রাডিশনাল এবং পপুলার আর্ট ওয়র্ক। এ ছাড়া পাঞ্জাবি কনেরা গরারা এবং শরারা দুটোই পরেন নিজের বিয়েতে। এগুলো অনেকটাই লেহেঙ্গার মতো দেখতে হলেও ঠিক লেহেঙ্গা নয়, মাঝখানটা জোড়া থাকে প্যান্টের মতো খুব ফ্লেয়ারি হয়। সঙ্গে থাকে লং চোলি কোমর পর্যন্ত এবং জমকালো ওড়না। এতটাই ভারী হয় এই পোশাকে হাঁটা মুশকিল। তবে পাঞ্জাবিদের মধ্যে বিয়েতে লেহেঙ্গা চোলি পরার কলও খুব বেশি রয়েছে। এমন গর্জাস লুকের সঙ্গে কনে পরেন পাঞ্জাবের ট্রাডিশনাল বিয়ের গয়না যেমন পিপল পাত্তি(নেকপিস), কঙ্গন, জুড়া, মাঙ্গটিকা, নাথ ও আরও অনেক কিছু। সব গয়নাই হয় সোনা এবং পাথরের কম্বিনেশনে। কুন্দন এবং পোলকি, সেমি প্রেশাস এবং প্রেশাস স্টোনের ট্রাডিশনাল ডিজাইনই বেশি থাকে পাঞ্জাবি কনের গয়নাতে।

Latest article