বাম জমানায় গণহত্যা, মরিচঝাঁপির অজানা কাহিনি

পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে গত শতকের সাতের দশকের সারা রাজ্য জুড়ে রক্তপাত, খুন-জখমের ঘটনা সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। রক্তস্নাত স্মৃতির অন্যতম মরিচঝাঁপির গণহত্যা। প্রথম বামফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু দীর্ঘ সাড়ে ৩৪ বছর রাজ্যে ক্ষমতায় ছিলেন। এইসময়ে রক্তস্নাত দিনের কথা আজও মানুষ ভোলেনি। লিখছেন নির্মল বিশ্বাস

Must read

১৭৭৭ সালে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসে বামফ্রন্ট সরকার। মুখ্যমন্ত্রী হলেন জ্যোতি বসু। ওই সময়ের বছর দুই পরেই অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে ঘটেছিল মরিচঝাঁপির মতো দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। এই মরিচঝাঁপি হচ্ছে সুন্দরবন অঞ্চলের একটি ম্যানগ্রোভ দ্বীপ। এই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মর্মান্তিক নরহত্যার ইতিহাস।

আরও পড়ুন-ছবি অপব্যবহারে জঘন্য নোংরামির কড়া জবাব চলবে, ফাঁস কুৎসাকারীর নেপথ্যকাহিনি

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ থেকে যেমন এদেশে এসেছিলেন, তেমনই সংখ্যালঘু মানুষের একটা বড় অংশ এদেশ থেকে ওপারের পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছে। এইভাবে সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল দেশভাগের পর প্রায় এক দশকের বেশি সময় ধরেই।
পূর্ববঙ্গের উচ্চশিক্ষিত মহল খুব সহজেই কলকাতা বা তার লাগোয়া জায়গায় বসতি গড়ে নিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হল, নিম্নবর্গীয় অশিক্ষিত হিন্দুদের নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববঙ্গ থেকে এদেশে আসার পর তাঁদের ঠাঁই হয় ওড়িশার মালকানগিরি-সহ নানা জেলায়, তেমনি আবার মধ্যপ্রদেশ (বর্তমান ছত্তিশগড়) মানা ক্যাম্প, পাখানজোড়ের মতো প্রত্যন্ত দণ্ডকারণ্যের পাহাড়ি জঙ্গলমহল অঞ্চলগুলিতে তাঁরা থাকতে লাগলেন। প্রথমে দিকে প্রচণ্ড গরমে তাঁবুর ঘরে দুর্বিষহ জীবন কাটছিল তাঁদের।
পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রস সরকার তখন। বামপন্থীরা তখন বিরোধী আসনে। সেই সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের নিয়ে অনেক আক্ষেপ করে গলা ফাটিয়েছেন। রাজনৈতিক মহলের মতে, তখন পশ্চিমবঙ্গেের উদ্বাস্তুদের সমর্থন আদায়ের জন্য বামপন্থীরা কুম্ভীরাশ্রু ঝরিয়েছেন। বামপন্থীরা ক্ষমতায় থাকার সময় জ্যোতি বসু নিজে ওপার বাংলা থেকে আগত ছিন্নমূলদের নাগরিক-সহ সর্বপ্রকার সুযোগে সুবিধা দেবার জন্য নিজেই কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দিয়ে ছিলেন। সেই সূত্রে বামফ্রন্ট সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাম চট্টোপাধ্যায় রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার আসার পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে বর্তমান ছত্তিশগড় রাজ্যের দণ্ডকারণ্য অঞ্চলের ছিন্নমূলদের শিবিরে গিয়ে দেখা করে কথা বলেন এবং তাঁদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে এখানকার সমস্ত বাঙালি ছিন্নমূলদের বাংলার সুন্দরবন অঞ্চলে স্থায়ীভাবে তাঁদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছিন্নমূল সম্প্রদায়ের নেতা সতীশ মণ্ডলের হাত ধরে কুমিরমারি, সাতজেলিয়া, ছোট মোল্লাখালি, কালিদাসপুর হয়ে দলে দলে উদ্বাস্তুরা মরিচঝাঁপিতে চলে আসতে থাকেন। এরপর তাঁরা বিশাল দ্বীপের জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে রাতারাতি গড়ে উঠতে থাকে খড়বিচালির ছাউনি অসংখ্য মাটির ঘর। একে একে গড়ে ওঠে পাঠশালা, মুদি দোকান ঘর, কামারশালা, বাগান, পানীয় জলের টিউবওয়েলও বসানো হয়েছে। নদীর জল যাতে ঢুকতে না পারে সেজন্য এলাকা মাটি উঁচু করে বাঁধও দেওয়া হয়েছে।
আদতে বামফ্রন্টের জ্যোতি বসু-র সরকার নিম্নবর্গীয় ছিন্নমূল হিন্দুদের বাংলায় ঠাঁই দিতে রাজি ছিলেন না। এটা বুঝতে পেরেছেন উদ্বাস্তুরা। আর কোনও উপায় না দেখে দণ্ডকারণ্য থেকে আসা উদ্বাস্তুরা সিদ্ধান্ত নিলেন ‘উদ্বাস্তু উন্নয়ন সমিতি’ গঠনের। এই সমিতির পক্ষ থেকে কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠালেন রাজ্য সরকারের কাছে। তখন রাজ্য সরকার এই নিম্নবর্গীয় উদ্বাস্তুদের সুন্দরবন মরিচঝাঁপি দ্বীপে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন।

আরও পড়ুন-জয়েন্ট এন্ট্রান্স অ্যাডভান্স: বাংলার মেয়ে হল দেশের সেরা, দেবদত্তাকে শুভেচ্ছা মুখ্যমন্ত্রীর

মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই তাঁরা তাঁদের নিজেদের খরচে জঙ্গল কেটে বসতি স্থাপন করতে থাকেন। বামফ্রন্ট সরকার ভাবলেন এতগুলো মানুষের দায় নিতে হবে? এই ভয় থেকেই সেদিন সরকার হঠাৎ উদ্বাস্তুদের সমর্থনের নীতি থেকে পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে দাঁড়িয়ে গেলেন। বুঝতেই পারেননি এতদিনে কত মানুষের আগমন ঘটেছে। তাই একদিনে মরিচঝাঁপির ৬০ হাজার মানুষকে ভাতে মারার জন্য কয়েক হাজার পুলিশের সঙ্গে পার্টির ক্যাডার বাহিনী লঞ্চ নিয়ে গোটি এলাকা ঘিরে ফেলে শুরু হয় অর্থনৈতিক অবরোধ। ফলে দখলদার উদ্বাস্তুরা সন্তান-সন্ততি নিয়ে খিদের জ্বালায় দ্বীপ ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে চেষ্টা করেন। টানা ৬ দিন সেই অবরোধের জেরে মরিচঝাঁপির বহু পুরুষ, নারী ও শিশুরা দ্বীপের বাইরে বেরতে পারেনি।
বামফ্রন্ট সরকার দেখল এতে খুব একটা লাভ হয়নি। এই ঘটনা কলকাতা হাইকোর্টের নজরে আসে। তৎক্ষণাৎ হাইকোর্ট অবরোধ তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেয় রাজ্য সরকারকে। ওই নির্দেশে আরও বলা হয়, উদ্বাস্তুদের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। তখনকার মতো বামফ্রন্ট সরকার পিছু হটতে বাধ্য হলেন। মনে মনে সরকার আরও নৃশংস হয়ে ওঠে। হাইকোর্টের নির্দেশ পালনের আগেই একদিন রাতের অন্ধকারে আতর্কিতে পুলিশ, মিলিটারি আর ক্যাডার লেলিয়ে দিয়ে গোটা দ্বীপ ঘিরে শুরু হয় যায় নারকীয় অত্যাচার।
উদ্বাস্তুরা নিজরা বাঁচতে গণ-প্রতিরোধ তৈরি করেন। তির আর বল্লম ছুঁড়তে থাকেন। রাইফেল আর বন্দুকের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেনি উদ্বাস্তুরা। পরবর্তীকালে ওই অভিযানে অংশগ্রহণকারী প্রাক্তন এক পুলিশ আধিকারিকের কাছ থেকে জানা যায়, সেদিন পুলিশকে আগে থেকে তৈরি হয়েই নামানো হয়েছিল রাতের অন্ধকারে অভিযানে। অবশ্য উদ্বাস্তুদের তরফ থেকে বিষাক্ত তির ও বল্লম ছোঁড়া হয়েছিল পুলিশকে লক্ষ্য করে। ফলে, স্বাভাবিকভাবে পুলিশকে গুলি চালাতে হয়েছিল। তবে এসব আজ প্রমাণ করা মুশকিল। কারণ, এ-বিষয়টি দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার কুমিরমারির তখনকার আরএসপি (বামফ্রন্ট শরিক) নেতা ও অঞ্চল প্রধান প্রফুল্ল মণ্ডল। তিনি তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে ওই রাতের রক্তাক্ত ঘটনার কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। ঘটনার পরদিন সকালে তিনি দ্বীপে গিয়ে দেখেছেন, আগুনে পুড়ে যাওয়া বহু ঘর-বাড়ি আর চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আধাপোড়া অসংখ্য মানুষের লাশ। পরবর্তী কালে অবশ্য এই প্রফুল্ল মণ্ডল দল বদল করে সিপিএম দলে যোগ দেন। পরবর্তীতে এই ঘটনার বিষয়ে প্রফুল্লবাবুর কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল। মানবতার দিক থেকে ওই রাতের পুলিশের অপারেশন ভুল না ঠিক? তিনি এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার গোসবার প্রাক্তন বিধায়ক চিত্ত মণ্ডল (সিপিএম) তিনি ওই ঘটনা সম্পর্কে পুরো অবগত ছিলেন। তিনি জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক। তবে ওদের চলে যাবার জন্য অনেকবার বলা হয়েছিল। শরণার্থীরা কথা শোনেননি। বরং ওরা লড়াই চালাবার জন্য বল্লম, তির, দা, ওরা তৈরি করেছিল ব্যবহারের জন্য। আর পুরো জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। এই মানুষদের বসবাস করতে দিলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব হারিয়ে যেত।

আরও পড়ুন-পিকেআর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক, মালয়েশিয়ায় সর্বদলীয় টিমের সঙ্গে সফরে অভিষেক

এসএউসিআই দলের স্থানীয় নেতা বিকাশ শাসমল জানিয়েছেন, ‘এত বড় গণহত্যা এর আগে কোথাও হয়নি।’ আর একজন প্রবীণ ঠাকুরদাস মণ্ডল জানিয়েছেন, প্রায় ৫০ বছর আগে এই বাংলার মাটিতে স্বাধীন ভাবে বাঁচার আশায় সুদূর দণ্ডকারণ্য থেকে উদ্বাস্তুরা এখানকার জঙ্গলে এসে ঠাঁই নিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের বাঁচতে দেওয়া হয়নি। প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর নির্দেশে পুলিশ, মিলিটারি ও ক্যাডার দিয়ে কতগুলো ভূমিহীন ক্ষুধার্ত মানুষকে গুলি করে মেরে লাশ গোপন করার জন্য নদীর জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল।
নিঃসহায় উদ্বাস্তুদের তাড়াতে গুলি চালায় বামফ্রন্টের পুলিশ। দেখা যায়, এই ঘটনায় সিপিএম কর্মীরাও সেদিন হিংস্র ভূমিকা নিয়েছিল। খাদ্য ও জলসঙ্কট, তার ওপর পুলিশি অত্যাচার আর রাইফেলের গুলিতে কয়েকশো মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল সেদিন। এরপরেও যাঁরা বেঁচেছিলেন, তাঁরা জীবন হাতে করে ফিরে গিয়েছিলেন দণ্ডকারণ্যের সেই জঙ্গলমহলে।

Latest article