প্রেমিক নয়, লম্পট মাইকেল
সে বছর সপ্তমী পুজোর দিন অর্থাৎ ১০ অক্টোবর রাজনারায়ণ দত্ত নৌকা করে চললেন তমলুকের উদ্দেশ্যে। তিনি তখন তমলুক রাজ পরিবারের উকিল। সঙ্গে নিলেন পুত্র মধুসূদন দত্তকে। তমলুক পৌঁছলেন ১২ অক্টোবর। তখন রাজবাড়িতে নবমী পুজোর হইচই। চারপাশে প্রচুর মানুষ ঠিক যেন মেলা বসেছে। তার পর বিজয়ার হইহট্টগোল মিটে গেলে শুরু হল নতুন ব্যস্ততা। ১৯ অক্টোবর বুধবারে শুরু হল লক্ষ্মীপুজোর ব্যবস্থা। এ যেকোনও লক্ষ্মীপুজো নয়, রাজবাড়ির লক্ষ্মীপুজো। সবই বড় মাপের। ছেলে মধুসূদন একাকী কারণ রাজনারায়ণ ছেলের সঙ্গে কথা বলার ফুরসত পাচ্ছেন না। ধনী মক্কেলের পারিবারিক মজলিশে তাঁকে সময় কাটাতে হচ্ছে। তিনি বিন্দুমাত্র টেরও পাচ্ছেন না যে তাঁর আঠারো বছরের ছেলে তমলুকে এসে প্রেমে পড়েছে। কেউ বলছেন প্রেমিকা বিধবা এক রমণী। আবার কেউ বলছেন বিধবা নয়, বিবাহিত এক রমণী। অবশ্য মধুসূদন সতেরো দিনের এই তমলুক সফরের মাঝে একরাতে বন্ধু গৌর দাসকে লিখলেন, ‘এখানে আমার একটা ছোটখাটো প্রেমের অভিজ্ঞতা হয়েছে। সুতরাং দেখতেই পাচ্ছো, বিবাগী এবং সন্ন্যাসী থেকে রাতারাতি একটা লম্পটে পরিণত হয়েছি।’
আরও পড়ুন-কৃষিকাজে সাফল্য, রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পাচ্ছেন করঞ্জলির গৃহবধূ বর্ণালি ধারা
বাড়িয়ে বলা মধু
মধুসূদন থেকে মাইকেল মধুসূদন হওয়ার এ শুধু খ্রিস্টান রূপান্তর নয়, কেউ কেউ বলেন রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যা দেবকীর প্রতি তাঁর প্রেম ছিল আজীবন। তাই তিনি খ্রিস্টান হয়েছিলেন। তবে যখন মধুসূদন খ্রিস্টান হলেন তখন দেবকীর বয়স পাঁচ বছর। দশ বছর বয়সে মধুকে নিয়ে কলকাতায় এসেছেন তাঁর পিতা রাজনারায়ণ। কলকাতার স্কুলে ভর্তি হয়ে অদ্ভুত সমস্যার মুখে পড়েন মধু। স্কুলের অন্যান্য ছাত্রদের মতো ইংরেজিতে কথা বলতে পারে না বরং উদ্ভট যশুরে ভাষায় বাংলা বলে আর খোরাক হয় বন্ধুদের কাছে। এসব থেকে মুক্তি পেতে মধু নিজের মতো করে প্ল্যানমাফিক জীবন চালাতে লাগলেন। বাল্য এবং কৈশোরে যা ছিল আত্মরক্ষার অস্ত্র সেটাই রূপান্তরিত হল অভ্যাসে। বিনা কারণে মধু অহংকারী হয়ে উঠলেন, রপ্ত করলেন বাড়িয়ে বলা। এই অভ্যাসেই তিনি কলকাতা থেকে লেডি সেল জাহাজে করে মাদ্রাজে পাড়ি দিলেন। যাত্রীদের তালিকায় মধুসূদন নিজেই লেখেন মিস্টার এম এম দত্ত অফ বিশপস কলেজ। আবার মাদ্রাজে যখন রেবেকাকে বিয়ে করেন রেজিস্ট্রারে মধু পিতৃপরিচয় লেখেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট। এখানেও বাড়িয়ে বলা। পিতা রাজনারায়ণ দত্ত টেরও পাননি।
মাইকেল হলেন মধুসূদন
প্রেমিক মধুসূদনের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে রাজনারায়ণ তমলুকে বসে ঠিক করলেন ছেলের বিয়ে দেবেন। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। যোগ্য পাত্রীও খুঁজে বের করলেন। পাত্রী জমিদারকন্যা। তার রূপ নাকি পরির মতো। পাত্রী সম্পর্কে এর বেশি তথ্য জানা যায়নি। উনিশ বছর বয়সি মধুসূদন বেঁকে বসলেন বিয়েতে। কিছুতেই তিনি এই বিয়ে করবেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন বিয়ে করতে গেলে ভালবেসেই বিয়ে করতে হবে। বাবার দেওয়া এই বিয়ের প্রস্তাব তাঁর কাছে ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। মধুসূদন নিজের মানসিক অবস্থা চিঠি লিখে জানালেন বন্ধু গৌর দাস কে— ‘‘এখন থেকে তিন মাস পরে আমায় বিয়ে করতে হবে— কী ভয়ানক ব্যাপার। এটা ভাবলেও আমার রক্ত শুকিয়ে যায় এবং আমার চুলগুলো সজারুর কাঁটার মতো খাড়া হয়ে ওঠে। যার সঙ্গে আমার বিয়ে হবার কথা, সে হল এক ধনী জমিদারের কন্যা। হতভাগিনী মেয়ে। অজ্ঞাত ভবিষ্যতের গর্ভে তার জন্যে কী দুঃখই যে জমা আছে!’’
এই বিয়ে থেকে বেরোনোর পথ খুঁজছেন মধুসূদন। পথ বের করেও ফেললেন। গ্রহণ করলেন খ্রিস্ট ধর্ম। মধুসূদন থেকে হয়ে উঠলেন মাইকেল মধুসূদন। যাতে কোনও হিন্দু পিতা তাঁর সঙ্গে তাঁর কন্যার বিয়ে না দেন। ফলে তাঁকে কোনওদিনই বাল্যবধূকে বিয়ে করতে হবে না। মাইকেল হওয়ার সময় তিনি এই কঠিন সত্যগুলো জানতেন। খিদিরপুরের বাড়িতে তিনি আর একা থাকতে পারবেন না। এই পাড়াতেও তাঁকে কেউ আর বাড়ি ভাড়া দেবে না। সাধের হিন্দু কলেজে পড়া বন্ধ হয়ে যাবে। প্রিয় বন্ধুরা অনেকেই সঙ্গ ত্যাগ করবে। তবুও মধুসূদন এই সিদ্ধান্ত নিলেন। খ্রিস্টান হওয়ার সময় একমাত্র শর্ত হিসাবে মিশনারিদের কাছে দাবি করেছেন তাঁকে বিলেত পাঠানো হোক। আর মিশনারিরা মহানন্দে সেই শর্ত মেনেও নিয়েছেন। হঠাৎই মধুসূদন বাড়ি থেকে উধাও হলেন। দু’দিন পর তাঁর খোঁজ মিলল ফোর্ট উইলিয়ামে। কলকাতায় সুপ্রিম কোর্টের একজন নামী উকিলের পুত্র ওই হিন্দু কলেজের সেরা ছাত্রকে খ্রিস্টান ধর্মে দীক্ষা দেওয়া হবে, এটাই ছিল মিশনারিদের একটা বড় জয়। অনেক তর্ক-বিতর্ক চলল। পেয়ারিমোহন, রামচন্দ্র মিত্র, গৌর দাস অনেক বোঝালেন মাইকেলকে। সবাই ব্যর্থ হলেন। ওল্ড চার্চে মাইকেল হয়ে গেলেন মধুসূদন।
মাইকেল হওয়ার পর সমাজ তাঁকে বয়কট করল। হিন্দু কলেজ তাঁকে তাড়িয়ে দিল। এমনকী বাবা-মায়ের কাছেও তিনি আর থাকতে পারলেন না। রাজনারায়ণ ভাবলেন কিছুদিন পর তাঁকে আবার স্বধর্মে ফিরিয়ে আনা যাবে। এত কিছুর মধ্যে মধুসূদন কিন্তু পড়া চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাই বিশপ কলেজে পড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হল। বাবার সঙ্গে অশান্তি তাঁর লেগেই থাকত। বাবা টাকা দেওয়া বন্ধ করে দেওয়ায় তাঁকে কলেজও ছাড়তে হল।
আরও পড়ুন-আরপিএফের হকার নিগ্রহ, প্রতিবাদে এনজেপি অভিযানের ডাক ঋতব্রতর
ক্যাপটিভ লেডি রেবেকা
১৮৪৮ সালের ১৮ জানুয়ারি মঙ্গলবার লেডি সেল নামের জাহাজটি মাদ্রাজে পৌঁছল। জাহাজ থেকে নামলেন মাইকেল মধুসূদন ডাট। বিশপ কলেজে তাঁর সহপাঠী এডবার্গ কেনেটের আনুকূল্যে তাঁর একটা চাকরিও জুটল অরফান অ্যাসাইলাম বয়েজ স্কুলে। নামে বয়েজ স্কুল হলেও মেয়েরাও পড়তে আসত। রেবেকা মেকটাভিস থাকতেন ফিমেল অ্যাসাইলামে, পড়তেন অরফান স্কুলে। এখানেই তাদের পরিচয়। কলেজের বার্ষিক প্রতিবেদনে রেবেকা সম্পর্কে প্রশংসা করেছেন মাইকেল। ‘নীল নয়না, শ্বেতাঙ্গিনী, সুন্দরী’। রেবেকার সঙ্গে তাঁর বিয়েও হয়ে গেল মাত্র ছয় মাসের মধ্যে। রেবেকার পিতৃপরিচয় ছিল রহস্যে ঘেরা। বাবা ছিল রবার্ট থমসন, মা ক্যাথরিন থমসন। রবার্টের মৃত্যুর পর সে আশ্রয় পায় ডুগান্ট মেকটাভিসের কাছে। পরবর্তীতে মেকটাভিসকেই বাবা হিসেবে দেখিয়েছেন রেবেকা। অথচ তাঁকে থাকতে হয়েছে অ্যাসাইলামে। তিনি কিন্তু অনাথ ছিলেন না।
সুখের হয় রমণীর গুণে
বিয়ের সাড়ে তিন মাসের মধ্যে রেবেকা সন্তানসম্ভবা হন। তখন মাইকেলের অভাবের সংসার। তবু এরই মধ্যে মাইকেল লিখে ফেলেন মাদ্রাজ সার্কুলার পত্রিকার জন্য ‘ক্যাপটিভ লেডি’ কাব্যটি। পরে ধারদেনা করে বইটি ছাপিয়ে কলকাতায় পাঠিয়েছেন মাইকেল। তাঁর বিশ্বাস ছিল কলকাতার বুদ্ধিজীবী সমাজ তাঁকে গ্রহণ করবে ও কবি বলে পরিচিতি দেবে। কিন্তু ভাগ্যের কী পরিহাস, বিক্রি হল মাত্র আঠারো কপি। সমালোচনার মুখে পড়লেন মাইকেল। ‘বেঙ্গল হরকরা’ পত্রিকায় মাইকেলকে তীব্র আক্রমণ করে রিভিউ লেখা হল, যেখানে ব্যক্তি মাইকেলকে ছিঁড়েখুঁড়ে ফেললেন সমালোচক। বেথুন সাহেবও কাব্য সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করলেন না। বরং লিখলেন, ‘‘…ইংরেজি চর্চার মাধ্যমে তিনি যে রুচি এবং মেধা অর্জন করেছেন, তা তাঁর নিজের ভাষার মানোন্নয়ন এবং কাব্যভাণ্ডার সমৃদ্ধ করার কাজে ব্যয় করুন।’ তবু মাদ্রাজে বসে লেখা চালিয়ে গেছেন মাইকেল। জ্ঞানচর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ‘রিজিয়া’ (সম্পূর্ণ করেননি), প্রথমে ‘ইউরেশিয়ান’, পরে একযোগে ‘ইস্টার্ন গার্ডিয়ান’ ও ‘মাদ্রাজ হিন্দু ক্রনিকল’ সম্পাদনা করেছেন, গ্রিক-ল্যাটিন-হিব্রু-সংস্কৃত-ইংরেজি অধ্যয়ন করছেন একদম রুটিন মেনে।
এদিকে সন্তানের জন্মের পর রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য রেবেকা তাঁর সন্তানকে নিয়ে বেড়াতে যান নাগপুরের দিকে। এই প্রথম রেবেকার সঙ্গে মাইকেলের দীর্ঘ বিচ্ছেদ। সন্তানকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন মাইকেল। ‘অন দ্য ডিপারচার অব মাই ওয়াইফ অ্যান্ড চাইল্ড টু দ্য আপার প্রভিন্সেস’ নামে একটি কবিতা: ‘‘মাই হোম ইজ লোনলি— ফর আই সিক ইন ভেন/ ফর দেম হু মেড ইটস স্টার-লাইট’।
নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে রেবেকার কোলে চার সন্তানের জন্ম হয়—ব্যর্থা, ফিবি, জর্জ, জেমস। দুটি মেয়ে, দুটি ছেলে। ‘চমৎকার স্ত্রী এবং চারটি সন্তানের’ সংসার যখন তিনি বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে বসছেন, তখন ১৮৫৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর বুধবারে গৌর দাসের লেখা একটি চিঠি থেকে তিনি জানতে পারলেন বাবা রাজনারায়ণ দত্ত মারা গেছেন অন্তত এগারো মাস আগে— ‘‘সম্পত্তির উত্তরাধিকার নিয়ে তোমার জ্ঞাতিভাইয়েরা কাড়াকাড়ি করছে। তোমার দুই বিধবা মাতা বেঁচে আছেন। কিন্তু তোমার লোভী এবং স্বার্থপর আত্মীয়দের বাড়াবাড়ির জন্য তাঁরা তাঁদের মৃত স্বামীর সম্পত্তি থেকে প্রায় বঞ্চিত হয়েছেন।’ এই চিঠি পেয়ে মাইকেল কলকাতা আসেন।
আরও পড়ুন-রাজ্যের শিল্পীদের পণ্যে সেজে উঠছে বলিউডের সেট, রিফিউজি হ্যান্ডিক্রাফটসের উদ্যোগ
প্রেমের জোয়ারে হেনরিয়েটা
রেবেকা যখন স্বাস্থ্য উদ্ধারের আশায় ভ্রমণে বেরিয়েছেন তখনই তাঁর সহকর্মী জর্জ জাইলস ওয়াইটের স্ত্রী বিয়োগ হয়। জর্জের তিন সন্তান বড় মেয়ে হেনরিয়েটা, ছোট দুই ছেলে উইলিয়াম ও আর্থার। মাতৃহারা সন্তানদের মাইকেল একটু বেশি সময় দিচ্ছিলেন। বছর তিনেকের মধ্যে জর্জ ওয়াইট দ্বিতীয়বার বিয়ে করে নিলেন। জর্জের বয়স সাতচল্লিশ। হেনরিয়েটার সতেরো। নতুন মায়ের থেকে এক বছরের বড়। জর্জের পরিবারে শুরু হল অশান্তি। সৎ মায়ের সঙ্গে হেনরিয়েটার বিবাদ। তাঁর পাশে দাঁড়ালেন মাইকেল। কাছে গেলেন— তাঁদের প্রেম গভীর থেকে গভীরতর হল। তাঁর সঙ্গে এই প্রেম প্লেটনিক ছিল না। মাইকেল একই সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছিলেন দুটি সম্পর্ক রেবেকার সঙ্গে দাম্পত্য ও হেনরিয়েটার সঙ্গে প্রেম। হেনরিয়েটা তাঁর সাহিত্যের প্রেমে পড়েছিলেন।
তাঁর সঙ্গ মাইকেল পছন্দ করতেন। অন্যদিকে রেবেকা ছিলেন মাইকেলের নির্ভরতার সঙ্গী। রেবেকা অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মাইকেলকে বিয়ে করেছিলেন। এই কৃতজ্ঞতা মাইকেলের ছিল। তাই হেনরিয়েটা যখন মাইকেলকে বিয়ে করতে চাইলেন মাইকেল স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন রেবেকাকে ডিভোর্স দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। রেবেকা অবশ্য জানতে পেরেছিলেন স্বামীর নতুন প্রেমের কথা। রেবেকা নিজের চোখে দেখেছেন মাইকেল হেনরিয়েটার ঘনিষ্ঠতা। তাই চেন্নাই ছেড়ে পালানো ছাড়া মাইকেলের অন্য কোনও পথ ছিল না।
সেই যে কলকাতায় পালিয়ে এসেছিলেন মাইকেল আর কোনওদিন ফিরে যাননি রেবেকার কাছে। তাঁর সন্তানের কাছে। অথচ রেবেকাও তাঁকে বিচ্ছেদ দেননি। রেবেকা চাননি হেনরিয়েটাকে বিয়ে করে সুখে সংসার করবেন মাইকেল। মাইকেলও বুঝতে পারলেন বিবাহবিচ্ছেদ পাবেন না। তিনি তখন হেনরিয়েটাকে কলকাতায় চলে আসতে বললেন। বাবার অনুমতি ছাড়াই হেনরিয়েটা কলকাতায় চলে এলেন। মাইকেলের কলমে তখন সৃষ্টির জোয়ার। সৃষ্টির আনন্দে তিনি মত্ত। ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্ণকুমারী’, ‘মায়াকানন’ নাটক, ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র মতো প্রহসন, ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ব্রজাঙ্গনা কাব্য’ ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’— পাঁচ বছরে মাইকেল বাংলা নাটক এবং কাব্যকে অন্য মাত্রা দিলেন। হেনরিয়েটা ও মাইকেলের প্রেম দাম্পত্য ছিল পনেরো বছরের। প্রথমে কলকাতা। পরে ইউরোপ। আবার কলকাতা। হেনরিয়েটার গর্ভেও মাইকেলের চার সন্তান শর্মিষ্ঠা, ফ্রেডরিক ও অ্যালবার্ট তৃতীয় সন্তান অবশ্য জন্মের পরই মারা যান।
আরও পড়ুন-নেতাজির পথ ওদের রাস্তা নয়
দাঁড়াও পথিকবর!
মাইকেলের জীবন বেহিসেবি। জীবনের অঙ্ক কখনও মেলেনি। জীবনের প্রতি পর্বে ভগ্নাংশ রয়ে গেছে। অবশ্য ছাত্র অবস্থায় মাইকেল গণিতে ছিলেন পারদর্শী। একবার সব ছাত্র যখন অঙ্ক কষতে ফেল করল মাইকেল সেই অঙ্ক করে দিয়ে মন্তব্য করলেন— দেখলে তো! শেক্সপিয়র ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন— কিন্তু নিউটন ইচ্ছে করলে শেক্সপিয়র হতে পারতেন না! সেই মাইকেল ব্যারিস্টার হয়ে কলকাতায় আসার আগেই কাটালেন তার বিলাসীজীবন। হটকারী সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবারকে রেখে এলেন ভারসাইলে। এর মধ্যেই বিদ্যাসাগরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি ঘটল। ভারসাইতে দারিদ্রপীড়িত হেনরিয়েটা সুরাপানে আসক্ত হয়ে পড়লেন। সন্তানদের নিয়ে ফিরলেন কলকাতায় তবুও অবস্থার উন্নতি হল না। এদিকে মাইকেলের স্বাস্থ্য যখন একেবারে ভেঙে পড়েছে তখন তাঁর কন্যা শর্মিষ্ঠার বয়স ১৩ বছর। বিয়ে দিয়ে দিলেন এক অ্যাংলো যুবকের সঙ্গে। মেয়ের বিয়ের পর মাইকেল সপরিবারে গেলেন উত্তরপাড়ায়। আশ্রয় নিলেন লাইব্রেরির উপরতলায়। তখন তাঁর বন্ধু গৌর দাস মাইকেলকে দেখে লিখলেন— ‘সে তখন বিছানায় তার রোগযন্ত্রণায় হাঁপাচ্ছিল। মুখ দিয়ে রক্ত চুঁইয়ে পড়ছিল। আর তার স্ত্রী তখন দারুণ জ্বরে মেঝেতে পড়ে ছিল।’ তার কিছুদিন পরে হেনরিয়েটা মারা গেলেন। কিন্তু হেনরিয়েটার মৃত্যুসংবাদ পেলেন তাঁর পুরনো কর্মচারীর কাছ থেকে। শেষ পর্যন্ত মাইকেলেরও ছুটি হল। অনেক তর্ক-বিতর্ক টানাপোড়েনের পর মাইকেলকে সমাধিস্থ করা হল লোয়ার সার্কুলার রোডের কবরস্থানে। মাত্র ৪ দিন আগে এখানেই হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। আশার ছলনে না ভুলে চিরস্থায়ী হল মাইকেল আর হেনরিয়েটার সমাধিতে।