তিনটি কৃষি-কালাকানুন প্রত্যাহৃত। ক্ষমা চাইছেন কৃষি-নিধনকারী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি। ইনি সেই প্রধানমন্ত্রী, যিনি একবারও কৃষক আন্দোলনের জায়গায় সশরীরে যাননি। তাই মৌখিকভাবে তিনটি কৃষি বিল প্রত্যাহৃত হলেও সংসদে যতক্ষণ না বিষয়টা অনুমোদিত হচ্ছে ততক্ষণ না আঁচালে বিশ্বাস নেই। লিখছেন পূর্ণেন্দু বসু
আজ দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিনটি কৃষি-আইন বাতিলের কথা ঘোষণা করেছেন। আইনগুলি বাতিলের দাবিতে এক বছর যাবৎ এক দৃঢ়বদ্ধ কৃষক আন্দোলন চলছিল রাজধানী দিল্লির বর্ডার অঞ্চলগুলিতে। সেই কৃষক আন্দোলনের জয় হল। নরেন্দ্র মোদি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। কেন এই ক্ষমা চাওয়া? কী তাঁর অপরাধ, তা কিন্তু স্পষ্ট হল না। সামনে পার্লামেন্ট অধিবেশন। কৃষকরা দিল্লি যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আন্দোলনের সমর্থনে দেশ জুড়ে জনমত গড়ে উঠছিল।
আরও পড়ুন-রানি কাহিনি…
সামনে উত্তরপ্রদেশ, পাঞ্জাব-সহ কয়েকটি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। পশ্চিমবঙ্গে পরাজিত হয়েছে বিজেপি। এই পরিপ্রেক্ষিতে চাপ বাড়ছিল নরেন্দ্র মোদির উপর। তাঁর জনপ্রিয়তা কমছিল দ্রুত তালে। কৃষক আন্দোলনের চাপ সামাল দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রী ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ নয় বলেই মনে হয়েছে।
সঠিকভাবেই তিনটি কৃষি আইন কৃষক বিরোধী ছিল। প্রথম আইনটি ছিল— মান্ডি তুলে দেওয়ার আইন। এর সরকারি নাম ছিল— কৃষিজাত পণ্য, বাজার এবং বাণিজ্য (সংবর্ধন এবং সরলীকরণ) আইন ২০২০। এর উদ্দেশ্য ছিল সরকারি মান্ডি-ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে শুকিয়ে মারা। যাতে সরকার ফসল কেনার দায় থেকে মুক্তি পায়। আর এর মাধ্যমে বেসরকারি মান্ডির মালিক ও তাদের দালাল ও কমিশন এজেন্টরা লাভবান হয়। এতে ক্ষতি সরকারি মান্ডির উপর নির্ভরশীল কৃষক ও আড়তদারদের— বিশেষভাবে বলা যায়, সংবিধান অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার কৃষি ও কৃষি-মান্ডির বিষয়ে আইন তৈরি করতে পারে না।
এই অধিকার কেবল রাজ্য সরকারেরই আছে। কৃষক-মান্ডি ব্যবস্থা এই আইনের বলে বেসরকারি মান্ডিগুলিতে প্রথম প্রথম অল্প-বেশি দাম দেওয়া হবে। সরকারি মান্ডি উঠে যাবে। তারপর বেসরকারি মালিকরা কৃষকদের যেমন খুশি লুটবে। ফড়ে-ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হবে।
দ্বিতীয় আইনটি ছিল, কৃষককে কৃষিদাসে পরিণত করার আইন। এর সরকারি নাম ছিল— কৃষি (সশক্তিকরণ ও সংরক্ষণ) মূল্য নিশ্চয়তা এবং কৃষিসেবা চুক্তি আইন ২০২০।
এটা ছিল কৃষিজমি মালিকানার ঊর্ধ্বসীমা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কোম্পানিগুলোকে বিপুল পরিমাণ জমি নিয়ে চাষ করানোর রাস্তা খুলে দেওয়া। এতে লাভ আদানি-আম্বানির মতো বড় কোম্পানিগুলির। এতে লোকসান সহজ-সরল গরিব কষৃকদের। এই আইনবলে চুক্তিবদ্ধ হবে কৃষক। কোম্পানি ঠিক করবে, কৃষকের কোন ফসল, কেমন গুণমানের হবে এবং কী দামে তারা কৃষকদের কাছ থেকে কিনবে। বিবাদের ক্ষেত্র মধ্যস্থতা করবে এসডিএম বা কালেক্টর।
আরও পড়ুন-দূরদর্শনের চার কন্যা
এই আইন ও তার মারপ্যাঁচ কৃষকরা বুঝতেই পারবেন না। বেশি ক্ষমতা থাকবে কোম্পানিগুলির হাতে। তথ্য থাকবে তাদের কাছে। ভাল উকিল থাকবে। বেশি ক্ষমতা থাকবে। লোকসানের সম্ভাবনা থাকলে কোম্পানি চুক্তি থেকে হাত ধুয়ে ফেলবে। চুক্তিচাষ কৃষক ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। কোম্পানি যে টাকা খরচ করবে, সেটা তো তারা উশুল করবে। ফলে কোম্পানি কৃষককে তাঁর জমি-ঘর-বাড়ি সবই বেচতে বাধ্য করবে। চুক্তি হবে দামি ফসলের জন্য। ফলে খাদ্য নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। কৃষক জমির অধিকার থেকে নানাভাবে বঞ্চিত হবে।
তৃতীয় আইনটি আরও মারাত্মক। অত্যাবশ্যক পণ্য আইনে পণ্য মজুতের সীমা তুলে দেওয়া হয়। এর ফলে কৃষিপণ্যের মজুতদারিরও রাস্তা খুলে দেওয়া হয়েছিল। এতে জনজীবন ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হত। একচেটিয়া ব্যবসার রমরমা হত আর আমরা অধিকমূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয়ে বাধ্য হতাম।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর উদ্যোগে উচ্চশিক্ষার দুয়ার খুলল পাহাড়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়
এই আইনগুলি দেশের পক্ষে অত্যন্ত বিপজ্জনক ছিল। কৃষক আন্দোলনের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল— ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের বিষয়ে কৃষককে আইনি নিশ্চয়তা প্রদান করা।
সংক্ষেপে আইনগুলির বিষয় উল্লেখ করে কৃষক আন্দোলনের বিষয়ে আরও কিছু কথা বলা দরকার।
এই কৃষক আন্দোলন জনবিরোধী কৃষি আইনগুলিকে বাতিল করার মূল দাবিতে আবর্তিত ছিল। আইনের কোনও খুচরো সংশোধনের প্রস্তাব এই আন্দোলন প্রত্যাহার করেছে। আন্দোলনের দাবি, কৃষক সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ গড়ে তোলা ও যৌথ নেতৃত্বের গণতান্ত্রিক কর্মপদ্ধতি, নারীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, ক্রমশই জনসমর্থনপুষ্ট হয়ে ওঠার কার্যক্রম এই আন্দোলনকে শক্তিশালী করেছে। আন্দোলনের গণচরিত্র বজায় রেখে যেভাবে আন্দোলন পরিচালিত হয়েছে প্রকৃত অর্থ ছিল কঠিন একটি প্রক্রিয়া। গণ পঞ্চায়েতের প্রক্রিয়াটি ছিল প্রশংসাযোগ্য।
এই আন্দোলনের সঙ্গে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিবিড় সংযোগ ছিল। তিনি এই আন্দোলনকে নিঃশর্ত সমর্থন শুধু জানাননি, দলের এমপিদের আন্দোলনস্থলে পাঠিয়েছিলেন।
আরও পড়ুন-মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে ওভারব্রিজ
কৃষক আন্দোলনের চাপে কেন্দ্রীয় সরকার নতি স্বীকার করল। নরেন্দ্র মোদির ক্ষমাপ্রার্থনা তাঁর স্বভাব-বিরুদ্ধ। সেটাও দেখাল কৃষক আন্দোলন।
এক ঐতিহাসিক লড়াই। এক ঐতিহাসিক জয়। আন্দোলনকারী কৃষকদের অভিনন্দন, এটা কৃষকদের জয়। গণতন্ত্রের জয়। গণ-আন্দোলনের জয়। আর কেন্দ্রীয় শাসকদের দম্ভ ও অহঙ্কারের পরাজয়। যাঁরা এই আন্দোলনকে নকশালবাদী, সন্ত্রাসবাদী, দেশদ্রোহী, আন্দোলনজীবী বলে আপমান করেছিলেন— আজ তাঁদের দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হচ্ছে। এটাই ইতিহাসের পরিহাস।