অভিধানগুলাে (Dictionary) সব অকাজের হয়ে গেল। এখন চারদিকের সময়টাই বোধহয় এরকম। চেনা শব্দও পরিচিত অর্থ ঝেড়ে ফেলে একেবারে অন্যরকম। ভাষার যে প্রবহমানতার গুণে শ্বশুর শব্দের আদি অর্থ ‘দ্রুত ভক্ষণকারী ব্যক্তি’ থেকে পরিবর্তিত হয়ে ‘পতি বা পত্নীর পিতা পিতৃস্থানীয় ব্যক্তি’তে পরিণত হয়।
যেমন ধরা যাক ‘মর্মাঘাত’ শব্দটা। কোনও কারণে মনোলোকে আঘাত পেলে মর্মাঘাত পাওয়াটা মনস্তত্ত্বসম্মত অবস্থা। জাকিয়া জাফরি যখন শীর্ষ আদালতের রায় জানলেন তখন তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন। তাঁর অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করতে গিয়ে ‘মর্মাঘাত’ শব্দটা যথোপযুক্ত হবে, এমন একটা ধারণা ছিল আমার। তাঁর স্বামীকে তিনি চোখের সামনে নিহত হতে দেখেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতার কারণেই ‘মর্মাঘাত’ কথাটি তাঁর ক্ষেত্রে একেবারে সঠিক হবে, এমন একটা ধারণা ছিল আমার। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাক্রম আমাকে বুঝিয়ে ছেড়েছে, এই মর্মাঘাত শব্দটি আর যা-ই হোক জাকিয়া জাফরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। জাকিয়া জাফরি যে তাঁর স্বামীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে যে মামলা দায়ের করেছিলেন, সেটির রায়দান সূত্রে শীর্ষ আদালত জানিয়েছে, যাঁরা জাকিয়া জাফরির পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন তাঁরা কার্যত দেশদ্রোহী। নানাভাবে উচ্চপদে আসীন ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কুৎসা ছড়ানোর কাজে তাঁরা নিয়োজিত। কার্যত, তাঁরা ষড়যন্ত্রকারী। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী, শীর্ষস্তরে আসীন কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী।
তা-ই যদি হয়, তবে জাকিয়া জাফরি যা যা করেছেন, যেগুলো দেখে আমাদের মনে হয়েছিল ‘মর্মাঘাত’ কথাটি ওঁর ক্ষেত্রে মানানসই, সেগুলো আসলে নাটক। ‘মর্মাঘাত’-এর অভিব্যক্তি আসলে ‘মঞ্চাভিনয়’। ‘Trauma’ আদতে ‘drama’।
আরও পড়ুন-বিশ্ব গণতন্ত্র দিবস : জেনে নিন কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
এই ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার আগেই সামনে চলে এল বিলকিস বানো কাণ্ড। গণধর্ষণের শিকার হওয়া এবং চোখের সামনে শিশুসন্তানের নিহত হওয়ার দৃশ্য নিঃসন্দেহে তাঁর পক্ষে ‘মর্মাঘাত’।
কিন্তু না! ঘটনাক্রম বুঝিয়ে ছাড়ল, ওই শব্দটি বিলকিসের ক্ষেত্রেও যথোপযুক্ত নয়। শুনতে পেলাম, আসল ঘটনা মোটেও ‘মর্মাঘাত’ করার মতো কিছু নয়। আর তেমনটা নয় বলেই অভিযুক্তরা সব অমৃত মহোৎসবের পুণ্যলগ্নে জেল থেকে ছাড়া পেল। তাঁদের অভিনন্দন জানানো হল, সংবর্ধনা জানানো হল। সেই সঙ্গে স্পষ্ট বলে দেওয়া হল, যেহেতু ওঁরা ব্রাহ্মণ সেহেতু ওঁদের সংস্কার বোধ আছে। ওঁরা কোনওমতেই অভিযুক্ত সাব্যস্ত হওয়ার মতো কোনও কাজ করতেই পারেন না। বিলকিস যাঁদের চিরকাল কয়েদখানায় দেখতে চেয়েছিলেন সেইসব ধর্ষক অবাধে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এই দৃশ্য দেখলে যে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাতটা তাঁকে সইতে হল, সেটিকে আমাদের মনে হয়েছিল ‘মর্মাঘাত’। পরবর্তী ঘটনাক্রম এক্ষেত্রেও বুঝিয়ে ছাড়ল, বিষয়টা মোটেই ‘মর্মাঘাত’ লাগার মতো ব্যাপার নয়। সংস্কারী ব্রাহ্মণরা এমন কোনও কার্য কদাচ করতেই পারেন না যাতে কেউ মর্মাঘাত পায়, তাই, এক্ষেত্রে শব্দটি প্রায়োগ-তাৎপর্য খুঁজে পেল না।
অভিধান (Dictionary) উলটে দেখলাম, ‘মর্মাঘাত’ মানে হল ‘মর্মস্থলে বা হৃদয়ে আঘাত’। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘trauma’। প্রচণ্ড পীড়াদায়ক কোনও ঘটনার পরিণামে মানসিক আঘাতকে বলা হয় মর্মাঘাত।
যে দুটি ক্ষেত্রে এই শব্দটি সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয়েছিল, দুটি ক্ষেত্রেই দেখা গেল মর্মাঘাত লাগার মতো কোনও ঘটনাই ঘটেনি। জাকিয়া জাফরির ক্ষেত্রে পুরোটাই মিথ্যাচার আর বিলকিস বানোর ক্ষেত্রে মর্মাঘাত বাঞ্ছনীয় নয়। অতএব ‘মর্মাঘাত’ আভিধানিক অর্থ অনুযায়ী উল্লিখিত দুটি ক্ষেত্রেই যথোপযুক্ত নয়। ‘মর্মাঘাত’ মানে বদলে যাচ্ছে। এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
মোদি-শাসন, গেরুয়া জমানা বুঝিয়ে দিয়েছে ক্ষমতাশালী রাজনীতিকরা গৃহ সহায়কের ওপর নির্যাতন চালালে বছরের পর বছর ধরে এই অপকর্মটি করলেও, মর্মাঘাত লাগার মতো কোনও কারণ পরিলক্ষিত হবে না।
এই জমানা টের পাইয়ে দিল ক্ষমতাশালী নেতার ছেলে ভিড়ের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে লোক মেরে ফেলুক কিংবা প্রকাশ্য সমাবেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজনের রক্তপানের আওয়াজ উঠলে, কিংবা সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিলে, মর্মাঘাত লাগার মতো কোনও কারণ পরিলক্ষিত হবে না।
এখন মর্মাঘাত লাগে অন্য কারণে।
হিতাহিত জ্ঞানশূন্য উদারপন্থীরা যদি রাষ্ট্রশক্তির নির্যাতনের শিকারদের পাশে দাঁড়ায় তবে তা মর্মাঘাত লাগার মতো ঘটনা। এখন মর্মাঘাত লাগে যখন পরিযায়ী শ্রমিকরা হাঁটতে হাঁটতে মরে গেলে তাদের জন্য কেউ সোচ্চার হয়। এখন মর্মাঘাতের কারণ হয় হিন্দি-হিন্দুত্ব বিরোধী কোনও স্লোগান উঠলে। এখন যদি কেউ সমালোচিত হয় মিথ্যা পরিবেশনের জন্য, তখন মর্মাঘাত লাগে সমালোচনার শিকারের।
বিষয়টা কেবল ‘মর্মাঘাত’ নয়। বিষয়টা কেবল একটি মাত্র শব্দকেন্দ্রিক নয়। এরকম আরও শব্দ ঝটপট অর্থ বদলে ফেলছে।
যেমন স্বাধীনতা সংগ্রামী কথাটি। ১৫ অগাস্টে যে সকল মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর তালিকা লালকেল্লা থেকে শ্রুত হল, সেটাতে জওহরলাল নেহরুর নাম নেই দেখে মনে হল ওই শব্দটার মানেও বদলে গিয়েছে। সুভাষচন্দ্র বসু যখন ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদের প্রতীক না হয়ে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে একই বন্ধনীতে ধরা পড়েন, তখন মনে হয় ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটির বুঝি অর্থ বদলে গেল। এতদিন জেনে এসেছি সংসদ এমন একটা জায়গা যেখানে সবাই জনগণের হয়ে কথা বলতে পারে। কিন্তু যখন দেখি বিরোধী পক্ষের ২৭ জন সাংসদ স্রেফ প্রতিবাদ করার জন্য বরখাস্ত হয়ে গেল, তখন টের পাই সংসদের অর্থ বোধ হয় বদলে গেছে, ‘দারিদ্র’, ‘মুদ্রাস্ফীতি’, ‘বেকারত্ব’ শব্দগুলো যখন আর বেদনার উদ্রেক করে না তখন বুঝতে পারি ওই শব্দগুলোর অর্থও বদলে গিয়েছে।
এই বদল যত না ভাবায় তার চেয়ে বেশি ভয় ধরায়।