প্রতিদিনের জীবন যেন প্লাস্টিকের জালে বন্দি— খাবার থেকে বাসন, বাজার থেকে স্বপ্ন— সবই তার ছোঁয়ায় ছাপা। সহজতার মোহে প্লাস্টিক হয়ে উঠেছে নিত্যসঙ্গী যার সঙ্গে ধ্বংসের নিঃশব্দ ফাঁদ। বিগত দশকে প্রতি বছর ৪০০ মিলিয়ন টন হারে প্লাস্টিকের ব্যবহার বেড়েছে। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, এই হার আগামী ২০৪০ সাল নাগাদ দ্বিগুণ হয়ে যাবে। ২০২২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের পরিবেশ-সংক্রান্ত একটি অধিবেশনে বৈশ্বিক প্লাস্টিক দূষণ রোধের জন্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে এ-বিষয়ে একটি আইনি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, সময়সীমা ২০২৪-এর মধ্যে।
আরও পড়ুন-বেআইনিভাবে বাংলার ২২ হাজার কোটি পেল বিজেপির তিন রাজ্য
প্রতি বছর জুনে বিশ্ব পরিবেশ দিবস এবং বিশ্ব পরিবেশ সচেতনতা মাস পালিত হয়। ২০২৫ সালের এর প্রতিপাদ্য হল ‘বৈশ্বিক প্লাস্টিক দূষণ রোধ’ যা বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক বর্জ্যের ক্রমবর্ধমান সমস্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হোস্ট কান্ট্রি রিপাবলিক অব কোরিয়া। প্লাস্টিক দূষণ পরিবেশ, জীববৈচিত্র এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় কিছু পদক্ষেপের প্রয়োজন। এই নিবন্ধে তেমন কিছু উপায় যা প্লাস্টিক দূষণ কমাতে সহায়ক হবে।
প্লাস্টিক বর্জন পুনর্ব্যবহার চ্যালেঞ্জ
প্লাস্টিক বর্জ্যকে পুনর্ব্যবহারের মাধ্যমে সৃজনশীল উপায়ে ব্যবহার করা যায় এমন একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে, যা কিনা ‘প্লাস্টিক বর্জন পুনর্ব্যবহার চ্যালেঞ্জ’ বা ‘আপসাইকেল ফেস্ট’ নামে পরিচিত হতে পারে। এতে স্থানীয় সম্প্রদায়, শিক্ষার্থী এবং শিল্পীরা ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল, ব্যাগ বা প্যাকেজিং থেকে দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস যেমন ফুলদানি, ব্যাগ বা শিল্পকর্ম তৈরি করবে। এই প্রতিযোগিতা শুধু সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করবে না, বরং প্লাস্টিক বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করবে।
প্লাস্টিক-মুক্ত দিন প্রচারণা
একটি নির্দিষ্ট দিনকে ‘প্লাস্টিক-মুক্ত দিন’ হিসেবে ঘোষণা করে সম্প্রদায়, স্কুল বা কর্মক্ষেত্রে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা যেতে পারে। এই দিনে অংশগ্রহণকারীদের প্লাস্টিকের বোতল, ব্যাগ বা প্যাকেজিংয়ের পরিবর্তে কাঁচ, কাপড় বা বাঁশের তৈরি বিকল্প ব্যবহার করতে উৎসাহিত করা হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় #PlasticFreeDay হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করে অংশগ্রহণকারীরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করতে পারে, যা অন্যদেরও এই অভ্যাস গ্রহণে উৎসাহিত করবে।
অ্যাপ-ভিত্তিক প্লাস্টিক ট্র্যাকার
প্রযুক্তির ব্যবহার প্লাস্টিক দূষণ কমাতে একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি বা ডিজিটাল প্রচার করা যেতে পারে, যা ব্যবহারকারীদের তাদের দৈনন্দিন প্লাস্টিক ব্যবহার ট্র্যাক করতে সাহায্য করবে। এই অ্যাপে ব্যবহারকারীরা তাদের প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ লিপিবদ্ধ করতে পারবে এবং কীভাবে তা কমানো যায়, সে-সম্পর্কে পরামর্শ পাবে। অ্যাপে স্থানীয় পুনর্ব্যবহার কেন্দ্রের তথ্য, টেকসই পণ্য বিক্রির দোকানের ঠিকানা এবং প্লাস্টিক-মুক্ত জীবনধারার টিপস যুক্ত করা যেতে পারে। যা তরুণ প্রজন্মকে পরিবেশবান্ধব অভ্যাস গড়ে তুলতে সাহায্য করবে।
প্লাস্টিক সংগ্রহ ও পুরস্কার প্রোগ্রাম
প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহকে উৎসাহিত করতে স্থানীয় ব্যবসা বা সংগঠনের সঙ্গে মিলে একটি পুরস্কার প্রোগ্রাম চালু করা যেতে পারে। এই প্রোগ্রামে অংশগ্রহণকারীরা ব্যবহৃত প্লাস্টিক সংগ্রহ কেন্দ্রে জমা দিয়ে পয়েন্ট অর্জন করবে। এই পয়েন্ট দিয়ে তারা টেকসই পণ্য যেমন বাঁশের তৈরি স্ট্র, কাপড়ের ব্যাগ বা পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য কিনতে পারবে। এই উদ্যোগ প্লাস্টিক সংগ্রহ ও পুনর্ব্যবহারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়াবে এবং স্থানীয় পর্যায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সহায়তা করবে।
শিক্ষামূলক প্লাস্টিক ডিকম্পোজিশন প্রদর্শনী
প্লাস্টিক দূষণের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে স্কুল, কলেজ বা পাবলিক প্লেসে একটি শিক্ষামূলক প্রদর্শনী আয়োজন করা যেতে পারে। এই প্রদর্শনীতে বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিকের (প্লাস্টিক ব্যাগ, বোতল বা স্ট্র) পচনশীলতার সময় ভিজ্যুয়াল ডিসপ্লে বা ইন্টার-অ্যাকটিভ মডেলের মাধ্যমে দেখানো হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি প্লাস্টিক ব্যাগ পচতে ২০ থেকে ১০০০ বছর পর্যন্ত সময় নিতে পারে, যা দর্শকদের এই সমস্যার গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করবে।
প্লাস্টিক-মুক্ত বাজার মেলা
স্থানীয়ভাবে একটি ‘প্লাস্টিক-মুক্ত বাজার মেলা’র আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে শুধুমাত্র প্লাস্টিক-মুক্ত পণ্য যেমন বাঁশের টুথব্রাশ, কাপড়ের ব্যাগ বা ধাতব স্ট্র বিক্রি হবে। এই মেলায় স্থানীয় উদ্যোক্তারা তাঁদের টেকসই পণ্য প্রদর্শন করতে পারবেন। এছাড়া, মেলায় কর্মশালার আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে দর্শকরা শিখবে কীভাবে প্লাস্টিকের বিকল্প তৈরি করা যায়। এই ধরনের মেলা স্থানীয় অর্থনীতিকেও উৎসাহিত করবে।
আরও পড়ুন-চেনাব রেল প্রকল্প: নাড্ডার মিথ্যাচার, কড়া জবাব কাকলির
প্লাস্টিক সোয়াপ ইভেন্ট
একটি ‘প্লাস্টিক সোয়াপ’ ইভেন্ট আয়োজন করা যেতে পারে, যেখানে মানুষ তাদের একক-ব্যবহারের প্লাস্টিক পণ্য (প্লাস্টিকের বোতল, কাটলারি) নিয়ে এসে সেগুলো টেকসই বিকল্পের (ধাতব স্ট্র, কাপড়ের ব্যাগ) সঙ্গে বিনিময় করতে পারবে। এই ইভেন্ট প্লাস্টিক ব্যবহার কমাতে এবং টেকসই জীবনধারা গ্রহণে মানুষকে উৎসাহিত করবে। স্থানীয় ব্যবসা বা এনজিও এই ধরনের ইভেন্টে অংশ নিয়ে তাদের টেকসই পণ্য প্রচার করতে পারে।
প্লাস্টিক দূষণ ম্যাপিং প্রকল্প
স্থানীয় সম্প্রদায় বা স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে একটি ‘প্লাস্টিক দূষণ ম্যাপিং’ প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। এই প্রকল্পে অংশগ্রহণকারীরা তাদের এলাকায় প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎস চিহ্নিত করবে এবং ম্যাপে তা লিপিবদ্ধ করবে। এই তথ্য স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেওয়া যেতে পারে, যাতে তারা প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। এই প্রকল্পে স্মার্টফোন অ্যাপ বা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে, যা তরুণদের এই কাজে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবে।
জুন মাস আমাদের জন্য প্লাস্টিক দূষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। উপরে উল্লিখিত ধারণাগুলো প্রতিটি স্থানীয় ও বৈশ্বিক পর্যায়ে প্লাস্টিক দূষণ কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এই উদ্যোগগুলো শুধু সচেতনতা বাড়াবে না, বরং মানুষকে টেকসই জীবনধারা গ্রহণে উৎসাহিত করবে। আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা একটি প্লাস্টিক-মুক্ত, পরিচ্ছন্ন, এবং সবুজ পৃথিবী গড়ে তুলতে পারি।