ভারতের সংবিধান যাকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে, সেই ভারতের আজকের বাস্তবতা ক্রমশই সেই ধারণার বিপরীতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের আমলে রাষ্ট্র এবং ধর্মের মাঝখানের বিভাজনরেখা ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে। এই রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ‘ওয়াকফ সম্পত্তি’ নিয়ে সাম্প্রতিক আইনগত পদক্ষেপ ও বিতর্ক শুধুমাত্র একটি প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক ইস্যু নয়—এটি ভারতের মুসলিম সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় অধিকারে হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ধারাবাহিক মুসলিমবিরোধী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।
আরও পড়ুন-পার্কিনসনস
ইসলামি আইন অনুযায়ী, ‘ওয়াকফ’ হল এক প্রকার ধর্মীয় দান, যেখানে কেউ নিজের সম্পদ চিরতরে আল্লাহর নামে উৎসর্গ করেন সমাজের কল্যাণে ব্যবহারের জন্য— বিশেষ করে দরিদ্র, এতিম, মসজিদ, মাদ্রাসা, এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠানসমূহে। এই দান ব্যক্তিগত মালিকানার বাইরের একটি কাঠামো তৈরি করে, যার প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা নির্ধারিত হয় বিশেষ ধর্মীয় ও সামাজিক নীতির ভিত্তিতে। ভারতে প্রায় ৬ লক্ষ একর ওয়াকফ সম্পত্তি রয়েছে, যার আর্থিক মূল্য ১১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বলে মনে করা হয়। এত বিপুল পরিমাণ সম্পত্তিকে ঘিরে রাষ্ট্রের আগ্রহ, এবং এর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় হস্তক্ষেপ যে নিছক স্বচ্ছতার প্রশ্ন নয়, বরং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসাব, তা একেবারে অযৌক্তিক নয়।
২০১৪ সাল থেকে যেভাবে বিজেপি সরকার মুসলিমদের ঘিরে নানান বিতর্কিত আইন ও নীতিমালা চাপিয়ে দিচ্ছে, ওয়াকফ বিলও সেই ধারারই আরেকটি পর্ব। সিএএ-এনআরসি থেকে শুরু করে তিন তালাক বিল, কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ, হিজাব ইস্যু, মাদ্রাসা বন্ধকরণ, এবং গণপিটুনি কিংবা বুলডোজার সংস্কৃতির আমদানি— সবই মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও নাগরিক অধিকার খর্ব করার স্পষ্ট লক্ষণ বহন করে।
ওয়াকফ বোর্ডের ওপর সরকারের অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ আরোপের এই উদ্যোগকে মোদি সরকার “স্বচ্ছতা” এবং “দুর্নীতি দমন”-এর মোড়কে পেশ করলেও বাস্তবতা হল— এটি একটি স্বায়ত্তশাসিত ধর্মীয় ব্যবস্থাকে কার্যত রাষ্ট্রায়ত্ত করে নেওয়ার চেষ্টা। প্রশ্ন ওঠে, হিন্দু দেবোত্তর বোর্ড, গুরুদ্বারা ব্যবস্থাপনা কমিটি বা চার্চের সম্পত্তির বেলায় কি একইরকম রাষ্ট্রীয় নজরদারি আরোপ করা হয়েছে?
অথচ ওয়াকফ সম্পত্তিকে সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে সংখ্যার জোরে সংসদের উভয় কক্ষে ওয়াকফ বিল পাশ করিয়ে নিল। এখন প্রশ্ন উঠে যায়: এর পেছনের উদ্দেশ্য কি কেবল প্রশাসনিক দক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, নাকি এর আড়ালে লুকিয়ে আছে অন্য রাজনৈতিক হিসাব? নতুন বিল অনুযায়ী ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতা সীমিত করা, সরকারের অধিক হস্তক্ষেপের সুযোগ রাখা এবং বোর্ডের ওপর তদারকি বাড়ানো হয়েছে। সংখ্যালঘু সমাজের অনেকের আশঙ্কা, এর ফলে সরকার এই ধর্মীয় সম্পদকে ব্যবহার করতে পারে রাজনৈতিকভাবে সুবিধা নেওয়ার জন্য— অথবা আরও খারাপ হলে, নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য।
আরও পড়ুন-জমে উঠেছে সাহিত্য উৎসব
নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্ব ভারতীয় জনতা পার্টির মতো হিন্দুত্ববাদী দল কখনোই ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলে না, বরং ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাজনৈতিক মেরুকরণ করে, তারাই আজ সংখ্যালঘুদের জন্য ‘উন্নয়ন’ পরিকল্পনার কথা বলছে। বাস্তবে যে রাষ্ট্র ক্ষমতা ধর্মীয় পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, মসজিদ বা আজানের বিষয়েও নিয়ম চাপিয়ে দেয়, যে রাষ্ট্রে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার নয় বরং সংকোচনের প্রবণতা দেখা যায়, সেই মোদি সরকার সংখ্যালঘুদের কল্যাণে কতটা আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যুক্তিসঙ্গত। মুসলিম সম্প্রদায় বারবার দেখেছে— তাদের সুরক্ষা, আস্থা ও নাগরিক অধিকার হুমকির মুখে পড়েছে নানা রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ফলে। এই পরিস্থিতিতে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে এমন আইন আরও গভীর সন্দেহ ও হতাশা তৈরি করে।
ভারতীয় সংসদে আজ মুসলিম প্রতিনিধিত্ব ঐতিহাসিকভাবে সর্বনিম্ন পর্যায়ে— প্রায় ১৪% জনসংখ্যার বিপরীতে লোকসভায় মুসলিম সাংসদ মাত্র ৪-৫%। লোকসভায় ২৪১ জন সাংসদের একজনও মুসলিম নন। দেশের কোনও রাজ্যের কোনও বিধানসভায় বিজেপির টিকিটে জেতা একজনও মুসলিম নারী বিধায়ক নেই। বিজেপির মন্ত্রিসভায় তো প্রায়ই কোনও মুসলিম সদস্যই থাকেন না। সংখ্যালঘুদের স্বর যখন সংসদে প্রতিফলিত হয় না, তখন তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া একপ্রকার ‘উপরি সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া’-র মতো হয়ে দাঁড়ায়। এটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ অবস্থায় সংখ্যালঘুদের জীবনযাপন, সম্পত্তি, শিক্ষা বা ধর্মীয় অধিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাদের অন্তর্ভুক্তি না থাকা মানে একটি অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আইন প্রণয়ন।
আরও পড়ুন-মদ্যপ পরিচালকের গাড়িতে পিষে মৃত্যু, চুপ কেন টলিউডের বিপ্লবীরা?
বর্তমান ভারতের রাজনৈতিক ভাষ্য এমনভাবে রূপান্তরিত হয়েছে, যেখানে মুসলিমদের জন্য কোনও কল্যাণমূলক পরিকল্পনা বা দাবি করলে তাকে “তোষণ” বলা হয়, আবার রাষ্ট্রের নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেই সেটি “রাষ্ট্রদ্রোহ” বলে দেগে দেওয়া হয়। এই ধরনের দমনমূলক পরিবেশ একদিকে যেমন মুসলিম সমাজকে চুপ করিয়ে রাখার চেষ্টা, তেমনি বৃহত্তর নাগরিক সমাজকেও আত্মরক্ষামূলক নীরবতায় বাধ্য করছে। মোদি সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কৌশল হল “মাইক্রো-টার্গেটিং”— সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জনমত তৈরির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোটব্যাংক সংহত করা। ধর্মীয় বিদ্বেষ, ইতিহাস পুনর্লিখন, মসজিদ-মন্দির বিতর্ক, হিজাব নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি এজেন্ডা বারবার প্রমাণ করেছে যে বিজেপি সরকার ধর্মীয় বিভাজনকেই রাজনৈতিক পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। এর মধ্যেই ওয়াকফ সম্পত্তি ইস্যুটিও একটি নতুন স্তর যোগ করেছে, যেখানে ‘উন্নয়ন’ বা ‘দুর্নীতিরোধ’ শব্দগুলো কার্যত একটি রাজনৈতিক কৌশল মাত্র। এমন এক বাস্তবতায় ওয়াকফ বিল একটি আইনগত পরিবর্তনের চেয়ে অনেক বেশি— এটি এক সামাজিক মনোভাব, এক রাজনৈতিক মানসিকতার প্রতিফলন। যেখানে ধর্মের নামে শাসন চলে, সেখানে সংখ্যালঘুদের ওপর আস্থা রাখা, তাদের সম্পদ ও সংস্কৃতি রক্ষা করা কেবল আইন নয়, এক নৈতিক দায়িত্ব। রাষ্ট্র যদি সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে আন্তরিক হয়, তবে তা হবে সংলাপের মাধ্যমে, তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে, তাদের নেতৃত্বকেই সম্মান জানিয়ে। অন্যথায়, সব উন্নয়নের ভাষ্য হয়ে উঠবে কেবল প্রহসন।
ওয়াকফ বিতর্কের মধ্য দিয়ে যেটা স্পষ্ট হচ্ছে তা হল, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায় ক্রমাগত সাংবিধানিক অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সামাজিক মর্যাদা হারাচ্ছে। সরকার যেভাবে একতরফাভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিচ্ছে, তাতে মুসলিমদের ওপর রাষ্ট্রের বিশ্বাসহীনতা ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাবই স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ভারত বহু ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে গঠিত এক মোহাবিষ্ট বাস্তবতা। ভারতের আত্মা হল তার বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সাংবিধানিক শাসন। এই আত্মাকে রক্ষা করতে হলে কেবল সংবিধান মেনে চললেই হবে না— প্রয়োজন এক অন্তর্মুখী রাষ্ট্রনৈতিক বিবেক। সংখ্যালঘুদের উন্নয়ন মানে তাদের সম্পত্তি দখল নয়, বরং তাদের স্বাধীন মত, নেতৃত্ব ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানানো। ওয়াকফ বিতর্ক সেই সহিষ্ণুতার সামনে এক গুরুতর প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে। এই প্রশ্নের উত্তর কেবল আইন নয়, মানসিকতা দিয়েই দিতে হবে— আর সেই মানসিকতা হওয়া উচিত ধর্মনিরপেক্ষ, মানবিক এবং ন্যায়ভিত্তিক। সরকার যদি সত্যিই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে বিশ্বাসী হয়, তবে তা হতে হবে সংলাপ, অংশগ্রহণ ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে— not unilateral political control under the guise of reform.