দুষ্টের ছলের অভাব হয় না

লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপির ভরাডুবির পর প্রথমে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে উত্তরবঙ্গকে যুক্ত করার আর্জি। তারপর গ্রেটার কোচবিহার রাজ্যের জন্য সওয়াল। আর এবার সরাসরি লোকসভায় বাংলা-বিহারের মুসলিম প্রভাবিত পাঁচটি জেলা নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠনের দাবি। মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে এই তিন ঘটনায় একটা বিষয় স্পষ্ট— তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসেই বঙ্গভঙ্গের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। মোদ্দা কথা একটাই। ভোটে জিতে বাংলা দখল করতে না পারলে ক্ষতি নেই, পদ্মের বাংলা চাই-ই চাই। লিখছেন অনির্বাণ ধর

Must read

পর পর ঘটে গেল ঘটনাগুলো। বুধবার স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে উত্তরবঙ্গকে নিজের উত্তর-পূর্ব উন্নয়ন মন্ত্রকের অধীনে আনার প্রস্তাব দেন কেন্দ্রের হাফপ্যান্টমন্ত্রী অবলাকান্ত মজুমদার।
সেই বিতর্কের রেশ কাটতে না কাটতে বৃহস্পতিবার বঙ্গ বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ অনন্ত মহারাজ দাবি করলেন, ‘পৃথক গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য চাই।’
তার পর সবাইকে ছাপিয়ে ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিজেপি এমপি নিশিকান্ত দুবে লোকসভার জিরো আওয়ারে স্পষ্ট ভাষায় বললেন, ‘বাংলার মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বিহারের কিসানগঞ্জ, আরারিয়া এবং কাটিহার জেলা নিয়ে হোক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। নইলে হিন্দু আর থাকবে না।’ ওই পাঁচ জেলায় এনআরসির দাবিও তুলেছেন নিশিকান্ত।

আরও পড়ুন-পুজোর আগে বর্ষায় দুর্দশাগ্রস্ত মৃৎশিল্পীদের বিকল্প জায়গা দেবে পুরসভা

এই আবহে মুর্শিদাবাদের বিধায়ক গৌরীশঙ্কর ঘোষ জানিয়েছেন, আগেই তিনি এই দাবি করেছেন। তিনি জানান, ২০২২ সালে বাংলা, ঝাড়খণ্ড ও বিহারের পাঁচ রাজ্যকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণার দাবি জানিয়ে কেন্দ্র এবং রাজ্যপালকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তিনি।
বিজেপির বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ নতুন নয়। এর আগেও বাংলায় তাঁদের এমপিরা নানা কারণ দেখিয়ে এই ইস্যুতে সরব হয়েছে। কিন্তু নিশিকান্তর বক্তব্য তাঁদের থেকে আলাদা। গত লোকসভা থেকে কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বহিষ্কারের অন্যতম নেপথ্যনায়ক তিনি। মহুয়ার বিরুদ্ধে ‘অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন’ করার অভিযোগ তুলেছিলেন। এদিন তিনি আরও খুল্লমখুল্লা ভাষায় বঙ্গভঙ্গের সওয়াল করেছেন। নিশিকান্ত বলেন, সাঁওতাল পরগনার জনবিন্যাসের চরিত্র বদলে যাচ্ছে। আগে ওখানে ৩৬ শতাংশ আদিবাসী ছিল। কিন্তু এখন তা কমে ২৬ শতাংশ। এর কারণ হিসেবে তাঁর দাবি, বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী মুসলমানরা ওই এলাকায় এসে আদিবাসী মহিলাদের বিয়ে করছে। সেই কারণে এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ছে। ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির জন্যই এমনটা হয়েছে বলে তাঁর অভিযোগ।
এখানেই থামেননি এই বিজেপি এমপি। বলেছেন, পাকুড় এলাকায় মালদা, মুর্শিদাবাদ থেকে এসে হিন্দুদের উপর জুলুম করছে। পশ্চিমবঙ্গের পুলিস এসে ধমকাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ বা ঝাড়খণ্ড, কোনও সরকারই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সুতরাং, অবিলম্বে কেন্দ্রীয় সরকারের হস্তক্ষেপ চাই। ওখানে এনআরসি হোক। বাংলার মালদহ, মুর্শিদাবাদ, বিহারের কিসানগঞ্জ, আরারিয়া এবং কাটিহার জেলা নিয়ে হোক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। তা নাহলে হিন্দু আর থাকবে না। ধর্মান্তরকরণ এবং বিবাহের ক্ষেত্রে অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হোক।

আরও পড়ুন-থাকছে না বুকিং কাউন্টার, মেট্রোর আধুনিকীকরণে বিপাকে পড়তে চলেছেন ৩ স্টেশনের নিত্যযাত্রীরা

অনন্ত মহারাজ যা বলেছেন সেটার মর্মার্থ হল, পৃথক গ্রেটার কোচবিহার রাজ্য চাই। কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে দশ মিনিটেই তা করে দিতে পারে। কোচবিহারকে জবরদস্তি পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে জুড়ে রাখা হয়েছে। এলাকার মানুষ আলাদা রাজ্যের পক্ষপাতী। তাঁদের মতকে প্রাধান্য দিতে হবে। নাহলে সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। এই ইস্যুতে সুকান্ত-অনন্তকে কার্যত সমর্থন করেছেন জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায়। তাঁর ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, ‘বারবার বঞ্চনার শিকার হতে হতে উত্তরবঙ্গের মানুষ এখন এটাই চায়। রাজ্য সরকার যদি উন্নয়ন করতে না পারে, তাহলে উত্তরবঙ্গের দায়িত্ব ছেড়ে দিক।’
এসব দেখে-শুনে কয়েকটা কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। গত ২৬ এপ্রিল মালদহে নির্বাচনী জনসভায় মোদি জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, “আপনাদের এই উপচে পড়া ভালবাসা দেখে আমার মনে হচ্ছে, আগের জন্মে আমি নিশ্চয়ই বাংলায় জন্মগ্রহণ করেছিলাম। অথবা আগামী জন্মে আমার জন্ম হবে এই বাংলায়।” এখানেই শেষ নয়। ২৮ মে উত্তর কলকাতায় রোড-শো করার পর তিনি বলেছিলেন, “মায়ের বাড়ি, রামকৃষ্ণ মঠ, বাগবাজারে যেতে পেরে অত্যন্ত ধন্য মনে হচ্ছে। এই সেই স্থান যেখানে পবিত্র মা সারদা দেবী কয়েকবছর অতিবাহিত করেছেন। “নেতাজির পায়ে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করার ছবি দিয়ে তিনি সেদিন বলেন, “কলকাতা আজ আমার মন জয় করে নিয়েছে। আজকের রোড-শো আজীবন আমার স্মৃতিতে থেকে যাবে।” আর জুলাইয়ের শেষে পৌঁছে সব বেমালুম ভুলে মেরে দিলেন জুমলাবাজ মোদি।
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০০০ সাল থেকে গোটা দেশের মধ্যে ক্ষুদ্র সঞ্চয় প্রকল্পে সবথেকে বেশি টাকা আসে বাংলা থেকে। গোটা দেশে নেট ডাইরেক্ট ট্যাক্স অর্থাৎ মোট প্রত্যক্ষ কর যে রাজ্যগুলি থেকে সবথেকে বেশি আদায় করা হয়, সেই সর্বোচ্চ ট্যাক্সদাতা ১০টি রাজ্যের তালিকায় পশ্চিমবঙ্গ উপরের সারিতে। সর্বোচ্চ জিএসটি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রথম আটের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ। দেশের সবথেকে বেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প কোথায় আছে? উত্তরপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে। ১২ মে বারাকপুরের মঞ্চ থেকে এই মোদি পাঁচটি গ্যারান্টি দিয়েছিলেন বাংলার মানুষকে। (১) ধর্মের ভিত্তিতে কোনও সংরক্ষণ হবে না (২) তফসিলি এবং ওবিসিদের সংরক্ষণ বজায় থাকবে (৩) রামনবমীর উৎসবে কেউ বাধা দিতে পারবে না (৪) সুপ্রিম কোর্টের রামনবমী নিয়ে রায় কেউ অমান্য করতে পারবে না এবং (৫) সিএএ কেউ অমান্য করতে পারবে না।

আরও পড়ুন-বাংলার বিরুদ্ধে কেন্দ্রের বঞ্চনা,  সংসদে সোচ্চার ঝাড়গ্রাম, বর্ধমানের সাংসদ

অথচ মোদি সরকারের এবারের বাজেটে বাংলাকে কিছুই দেওয়া হল না। বিহার এবং অন্ধ্রপ্রদেশকে লক্ষ কোটি টাকার প্যাকেজ প্রকল্প দেওয়া হল, ওই রাজ্যে সবাই বিজেপি সমর্থক এমন তো নয়। বিজেপি-বিরোধী ভোটাররাও ওইসব প্রকল্পের সুবিধা পাবে। অথচ, বাংলার কেউ কিছু পেল না। ইতিহাস বলছে, বিধানচন্দ্র রায়, উপেন্দ্রনাথ বর্মণ, অতুল্য ঘোষ এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় একজোট হয়ে দলীয় মতাদর্শের দূরত্ব ভুলে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গেই রাখার জন্য নেহরু ও প্যাটেলের কাছে জোরদার চাপ দেন। আর সেটাই কার্যকর হয়। উত্তরবঙ্গ এবং দক্ষিণবঙ্গকে একজোট রেখে পূর্ণাঙ্গ পশ্চিমবঙ্গ করার সেই সাফল্যকে আজ বিজেপির লোকেরাই ভেঙে ফেলতে উদ্যত!
একটা কথা আজ স্পষ্ট করে বিজেপির নেতাদের বলার সময় এসেছে। বঙ্গবঞ্চনা থেকে বঙ্গভঙ্গ কিন্তু শেষমেশ বাংলার মানুষকে বিজেপির থেকে আরও দূরে ঠেলে দেবে, বিজেপির বঙ্গ থেকে বিদায়ের পথ প্রশস্ত করবে। বাজেটে বাংলা বঞ্চিত হল, তার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে দলের পক্ষ থেকেই দাবি করা হল, বঙ্গভঙ্গ করার। মানুষ কিছু বোঝে না ভাবছে ওরা! যে ৩৮ শতাংশ ভোটার বিজেপিকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁরাও কিন্তু এবার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাববেন। ভাববেনই। ঢাক সমেত ঢাকি বিদায় এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।

Latest article