আরও একবার ফাঁস হয়ে গেল মোদির মিথ্যাচার। আরও একবার বোঝা গেল এই গেরুয়া সরকারের ওপর মানুষের অনাস্থা কোথায় পৌঁছেছে।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে প্রথমবার ক্ষমতায় আসার সময় নরেন্দ্র মোদির অন্যতম ভরসা ছিল যুব সমাজ। গেরুয়া তরফে দাবি করা হয়, পাঁচ বছর পরের ভোটেও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া অন্য কোথাও সেই ভোটব্যাঙ্ক ফেল করেনি। কারণ, যুব সমাজকে সামনে রেখে নানাবিধ গালভরা প্রতিশ্রুতি।
আরও পড়ুন-নাগপুরে আজ প্রথম ম্যাচ, নজর সেই বিরাট-রোহিতেই
অবশেষে মোহভঙ্গ হয়েছে। তার প্রমাণও মিলেছে। চব্বিশের নির্বাচন। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে জোটের ভরসাতেই তৃতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এবং ক্ষমতায় ফিরেই ২ কোটি ৯০ লক্ষ কর্মসংস্থানের ঘোষণা। তাতেও কি আস্থা ফিরেছে যুব সমাজের? সংসদে কেন্দ্রই পরিসংখ্যান দিয়ে স্বীকার করেছে, পিএম ইন্টার্নশিপ স্কিমে প্রায় ৩৩ হাজার আবেদনকারী ‘অফার’ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এবং সেই প্রত্যাখ্যান সংঘটিত হয়েছে ডবল ইঞ্জিন রাজ্যে। উত্তরপ্রদেশে ৪,২১৯ জন, হরিয়ানায় ৩,০৮৯, গুজরাতে ২,১৮৬, মধ্যপ্রদেশে ২,৮৫৯ জন ‘অফার’ ফিরিয়েছেন। এই চারটিই কিন্তু ডবল ইঞ্জিন রাজ্য।
২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের সাধারণ বাজেটে পিএম-ইন্টার্নশিপ স্কিমের ঘোষণা করেছিল কেন্দ্র। দাবি করেছিল, পাঁচ বছরে দেশের এক কোটি যুবক ৫০০টি সংস্থা-প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণের সুযোগ পাবে। এক বছরের ইন্টার্নশিপে মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা। শর্ত কী? এই স্কিমে আবেদনকারীর বয়স হতে হবে ২১ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ, দেশের যুব সমাজই এই কর্মসূচির ভরকেন্দ্র। মঙ্গলবার রাজ্যসভায় পিএম-ইন্টার্নশিপ স্কিম নিয়ে লিখিত প্রশ্ন করেন সিপিএম এমপি ভি শিবদাসন। লিখিত জবাবে কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী হরিশ মালহোত্রা জানিয়েছেন, এই প্রকল্পের অধীনে ৬০ হাজার ৮৬৬ জন আবেদনকারীকে মোট ৮২ হাজার ৭৭টি ইন্টার্নশিপ ‘অফার’ দিয়েছিল বিভিন্ন সংস্থা-প্রতিষ্ঠান। তাঁদের মধ্যে ২৮ হাজার ১৪১ জন সেই ‘অফার’ গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ মন্ত্রী যা বলতে চাননি—প্রধানমন্ত্রী ইন্টার্নশিপ স্কিমে ‘অফার’ প্রত্যাখ্যান করেছেন ৩২ হাজার ৭২৫ জন। উল্লিখিত হিসেব গত ২৯ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দেওয়া হয়েছে। কোন কোন সংস্থা থেকে অফার গিয়েছে? সেইসব সংস্থার বহর কতটা? উত্তর মেলেনি। লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে ‘দায়সারা’ অফার দেওয়া হয়েছে। সেই কারণেই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে নতুন প্রজন্ম। অস্বীকার করার জায়গা নেই।
আরও পড়ুন-গাড়িতে ধাক্কা, ক্ষিপ্ত দ্রাবিড়
একটি লিখিত জবাবে মন্ত্রক জানিয়েছে, এই সংক্রান্ত পাইলট প্রোজেক্ট শুরু হয়েছে গত ৩ অক্টোবর থেকে।প্রথম পর্বে প্রায় ২ লক্ষ জন আবেদন করেছিলেন। যোগ্যতা-সাপেক্ষে তাঁদের মধ্যে থেকেই ৬০ হাজার ৮৬৬ জন আবেদনকারীকে ‘অফার’ দেওয়া হয়েছিল। এই কর্মসূচির নির্দেশিকামতো একজন আবেদনকারী সর্বোচ্চ দুটো ‘অফার’ পেতে পারেন। মন্ত্রকের রাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, পাইলট প্রোজেক্টের দ্বিতীয় পর্ব গত ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে। তাতেও আস্থা ফিরবে বলে মনে হয় না। নির্মলা সীতারামন তো বলেই ফেলেছেন, এটি কোনও চাকরি নয়। এটি একপ্রকার এক্সপোজার।
যে দল এই মিথ্যাচারিতা চালায় স্বচ্ছন্দে, সেই দল কোন মুখে এই রাজ্যে কর্মসংস্থান নিয়ে এত কথা বলে?
গত জুলাইয়ে, তৃতীয় মোদি সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করার সময় অর্থমন্ত্রী জোর দিয়েছিলেন যুবসমাজের কর্মসংস্থান এবং দক্ষতা বৃদ্ধির উপরে। প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত একটি প্যাকেজের অন্তর্গত পাঁচটি প্রকল্প ঘোষণা করে পাঁচ বছরে দুই লক্ষ কোটি টাকার বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়। অর্থমন্ত্রী দাবি করেন যে, এই প্যাকেজের মাধ্যমে পাঁচ বছরে চার কোটি যুবক-যুবতীর জন্য চাকরি এবং ইন্টার্নশিপের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে। এবছরের বাজেট-বক্তৃতায় কিন্তু সেই প্যাকেজের কোনও উল্লেখই নেই। অর্থাৎ, মোদি কোনওদিনই এই পিএম ইন্টার্নশিপ নিয়ে সিরিয়াস ছিলেন না।
আরও পড়ুন-গাড়িতে ধাক্কা, ক্ষিপ্ত দ্রাবিড়
গতবারের বাজেট-ঘোষণা কতখানি বাস্তবায়িত হল, সেই দলিলে বলা হয়েছে যে, কেন্দ্রীয় শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রক বণিকসভা সিআইআই-এর সঙ্গে লগ্নি এবং কর্মসংস্থান সংক্রান্ত একাধিক বৈঠক করেছে; এবং ‘এমপ্লয়মেন্ট লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ প্রকল্পের একটি খসড়া ক্যাবিনেট নোট ‘চূড়ান্তকরণের স্তরে আছে’।
চলতি অর্থবর্ষে মোট সরকারি ব্যয় বাজেট-ঘোষণার তুলনায় ১ লক্ষ কোটি টাকার বেশি ছাঁটা হয়েছে, সরকারি মূলধনি বিনিয়োগ ছাঁটা হয়েছে ৯২,০০০ কোটি টাকার বেশি। কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন, নগরোন্নয়ন, কৃষি, শিক্ষা, খাদ্য, শক্তি, পরিবহণ এবং স্বাস্থ্য দফতরের চলতি বছরের বাজেট-বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে জল জীবন মিশন-এর ২০২৪-২৫’এর বরাদ্দে ছাঁটা হয়েছে ৪৭,০০০ কোটি টাকা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ছাঁটা হয়েছে ৩৮,০০০ কোটি টাকা। একশো দিনের কাজের প্রকল্পের বাজেট-বরাদ্দে গত বছর থেকেই কাটছাঁট শুরু হয়েছে। চলতি অর্থবর্ষে কেন্দ্রীয় সরকারের মূলধনি বিনিয়োগ এবং জনকল্যাণ খাতে ব্যয়বরাদ্দে এই কাটছাঁটের নেতিবাচক প্রভাব বেসরকারি বিনিয়োগ এবং ব্যক্তিগত ভোগব্যয়ের উপরে পড়তে বাধ্য, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে।
কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একশো দিনের কাজের কর্মীদের গড় দৈনিক মজুরি ২০১৯-২০’তে ছিল ২০০ টাকা, সেটা ২০২৪-২৫’এ এসে দাঁড়িয়েছে ২৫২ টাকায়। অথচ কৃষিকাজে অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ঘোষিত জাতীয় ন্যূনতম মজুরি এখন দৈনিক ৪৫২ টাকা। আয়করদাতাদের দেওয়া ১ লক্ষ কোটি টাকার ছাড়ের একটা ভগ্নাংশও যদি একশো দিনের কাজের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রামোন্নয়ন খাতে ব্যয়বরাদ্দ বাড়ানো যেত, সেক্ষেত্রে দেশের বাজারে ভোগব্যয়ের চাহিদা অনেক বড় পরিমাণে বৃদ্ধি পেত।
কিন্তু সেকথা এই বধির গেরুয়া পার্টিকে কে বোঝাবে? সর্বশেষ অর্থনৈতিক সমীক্ষায় দেখানো হয়েছে, কীভাবে শেয়ার বাজারের সূচক নিফটি-র তালিকাভুক্ত শীর্ষ ৫০০ সংস্থার কর-পরবর্তী মোট মুনাফা ২০১৯-২০ সালে ৪.৩২ লক্ষ কোটি টাকা (দেশের জিডিপির ২.১%) থেকে চার বছরে তিন গুণের বেশি বেড়ে ২০২৩-২৪’এ হয়েছে ১৪.১২ লক্ষ কোটি টাকা (জিডিপির ৪.৮%)। ২০১৯-এর সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী কর্পোরেট করের হার এক ধাক্কায় কমিয়ে দেওয়াতেই বৃহৎ কর্পোরেট সংস্থাগুলি এই বিপুল মুনাফা করতে পেরেছে। অথচ, কর্পোরেট ক্ষেত্রে কর্মীদের মাইনে বৃদ্ধির হার মুনাফা বৃদ্ধির তুলনায় অনেক কম। গত চার-পাঁচ বছরে মুনাফার এই বিপুল বৃদ্ধি কিন্তু বর্ধিত বা কর্মসংস্থানে পরিণত হয়নি। বরং, শেয়ার বাজারের সূচকগুলি অতি দ্রুত ঊর্ধ্বগামী হয়েছে।
তাই জানতে ইচ্ছে করে, এই সরকার কাদের প্রতি দায়বদ্ধ?